IQNA

ফাতিমার ইসলাম গ্রহণ এবং হজে রওয়ানা হওয়ার মর্মস্পর্শী কাহিনী

18:36 - August 09, 2018
সংবাদ: 2606419
ফাতিমার হজের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়াটা তার জন্য একটি চূড়ান্ত ভ্রমণ হয়ে দাঁড়ায় কারণ তিনি রহমতের হজে যাওয়ার খুশির খবর শোনার আগেই তার ভ্রমণ শুরু করেছিলেন। সচেতনভাবেই ইসলামকে তিনি যেদিন তার জীবনে স্থান দেন সেদিন থেকেই তার এই ভ্রমণের প্রথম ধাপ শুরু হয়েছিল।

ফাতিমার ইসলাম গ্রহণ এবং হজে রওয়ানা হওয়ার মর্মস্পর্শী কাহিনী 

বার্তা সংস্থা ইকনা: এটা ছিল ১৯৯৫ সালের অন্য সব দিনের মতই একটি কর্মব্যস্ত সাধারণ দিন। রাইল্যান্ড স্টেটে তার নিয়োগ কর্তা মেহেরুননিসা দাউদ ওরফে মেহরুন বাহনার অধীনে কর্মব্যস্ত সময়গুলোতে কাজ করা কালীন ফাতিমা পরিচিত ছিলেন নোজিবেলে ফিলিস মালি নামে।

একদিন কাজ করার সময় ফাতিমা পার্শ্ববর্তী লাউঞ্জ থেকে মেহরুন বাহনার পুত্র শাফিকের কুরআনের একটি অধ্যায় থেকে মুখস্ত তিলাওয়াত শুনতে পান, যেটা তার মনে সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলে। ফাতিমা জাদুমুগ্ধ হয়ে তার তিলাওয়াত শুনতে থাকেন। যদিও তিনি এর একটি শব্দও বুঝতে পারেননি এরপরও তার কাছে এটাকে মনে হয়েছিল আশ্চর্যজনক এবং আকর্ষণীয়।

‘এই শিশুটির বসার ধরন এমন কেন?’ ফতিমার কৌতূহল তার কাজের প্রতি স্থবিরতা এনে দেয়। একজন আস্থাবান কর্মচারী হিসাবে তিনি তার কাজে স্থবিরতা দেখাতে চান না তাই তিনি গোপনে সবকিছু অবলোকন করছিলেন।

‘আমি চাইনি যে সে আমাকে দেখুক, কারণ আমাকে কাজ করতে হবে’-ফাতিমা বলেন।

কিন্তু তিলাওয়াতের প্রতি আকর্ষণ বোধ করতে থাকেন ফাতিমা, যে সম্মানজনকভাবে শিশুটি কুরআন শরিফের সামনে বসে আছে সে দৃশ্য দেখেও তিনি মুগ্ধ হন। এটা খুবই সুন্দর এবং একই সাথে বিচলিত হওয়ার মত কারণ যা তিলাওয়াত করা হচ্ছে তার কিছুই আপনি বুঝতে পারছেন না। ফাতিমা নিজেকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন সে এরকম মধুর সুরের প্রতি আকর্ষণ বোধ করছেন।

তিনি পায়ের শব্দ শোনার সাথে সাথেই তার কাজে মনোযোগ দেন। কিন্তু তার মন এবং হৃদয় শিশুটির তিলাওয়াতের প্রতি মগ্ন হয়ে যায়। তিনি কুরআন বা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তিনি শুনতে থাকেন এবং একসময় চূড়ান্তভাবেই এই সত্য বুঝতে পারেন যে- ‘এমনটি আমার হৃদয় থেকেই আসতেছে।’

হৃদয় ছোঁয়া শিশুটির (শাফিক) তিলাওয়াত, তার বসার ভঙ্গি ইত্যাদি কারণে যে আবহাওয়া তৈরি হয়েছে যা তার হৃদয়ে নাড়া দেয়।

কিন্তু সেখানে আরেকটি বিষয় ছিল, যাতে এমনটি তার হৃদয় থেকে এসেছিল- বলছিলেন ফাতিমা।

‘প্রতিদিন সকালে যখন আমি আসি তখন দেখতে পাই এই মহিলাটির মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকে।’ এমনকি যখন ফাতিমা তার কাজে কোনো ভুল করেন তখন তার আঘাত প্রাপ্ত হওয়ার কোনো ভয় থাকে না। এমনকি সেখানে দয়া এবং উপদেশের সংস্কৃতি ছিল।

ফতিমা এর পূর্বে যেই মুসলিম বাড়িতে কাজ করেছিলেন, তা থেকে এখানকার আচারণ একদমই ভিন্ন। মেহরুন বাহনার সাথে তার একটি অপ্রত্যাশিত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বর্ণ, শ্রেণী, মালিক-শ্রমিকের ভেদাভেদহীন তার সাথে বোনের মত সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

পরিবারের অন্য সদস্যরা যে প্লেটে খাওয়া খায় ফতিমাও সেই প্লেটেই খান এবং মেহরুন বাহনা যে টেবিলে বসেন তিনিও সেই একই টেবিলে বসে খাওয়া খান। যেখানে মানুষের তৈরি ভেদাভেদের কারণে একজন আরেকজনকে অত্যাচার করে সেখানে এই জায়গায় একজন আরেকজনের হৃদয় ছুঁয়ে দেয়। এরকম হৃদয় ছোঁয়ার বিষয়টি সম্পর্কে ফাতিমার উপলব্ধি হতে থাকে ‘একই সাথে কান্না এবং হাসির’ মত ব্যাপার।

প্রার্থনা দ্বারা বিস্মিত

আরেকটি দিক যা ফাতিমার হৃদয় ছুঁয়ে যায় তা হচ্ছে, মেহরুন বাহনার অজু করা এবং প্রার্থনা করার ভঙ্গি দেখে। দুপুর ১.০০ ঘটিকার সময়ে মেহরুন বাহনা বাথরুমে যান এবং পুরো শরীর আবৃত্ত হয় এমন একটি সুন্দর পোশাক এবং মাথা ডেকে দেয়ার মত একটি স্কার্ফ পরে বের হন ।

তার মন তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন দ্বারা তাড়িত করে যে, এই ঘরে এগুলো কি হচ্ছে? কেন আমি এই মানুষগুলো এবং তাদের জীবনযাপন দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছি? মেহরুন বাহনা ফাতিমার এমন কৌতুহল সম্পর্কে বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারেন, ফাতিমার আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা খোঁজার বিষয়ে।

ফাতিমা মেথডিস্ট চার্চে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং সে তার পরিবারের বেঁচে থাকা একমাত্র সদস্য।

মেহরুন বাহনা ফাতিমার সাথে ধর্ম, চার্চ এবং তার বিশ্বাস সম্বন্ধে আলোচনা করেন। তারা নাস্তার টেবিলে এমন একটি বিষয় নিয়ে কথা বলেন যাতে ফাতিমা তার বিশ্বাস সম্বন্ধে অসন্তুষ্ট হন। মেহরুন বাহনা তাকে প্রার্থনা করার জন্য উপদেশ দেন।

‘যখন তুমি আমার দরজা ছেড়ে যাবে, সৃষ্টি কর্তার সাথে কথা বলো। বল ‘হে সৃষ্টিকর্তা, দয়া করে আমাকে সাহায্য কর। আমাকে সত্য দেখাও।’ তুমি তোমার বাড়ি যাওয়া অবধি এমনটি বলবে এবং সৃষ্টিকর্তা তোমাকে সত্য পথ দেখাবেন।’

এর কিছু মাস পরে মেহরুন বাহনা ফাতিমাকে তার ইসলামিক দাওয়াহ মুভমেন্টের (আইডিএম) অফিসে নিয়ে গেলেন যেখানে সংঘঠনটির জোসা ভাষাভাষীর সদস্যরা ফাতিমাকে তার নিজের ভাষায় ইসলাম সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেন। এর পরেই ফাতিমা ইসলামকে তার জীবনে আবদ্ধ করার জন্য স্বেচ্ছায় সিদ্ধান্ত নেন।

ফতিমাকে নিয়ে আইডিএমে যাওয়ার দিনটি সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে মেহরুন বাহনা বলেন, ‘আমি যখন ফিরে এসেছিলাম তখন ইমাম সাহেব আমাকে জানিয়েছিলন যে, ‘সে শাহাদা (সত্যের সাক্ষ্য দেয়া) উচ্চারণ করেছে এবং ফাতিমা নাম পছন্দ করেছে’। এটা ছিল আমার জন্য খুবই আবেগপূর্ণ একটি সময়। আমি সত্যিই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম।’

নতুন জীবনের কষ্ট

ফাতিমার জীবনে পরিবর্তনের দিকটা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। তিনি তার সম্পর্কে বর্ণনা দেন এভাবে যে, আগে তিনি শুধুমাত্র তার নিজের প্রয়োজন নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন আর এখন তিনি অন্যদের কি কি প্রয়োজন সে সম্পর্কেও সচেতন। এর আগে অন্যদের জন্য তার কোনো সময় ছিল না আর এখন তিনি বলেন, তিনি অন্যের মুখে হাসি ফোটানেরা জন্য সময় বের করে নেন।

কিন্তু তার এই নতুন জীবন একেবারে কষ্ট ছাড়াই তার জীবনে আসেনি। যদিও তার ভাই ডগলাস তার প্রতি খুবই দয়ালু এবং সে তার ঘর ফাতিমার সাথে ভাগাভাগি করে যেখানে সে তার স্ত্রী সহ বসবাস করতেন। কিন্তু ডগলাসের স্ত্রী ক্রিস্টিনা ফাতিমার নতুন বিশ্বাসকে সহ্য করতে পারতেন না এবং সে ফাতিমার জীবনযাপনকে কষ্টের মধ্যে ফেলে দেয়।

এর পরও ফাতিমা সবকিছুকে সামাল দেয় ধৈর্য্যের সাথে। তিনি তার বিশ্বাসের চর্চা থেকে এক চুলও নড়েননি এবং ক্রিস্টিনার আচরণের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রতিউত্তর করেননি।

ক্রিস্টিনার বৈরী মনোভাবের কারণে ফাতিমা তার ভাইয়ের বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হন এবং প্রতিবেশী মুসলিম বোন নাদিয়ার বাসায় গিয়ে উঠেন। ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার পর পরই ফাতিমা দুইটি শিশুকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, যাদেরকে তাদের মা পরিত্যক্ত অবস্থায়ে ফেলে রেখে যান।

শিশুগুলোর পিতা ফাতিমা এবং নাদিয়ার এরকম দয়াশীলতা দেখে মুগ্ধ হয়ে যান এবং ইসলামের বিশ্বাসের প্রতি ঝুঁকে পড়েন আর কিছুদিন পরেই শিশুগুলোসহ ইসলাম গ্রহণ করেন।

মৃত্যুর দূত

কয়েক মাস পরেই একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ফাতিমাকে আরেকটি প্রতিবন্ধকতার মুখে ঠেলে দেয়। ১৯৯৬ সালে ক্রিস্টিনার তরুণ ছেলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং একটি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মারা যায়। ফাতিমা মহানুভবতার সহিত তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য যায়।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরপরেই যখন ক্রিস্টিনার সকল বন্ধুবান্ধব তাকে ফেলে রেখে চলে যায় ফাতিমা সন্তান হারা মায়ের পাশে থাকেন এবং তাকে শোক কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেন। ফাতিমার এরকম মহানুভবতার পরিচয় পেয়ে ক্রিস্টিনার হৃদয় বিগলিত হয় এবং সে ফতিমার নিকট বন্ধুতে পরিণত হন।

সে ফাতিমাকে তার সাথে মাদরাসায় নিয়ে যেতে অনুরোধ করে যেখানে সপ্তাহান্তে তারা ইসলামের খুঁটিনাটি সম্পর্কে শিখতে থাকেন। মাদরাসায় তিন দিন যাওয়ার পরেই ক্রিস্টিনা চূড়ান্তভাবেই ইসলামে ঝুঁকে পড়েন।এবং এভাবেই মৃত্যুর দূতের ভ্রমণের পর ফাতিমা ক্রিস্টিনার নিকটবর্তী হন। এই দূত তার অনেক নিকটবর্তী আত্নীয় স্বজন, তার সকল ভাইবোন, তার পিতামাতা, তার স্বামী এবং তার প্রিয় ভাই ডগলাস যে ২০০৬ সালে একটি ডাকতির ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তথা সকলের প্রাণ কেড়ে নিয়ে যায়।

ফাতিমা শোকাহত কিন্তু সে এ ব্যাপারে খুশি যে তার ভাই ডগলাস ইসলাম গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছিল এবং সে তার এই ইচ্ছার জন্য পুরস্কার পাবে।

চূড়ান্ত ভ্রমণ

হজের অঙ্গিকার করার আনন্দ সম্পর্কে ফাতিমা ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন নি। চলতি বছরের এপ্রিলে শুভ সংবাদটি তার কাছে পৌঁছার আগ পর্যন্ত সিদ্ধান্তের ঘোষণাকে ‘তার হৃদয় কখনো বিশ্বাস করতে পারত না’ বলে জানান। অভিবাবক সুলভ শিক্ষিকা ইয়াসমিনের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য দিকনির্দেশনাকে ফাতিমার নিকট খুব আনন্দ দায়ক বলে মনে হয়।

মেহরুন বাহনা সামনের দিকনির্দেশনা এবং শারীরিক ও বিষয়বস্তুগত দিকগুলোর বিষয়ে যত্ন নিচ্ছেন। উপহারের হজ কমিটি তার এই হজের সাধারণ ব্যয় বহন করছে। ফাতিমা খুবই আনন্দিত, কিন্তু সে চান তার সমাজের যাদের সাহায্য এখনো দরকার তাদেরকে সাহায্য করার জন্য সে সেবা-শুশ্রুসাকারী হিসাবে থাকতে।

তার মূল ভ্রমণে একজন আত্মকেন্দ্রিক মহিলা হিসাবে, ধৈর্যশীল মুসলিম হিসাবে ফাতিমা অনেক মানুষেরই জীবনকে স্পর্শ করেছে। তাদের মধ্যে মোট ১৫জন নিজেদেরকে ইসলামের ছায়াতলে আনার ব্যাপারে তার সাথে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হয়েছে যার মধ্যে তার নিজের সন্তান এবং প্রতিবেশীরা রয়েছেন।

মেহরুন বাহনা বলেন, ‘ইসলামের চর্চা নিজের ঘর থেকেই শুরু হয়’। ফাতিমা উত্তর দেন, ‘আল্লাহ হচ্ছেন ভালোবাসার, সুতারাং আমাকে অবশ্যই ভালোবাসতে চেষ্টা করতে হবে।’

এই দুইজন মহিলা দেয়া-নেয়ার চক্র পূর্ণ করেছেন।

কিন্তু ফাতিমার চক্র এখনো একেবারে পূর্ণ হয়নি। কখন এবং কিভাবে তা পূর্ণ হবে সে সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন। এবাউট ইসলাম

captcha