IQNA

ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.)’র নেয়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ

12:01 - June 21, 2019
সংবাদ: 2608764
ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.) তার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেন।

পার্সটুডের উদ্ধৃতি দিয়ে বার্তা সংস্থা ইকনা'র রিপোর্ট: ইসলামের অন্যতম মৌলিক দিক হলো সাধারণ মানুষের সঙ্গে ইমামের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক থাকবে এবং গণমানুষ তাদের জীবন পরিচালনার জন্য ইমামকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবে। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসকরা এ বিষয়টিকে সহজে মেনে নিতে পারেনি। তারা ইমামের সঙ্গে জনতার এই সম্পর্ক ছিন্ন করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। একবার স্বৈরাচারী উমাইয়া শাসক হিশাম বিন আব্দুলমালেক দেখতে পায়, ইরাকের একদল লোক ইমাম বাকের (আ.)কে ঘিরে ধরে তাঁর বক্তব্য শুনছে এবং নানা ধরনের প্রশ্নের উত্তর জেনে নিচ্ছে। হিশাম ইমামকে ভালোভাবে চেনা সত্ত্বেও নিজের একজন সহচরকে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করে। এ সময় ইমামকে ঘিরে থাকা এক সাহসী ব্যক্তি জবাব দেয়: উনি হলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)’র বংশধর, বাকেরুল উলুম এবং মুফাসসিরে কুরআন ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.)।

মানুষের সঙ্গে ইমামের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ব্যাপারে হিশামের এই স্পর্শকাতরতা সত্ত্বেও ইমাম বাকের (আ.) মুসলমান ও শিয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেননি বরং উল্টো ইসলাম বিরোধীদের সামনে ইসলামের সুমহান শিক্ষা তুলে ধরার লক্ষ্যে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও বিতর্কে বসেন। একদিন ইমাম রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একটি স্থানে একদল লোককে জটলা পাকাতে দেখেন। তিনি একজনের কাছে জিজ্ঞাসা করেন, ওরা কারা? একজন জবাব দিল, এরা হচ্ছে খ্রিষ্টান পাদ্রী। তারা তাদের প্রধান পাদ্রী বা বিশপের অপেক্ষা করছে। তিনি এসে তাদের বিভিন্ন সমস্যা ও ধর্মীয় প্রশ্নের জবাব দেবেন। একথা শোনার পর ইমাম মোহাম্মাদ বাকের (আ.) একজন অপরিচিত ব্যক্তি হিসেবে পাদ্রীদের মধ্যে বসে যান।

গুপ্তচররা এই খবর হিশামের দরবারে পৌঁছে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে উমাইয়া শাসক হিশাম একদল লোক পাঠিয়ে দেয় এটা দেখার জন্য যে, ইমাম খ্রিস্টানদের জমায়েতে বসে কি করেন। কিছুক্ষণের মধ্যে বিশপ এসে সেখানকার প্রধান আসন গ্রহণ করেন। তিনি সামনে তাকিয়ে সবাইকে ভালো করে দেখে নেন। এক পর্যায়ে ইমাম মোহাম্মাদ বাকেরের চেহারা মোবারকের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তার ভালো লেগে যায়। তিনি জিজ্ঞাসা করেন: আপনি কি খ্রিস্টান নাকি মুসলমান? ইমাম জবাব দেন: আমি মুসলমান। বিশপ আবার জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কি আলেম নাকি অজ্ঞ ব্যক্তি? ইমাম জবাব দেন: আমি অজ্ঞ নই।

বিশপ জিজ্ঞাসা করেন: আমি আগে প্রশ্ন করব নাকি আপনি কিছু জিজ্ঞাসা করবেন? ইমাম বলেন: আপনার ইচ্ছা হলে আগে প্রশ্ন করতে পারেন। এ সময় বিশপ অনেক কঠিন ও জটিল প্রশ্ন উত্থাপন করা সত্ত্বেও ইমাম সবগুলো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে উপস্থিত লোকজনকে অভিভূত করেন। এ সময় বিশপ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে পাদ্রীদের বলেন: তোমরা আমার চেয়ে অনেক বড় জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিকে এখানে এনেছো কেন? তিনি তো আমার অজ্ঞতা সবার সামনে প্রকাশ করে দিলেন। মুসলমানরা এখন আমাদের নিয়ে ঠাট্টা করবে এই কথা বলে যে, খ্রিস্টানদের বিশপ কোনো জ্ঞানই রাখে না!

বিশপের সঙ্গে ইমাম মোহাম্মাদ বাকেরের এই বিতর্কের কাহিনী অতি দ্রুত দামেস্কে পৌঁছে যায় এবং সেখানকার সাধারণ মানুষ বিষয়টি নিয়ে গর্ব করতে থাকে। কিন্তু উমাইয়া শাসক হিশাম খুশি হওয়ার পরিবর্তে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়। জনগণের মধ্যে ইমামের আধ্যাত্মিক প্রভাবে বেড়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় সে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। উমাইয়া শাসক ইমামকে শাম থেকে মদিনায় চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। এরপর হিশাম কপটতার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে মদীনার গভর্নরকে চিঠি লিখে জানায়: “আবু তোরাবের ছেলে মোহাম্মাদ বিন আলী তার ছেলেসহ আমার কাছে এসেছিল। আমার নির্দেশে মদীনায় যাওয়ার আগে সে পাদ্রীদের কাছে যায় এবং খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু আমার সঙ্গে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকায় তার এই অপরাধ আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। সে মদীনায় পৌঁছার আগে জনগণের মধ্যে এই ঘোষণা দিয়ে যাও যে, আমি তার প্রতি অসন্তুষ্ট।”

ইমাম মোহাম্মাদ বাকের উমাইয়া শাসকের এই প্রতারণা জানতে পেরে শাসনযন্ত্রের সব ধরনের ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে জনগণকে সঠিক কথা বোঝানোর চেষ্টা করেন। তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন: হে জনগণ! উমাইয়া শাসকেরা তোমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? তোমাদের পূর্বপুরুষরা আমার পূর্বপুরুষদের মাধ্যমে সঠিক পথের দিশা পেয়েছিল এবং এখন তোমরাও যদি দুনিয়া ও আখেরাতে সৌভাগ্যের অধিকারি হতে চাও তাহলে আমার সঙ্গে যোগ দাও। দুনিয়ার চাকচিক্য ও ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী কিন্তু পরকালীন জীবন চিরস্থায়ী।

ইমামের এই সচেতনামূলক বক্তব্যে সাধারণ মানুষের টনক নড়ে এবং তারা আস্তে আস্তে তাঁর কাছে জড়ো হতে থাকে। তারা ধর্মীয় বিষয়াদির পাশাপাশি পার্থিব জীবন সুন্দর করার উপায় শিখে নেয় ইমামের কাছ থেকে। ইমামের অনুসারীরা একটি বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও আহলে বাইতের অনুসরণ না করলে পরকালীন জীবনে মুক্তি লাভ করা সম্ভব নয়। ইমাম বাকের (আ.) দ্বীনের এই জরুরি শিক্ষাগুলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য হজ্বের সময়কে বেছে নেন। প্রতি বছর হজ্বের সময় বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে কাবা শরীফে জড়ো হন হাজার হাজার মানুষ।

এ সম্পর্কে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় এসেছে: মক্কায় এক ব্যক্তিকে দেখি কাবা ও হাজরে আসওয়াদের মাঝখানে একটি উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন এবং অনেক মানুষ তাঁকে ঘিরে ধরেছে। সমবেত লোকজন অনেক কঠিন ও জটিল প্রশ্নের উত্তর ওই ব্যক্তির কাছ থেকে জেনে নিচ্ছে। এরপর তিনি যখন চলে যাচ্ছিলেন তখন অনেকে জিজ্ঞাসা করেন, উনি কে ছিলেন? তখন একজন জবাব দেন: তিনি হলেন ইমাম বাকের (আ.)। এভাবে আহলে বাইতের পঞ্চম ইমাম জনগণের মধ্যে ইমামতের উচ্চ মর্যাদা তুলে ধরতে সক্ষম হন। সেইসঙ্গে উমাইয়া শাসকরা ইমামদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব তৈরির যে চেষ্টা করেছিল সে দূরত্বও অনেকাংশে কমিয়ে আনেন।

captcha