আর গ্রামের বাড়িগুলো থেকে লোকজন বের হয়ে ভ্যানে সাজানো বিভিন্ন ঝুড়িতে বিভিন্ন শস্য ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে। কোনো ঝুড়িতে চাল, কোনোটায় আলু, কোনোটায় ডাল। আমি যখন ভ্যানটা অতিক্রম করে এগোচ্ছি তখন পাশের বাড়ির এক মহিলা এসে একটি বালতিতে কেজি দুই-আড়াই আলু ভ্যানে রক্ষিত আলুর ঝুড়িটায় ফেলে দিল। আমার মনে হচ্ছিলো ইমাম হোসেনের শাহাদাৎ বা মৃত্যুবরণ বিষয়ক কোনো জলসা-মাহফিল হবে, সেই লক্ষ্যে হয়তো চাদা তোলা হচ্ছে। আমার অনুমানটা ঠিক আছে কি না একটু পরখ করে নিতে আমার পাশ ধরেই এগিয়ে চলা একটি স্কুল ড্রেস পরা মেয়ের কাছে জানতে চাইলাম- এই ব্যাপারটা কী। মেয়েটি বললো লোক দুটো ভিক্ষে করছে। দুজনই ভিক্ষুক বা ফকির। আমি জানতে চাইলাম তারা কেন ইমাম হোসেনের কাহিনি বলছে। মেয়েটি উত্তর দিলো ঐ কাহিনি শুনিয়ে লোকজনের দয়া-মমতা জাগাতে সুবিধে হয়। উত্তর শুনে আমার বার্টোল্ট ব্রেশটের নাটক ‘থ্রি পেনি অপেরা’র কথা মনে পড়লো, তবে তা মেয়েটিকে আমি বলতে গেলাম না। সাথে মনে হলো, ইস্, আমাদের ভিক্ষুকরা যদি জানতো যে ইমাম হোসেনের কারবালার কাহিনি বলে এত সহজে কেজিতে কেজিতে ভিক্ষার দ্রব্য পাওয়া যায় তাহলে হয়তো আমাদের দেশে ভিক্ষুকদেরকে আদি ও সহী কারবালানামা সাপ্লাই দিতে কবিদের মধ্যে লড়াই পড়ে যেতো। এই মনের কথাটাও মেয়েটিকে আমি জানাতে গেলাম না। বরং, মেয়েটির সাবলীল উত্তরে আরো উৎসাহী হয়ে জানতে চাইলাম ‘তিতুমীর কে ছিলেন তুমি কি জানো?’ কোনো চিন্তাভাবনা না করেই মেয়েটি উত্তর দিলো- ‘কোনো বড় মোবাল্লেগ-টোবাল্লেগ হবে হয় তো।’ জিগ্যেস করলাম- ‘বইয়ে এমন লেখা আছে?’ বললো- ‘বইয়ে তো তিতুমীর পাইনি কোথাও।’ ‘কোন ক্লাসে পড়?’ ‘ক্লাস এইটে।’ ‘তুমি আমাকে তিতুমীরের মাজার দেখিয়ে দিতে পারবে?’ ‘ঐতো’ বলে একটা দেয়াল-ঘেরা স্থান ও তার এক কোণে নির্মীয়মান একটি ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে মেয়েটি বাম দিকের রাস্তায় তার বাড়ির দিকে চলে গেল। তাহলে কি মেয়েটিও জানে না যে তিতুমীরের কবর নেই?
তিতুমীরকে মেয়েটি মোবাল্লেগ কেন মনে করলো এটি একটি খটকা আকারে আমার ভিতরে রয়ে গেল। সেই খটকা ভিতরে নিয়েই সেই বেষ্টনীর দিকে আগালাম। ভিতরে ঢোকার আগেই বাইরে এক কোণে নির্মীয়মান প্রকোষ্ঠটির গায়ে প্যানাফ্লেক্সের একটা বড় ব্যানার লটকানো দেখলাম। ব্যানারটিতে লিখিত ছিল যে, শহীদ তিতুমীরের জন্মমাস উপলক্ষে ২২ এপ্রিল ২০১৭ তারিখ বিকাল ৩ টায় তিতুমীরে জন্মভিটায় একটি মিলন অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে। এর পরের দিন ২৩ এপ্রিল একটি স্মরণ কাফেলা সকাল দশটায় তিতুমীরের জন্মভিটা থেকে যাত্রা করে নারিকেলবেড়িয়ার বাঁশের কেল্লায় এসে পরিক্রমা সম্পন্ন করবে। ব্যানারটির উপরে এর আয়োজক সংগঠনের নাম লিখা ছিল ‘শহীদ তিতুমীর মিশন’। সংগঠনের নামের পাশে মূল বাঁশের কেল্লার একটি আলোকচিত্র বা কল্পচিত্র অনেকটা সংগঠনের লোগো আকারে মুদ্রিত। দেখে ভালো লাগলো। ছবি তুললাম। খেয়াল করলাম আমরা বাংলাদেশে গ্রামটির নাম ‘নারিকেলবাড়িয়া’বললেও মূলত এর নাম ‘নারিকেলবেড়িয়া’। আমরা নারিকেলবাড়িয়া বলি হয়তো শব্দটিকে ‘বাড়ি’র (Home of coconut trees) সাথে সংশ্লিষ্ট ভেবে। আর ওখানকার মানুষেরা শব্দটিকে ‘নারিকেলবেড়িয়া’বলে হয়তো ‘বেড়’ বা ‘বেষ্টনী’র (Enclosure of coconut trees) সাথে সংশ্লিষ্ট করতে। পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলতে চাচ্ছি যে, বর্ণনার এই মুহূর্তে যেহেতু গ্রামটির শুদ্ধ নামটি জানা হলো সেহেতু বর্ণনার পরবর্তী অংশে আমরাও নামটি ‘নারিকেলবেড়িয়া’ রূপেই লিখবো।
তিতুমীরের ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লার চত্বর, যেখানে বর্তমানে শাবিয়ে কারবালা অবস্থিত
যাই হোক, এই ব্যানারের ছবি তুলে বেষ্টনীর ভিতরে ঢুকলাম। ভিতরে ঢুকে দেখি এক তলা একটা মসজিদের মতো ভবন এবং সাথে একটি মাজার। ভাবলাম- ‘ইউরেকা’। এটাই তাহলে তিতুমীরের মাজার। সেই ‘ইউরোকা’-জাত পুলকের সাথে গিলাফে ঢাকা মাজারের অনেক ছবি তুললাম। ছবি তুলতে তুলতে উত্তরপাশে এসে দেখলাম মাজারের মাথার দিকের গাত্রে একটি বড় পাথরের মাঝখানে লেখা রয়েছে- ‘এই পাথরটি ইরাকের হজরত আব্বাছ আলমদারের রওজার পাথর’। একটু খটকা লাগলো। তিতুমীরের মাজারের গায়ে ইরাকের এই পাথর কেন থাকবে? বের হয়ে মূল ভবনের সামনে গিয়ে এই খটকাটা একটু কাটলো। ভবনের গায়ে মূল দরজার ঊর্ধাংশে লিখিত রয়েছে:
৭৮৬
শহীদ সম্রাট হজরত এমাম হোসায়েন (আঃ) ও ৭২ শহীদ স্বরণে
* ৭২ শহীদ কারবালা * ৬১ হিজরী
গ্রাম- নারিকেলবেড়িয়া, পো- বুরুজ, থানা- বাদুড়িয়া, উঃ২৪পরগনা
ভবনের গায়ে সাইনবোর্ডসদৃশ এই লেখা দেখে বুঝলাম এটি তিতুমীরের মাজার নয়, এটি কারবালার স্মারক কোনো প্রতিষ্ঠান। তাহলে এখানে তিতুমীরের কী আছে? কিছুই না? এক কোণে একটি দোকান ঘরের মতো কুঠুরি নির্মীয়মান দেখা যাচ্ছে, যেটির দেয়ালে প্যানাফ্লেক্সের ব্যানার ছিল বলে আগেই উল্লেখ করেছি। ওটাও হয়তো এই ‘৭২ শহীদ কারবালা’লিখিত ভবন যে-কাজে ব্যবহৃত হয় তার ওয়েটিং রুম বা এ জাতীয় কিছু হবে। মনে পড়লো আগের দিন ড. আমজাদ হোসেন বলেছিলেন ওখানে তো তিতুমীরের কিছু নেই, শুধু মহররমের সময় ওখান থেকে তাজিয়া মিছিল নামে আর কিছু মানুষ মাঝে মাঝে গিয়ে পিকনিক করে। কিন্তু এটি কেমন কথা? এখানেই তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ছিল অথচ এখন তার স্মৃতির কিছুই এখানে নেই। এটা কীভাবে সম্ভব?
এক খটকা নিয়ে ঢুকেছিলাম। এবার নতুন অনেক খটকা নিয়ে বের হলাম। বের হয়ে দেখলাম পূর্ব পাশে একটা টিউবওয়েল চেপে একজন লোক গোসল করছে। লোকটি তার নাম বললো আব্দুল কাদের। তাকে জিগ্যেস করলাম– ‘এখানে তিতুমীরের স্মৃতির কিছু নেই?’ সে জানালো যে একটা ছোট ফলকের মতো নির্মাণ ছিল। সেটি ভেঙে ঠিক সেই জায়গার ওপরেই এই কুঠুরিটা নির্মিত হচ্ছে। এই কুঠুরিটায় নাকি তিতুমীর বিষয়কই কিছু একটা হবে। বুঝলাম- এখানে তিতুমীরের স্মৃতিরক্ষায় কিছু ছিল না তা নয়, তবে যা ছিল তার চেয়ে ভালো কিছু হবে সেই স্বার্থে এখন কিছু নেই। আরো বুঝলাম যে এই নির্মীয়মান কুঠুরিটি বেষ্টনীর ভেতরের ‘৭২ শহীদ কারবালা’ নামক ভবনের সাথে সম্পর্কিত নয়। কল্পনায় দেখতে শুরু করলাম পাঁচ ইঞ্চি দেয়ালে নির্মীয়মান কুঠুরিটা আরো বড় হবে- আরো উঁচু হবে- বাঁশের কেল্লার আদল পাবে। এই স্বপ্ন-ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ঐ কুঠুরিটারই কয়েকটা ছবি তুললাম। (চলবে)....
সূত্র: banglatribune.