IQNA

ইরানে ইসলামি বিপ্লবের ৪১ বছর; মার্কিন ষড়যন্ত্রের নানা দিক: পর্ব-এক

23:57 - February 15, 2020
সংবাদ: 2610237
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর গত ৪১ বছর ধরে আমেরিকা বিভিন্ন উপায়ে ইরানের বিরুদ্ধে শত্রুতা করে আসছে।

বার্তা সংস্থা ইকনা'র রিপোর্ট: এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ইরানের ইসলামি সরকার ও জনগণের বিরুদ্ধে আমেরিকার শত্রুতা শুধু ৪১ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই বরং এ শত্রুতার ইতিহাস গত ৬৬ বছর ধরে যা শুরু হয়েছিল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইরানের নির্বাচিত একটি বৈধ সরকারকে উৎখাতের মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করা যায়। ১৯৫৩ সালে ১৯ আগস্ট ইরানে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান, একই বছরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর পরিচালিত হত্যাকাণ্ড, এরপর বিপ্লবীদের দমনের জন্য 'সাভাক' নামে কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা গঠন, ক্যাপিচুলেশন আইন চাপিয়ে দেয়া যেখানে ইরানে অপরাধী মার্কিন সেনাদের বিচার করা যাবে না যা ছিল ইরানিদের জন্য খুবই অবমাননাকর, তেহরানে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসকে গোয়েন্দাবৃত্তির আখড়ায় পরিণত করা, আমেরিকায় ইরানের সম্পদ জব্দ করা, ইরাকে আটক মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধারের জন্য তাবাসে মার্কিন ব্যর্থ সামরিক অভিযান, ইসলামি বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র সৃষ্টি করা, সাদ্দামকে দিয়ে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া, ইরানে সামরিক আগ্রাসন ও তেল স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দেয়ার কথা উল্লেখ করা যায়।

এ ছাড়া, ১৯৮৮ সালে ইরানের যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করা, ইরান বিরোধী সন্ত্রাসী মেনাফেকিন গোষ্ঠীকে সমর্থন দেয়া ও ইরানে ১৭ হাজার সাধারণ মানুষকে হত্যা করা, অন্যায় নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়া, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ইরান ও ইসলাম বিরোধী চলচ্চিত্র নির্মাণ, ইরানের ভেতরে সরকার বিরোধী গোলযোগে উস্কানি দেয়া, বিজ্ঞানীদের হত্যা করা, পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে যাওয়া, ইরানে বন্যা কবলিতদের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য আসতে বাধা দেয়া, সর্বোচ্চ নেতা থেকে শুরু করে বহু শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা এবং সর্বশেষ জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়।

ইসলামি বিপ্লবের পর গত ৪১ বছরে ইরানের সরকার ও জনগণের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকারের নানা পদক্ষেপকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ও এক নম্বর কৌশল হিসেবে আমেরিকা ইরানের ওপর প্রবল অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির পথ বেঁছে নিয়েছে। তেহরানে গুপ্তচরবৃত্তির আখড়া হিসেবে পরিচিত মার্কিন দূতাবাস দখলের পর এরই অংশ হিসেবে আমেরিকায় অবস্থিত ইরানের সব সম্পদ ও অর্থ জব্দ করে দেশটির সরকার। কার্টারের নির্দেশে সে সময় ইরান সরকারের এক হাজার ২০০ কোটি ডলার আটকে দেয়া হয়। এমনকি ইরানের হাতে আটক মার্কিন কূটনীতিকরা মুক্ত হওয়ার পরও আটক ইরানি অর্থ-সম্পদ তারা এখনো ফেরত দেয়নি।

ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির দ্বিতীয় দিকটি হচ্ছে সব ক্ষেত্রে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ। আমেরিকা ১৯৮০ সালের ১৩ জানুয়ারি ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব তুলে ধরেছিল। কিন্তু সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দেয়। এরফলে আমেরিকা একতরফাভাবে ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পদক্ষেপ নেয় এবং ইরান থেকে পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করে। এ ছাড়া, বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আমেরিকা।

চার দশক পরও ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এখনো অব্যাহত রয়েছে এবং এ প্রক্রিয়াকে আরো তীব্রতর করা হয়েছে। ইরাকের সঙ্গে ইরানের যুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিগ্যান ইরানের কাছে যাতে কেউ অস্ত্র বিক্রি করতে না পারে সেজন্য ব্যাপক চেষ্টা চালিয়েছিলেন যাতে যুদ্ধে ইরানকে পরাজিত করা যায়।

এরপর ১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন সরকার লেবাননে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে বোমা পেতে রাখার জন্য অভিযুক্ত করে ইরানকে সন্ত্রাসীদের প্রতি সমর্থনদানকারীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে এবং ইরানের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা দেয়। এমনকি বেসামরিক কাজে ব্যবহৃত পণ্যসামগ্রীও যাতে ইরান আমদানি করতে না পারে সেজন্য বিশ্ব ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সুযোগও বন্ধ করে দেয়া হয়।

ইরাক-ইরান যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমেরিকা পশ্চিম এশিয়ায় তাদের আধিপত্যকামী লক্ষ্য বাস্তবায়ন এবং ইরানের প্রভাব ধ্বংস করার জন্য ১৯৯৩ সালে ইরানের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন ১৯৯৫ সালের ৬ মে এক নির্দেশে ইরানে পুঁজি বিনিয়োগ কিংবা দেশটির সঙ্গে প্রায় সমস্ত ব্যবসায়ীক লেনদেন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

এরপর বিল ক্লিন্টন ২০ সেপ্টেম্বর ডামাটো আইন পাশ করেন যেখানে প্রেসিডেন্টকে এ ক্ষমতা দেয়া হয় যাতে অন্য কোনো দেশও যদি ইরানের কাছে শিল্প-প্রযুক্তি সরবরাহ করে তাহলে সেইসব দেশ বা কোম্পানির বিরুদ্ধেও তিনি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবেন। ১৯৯৬ সালে মার্কিন কংগ্রেসে আরো একটি আইন পাশ করা হয় যেখানে ঘোষণা দেয়া হয় ইরানের তেল ও গ্যাস খাতে যদি কোনো দেশ বা কোম্পানি চার কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। ওই আইনের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর যা কিনা ২০০১ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের শাসনামলে ফের নবায়ন করা হয় এবং ইরানে বিদেশি বিনিয়োগ চার কোটি ডলারের পরিবর্তে দুই কোটি ডলারে নামিয়ে আনা হয়। এরপর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে ফের ওই আইন দশ বছরের জন্য নবায়ন করা হয়।

ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কোনো শর্ত ছাড়াই তিনি ইরানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই তিনি ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেন। ২০১০ সালের জুনে মার্কিন কংগ্রেসে 'সিসাদা' (সিআইএসএডিএ) আইন পাশ করে যার লক্ষ্য ইরানের ওপর কঠোর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা। এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় ইরান থেকে কার্পেট, পেস্তা ও ক্যাভিয়ার আনার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ সংক্রান্ত বিলে সই করেন। এ ছাড়া, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি প্রতিহত করার জন্য ওবামা প্রশাসন ইরানের আরো ৫০ কোম্পানি ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

ওবামার শাসনামলে ছয় জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে ইরানের পরমাণু সমঝোতার পর বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছু মিথ্যা অজুহাত তুলে পরমাণু সমঝোতা থেকে সরে গিয়ে ইরানের বিরুদ্ধ নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ইরানের সামরিক শক্তিকে দুর্বল করা এবং এ অঞ্চলে ইরানের প্রভাব নষ্ট করা ট্রাম্পের মূল লক্ষ্য।
সূত্র: parstoday

captcha