IQNA

সৌদি আরবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন ও বিদেশি শ্রমিকদের অবস্থা: (পর্ব-৪)

0:03 - April 19, 2021
সংবাদ: 2612639
তেহরান (ইকনা): ওপরে জুলুম নির্যাতন ও তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বেশ কিছু চিত্র তুলে ধরেছিলাম। আমরা বলেছিলাম সৌদি আরবে সংখ্যালঘু শিয়া মুসলমানদের মসজিদ নির্মাণ কিংবা তাদের কোনো ধর্মীয় স্থাপনা সংস্কারের ওপর কঠোরভাবে সীমাবদ্ধতা আরোপ করে রাখা হয়েছে। এমনকি শিয়া মুসলমানরা কোনো ভবন নির্মাণ করতে গেলেও বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।

সৌদি আরবে শিয়া মুসলমানদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ ও তাদের ধর্ম চর্চার অধিকার হরণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সেদেশের শাসকবর্গ ও ধর্মীয় নেতারা শিয়াদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মনে করে। সৌদি আরবে শিয়া মুসলমানদের নিজস্ব ধর্মীয় বা মাজহাব বিষয়ক লিখিত কোনো তথ্য প্রমাণ সংরক্ষণের অনুমতি নেই। এ সংক্রান্ত কোনো গ্রন্থ, তথ্য বা লেখা অন্য দেশ থেকে সৌদি আরবে নেয়ার চেষ্টা করা হলে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়।

নিউইয়র্ক ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০১৭ সালে এক প্রতিবেদনে বলেছিল, সৌদি আরবের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশ হচ্ছে শিয়া মুসলিম সম্প্রদায়। তারা সৌদি শাসকবর্গের পক্ষ থেকে চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ৬২ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, 'সৌদি আরবের অনেক মুফতি ও সরকারি কর্মকর্তারা শিয়াসহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও উস্কানিমূলক কথাবার্তা ছড়ানোর পাশাপাশি তাদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে যা কিনা মানুষের ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি সম্মান দেখানো বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশনের লঙ্ঘন।

বাস্তবতা হচ্ছে সৌদি আরবে সংখ্যালঘু শিয়া মুসলমানদের সাথে যে আচরণ করা হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক সকল রীতিনীতির লঙ্ঘন। ইসলামের দৃষ্টিতেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে, বিচারের স্বাধীনতা রয়েছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিবাহ ও আবাসনের স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু সৌদি আরবে শিয়া মুসলমানরা সেদেশের মুসলিম সমাজের অংশ হলেও বহু ক্ষেত্রে তারা অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর পাশাপাশি সৌদি আরবে অবস্থিত অন্য ধর্মের অনুসারী ও বিদেশী শ্রমিকরাও নানাভাবে হয়রানি ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। অ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি নিরাপত্তা বাহিনী ইথিওপিয়ার অন্তত ৩৫ খ্রিস্টানকে আটক করেছে যাদের মধ্যে ২৯জনই হচ্ছে নারী। নিজস্ব পদ্ধতিতে নামাজ বা ধর্মচর্চার সময় তাদেরকে আটক করা হয়। তাদেরকে আটক করার পর পুরুষদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়।

সৌদি আরবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে সেদেশের সরকারের দুর্ব্যবহার শুধু যে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন তাই নয় একইসঙ্গে ইসলামের নীতিমালাও লঙ্ঘন। বাস্তবতা হচ্ছে, শীতল যুদ্ধ অবসানের পর বিভিন্ন দেশে অবস্থিত সংখ্যালঘুদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু বিষয়ে তাদের অধিকার এবং সুযোগ সুবিধা দেয়ার দাবি ওঠে। কিন্তু সেসব দাবির ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আপত্তি থাকায় অভ্যন্তরীণ জাতিগত শত্রুতা ও বিদ্বেষ ক্রমেই বাড়তে থাকে। এর ফলে আন্তর্জাতিক সমাজ বিশেষ করে যেসব দেশ সংখ্যালঘু মানুষের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদেরকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী প্রতিটি দেশে সংখ্যালঘু মানুষদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সৌদি আরব এসব নীতি নৈতিকতার ধার ধারছে না।

সৌদি আরবে বসবাসকারী সংখ্যালঘু শিয়া মুসলিম সম্প্রদায় রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মীয় ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। শুধু যে ধর্মীয় ক্ষেত্রেই তারা বঞ্চনার শিকার হচ্ছে তাই নয় এমনকি শিয়াদেরকে মুসলমান হিসাবেও স্বীকৃতি দিতে চায় না সৌদি কর্তৃপক্ষ। ১৯২৭ সালে সৌদি আরবের শীর্ষ ওয়াহাবি মাওলানারা এক ফতোয়া জারি করে বলেছিলেন, 'শিয়ারা ধর্ম থেকে বিচ্যুত এবং তারা কাফের। সুতরাং তাদেরকে শাস্তি পেতে হবে।' তারা আরো বলেছিলেন, 'শিয়াদের নিজস্ব মাজহাব অনুযায়ী ধর্ম পালনের কোনো অধিকার নেই। এর অন্যথায় তাদেরকে এ দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে।' বর্তমানের সৌদি শাসকগোষ্ঠী ও ওয়াহাবি মওলানারা এখনো ওই ফতোয়া অনুসর করে চলেন। ১৯৯১ সালে সৌদি মুফতি বিন জাবরিন তার এক ফতোয়ায় আবারো শিয়া মুসলমানদেরকে কাফের বলে ফতোয়া দেন। এসব কারণে সৌদি সরকার সংখ্যালঘু শিয়া মুসলমানদের মসজিদ কিংবা ইমামবাড়া নির্মাণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে।

কেবলমাত্র সাফওয়া এলাকার অধিকাংশ মানুষ শিয়া হওয়ার কারণে সেখানে মাত্র তিন থেকে চারটি ইমামবাড়ার কার্যক্রমের অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং সেখানে নতুন আর কোনো ইমামবাড়া তৈরি অনুমতি নেই। এ ছাড়া, ১৯৯০ সালে সৌদি কর্মকর্তারা শিয়াদের ধর্মতত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'আল মোবারেযে'র অনেক আলেমকে গ্রেফতার করে।

সৌদি সরকার সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন চালাচ্ছে পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার অধিবাসীদের ওপর। ওই এলাকার জনগোষ্ঠীর মাত্র ১৫ থেকে ১০ শতাংশ হচ্ছে শিয়া মুসলিম জনগোষ্ঠী। এরাই সরকারের সবচেয়ে বড় টার্গেট এবং দীর্ঘদিন ধরে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সৌদি নিরাপত্তা বাহিনী সম্প্রতি শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার বহু ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছে এবং অন্তত ৩৪জন তরুণ ও ধর্মীয় নেতাকে ধরে নিয়ে গেছে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতেও নিরাপত্তা বাহিনী ওই এলাকার জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও দমনপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।

সৌদি আরবের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে সেদেশের শাসকগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনা ও রাষ্ট্র পরিচালনার নীতির কোনো সঙ্গতি নেই। সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় জনগণের অংশগ্রহণেরও কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু সেখানে গণতন্ত্র নেই তাই শাসক বা সরকার নির্বাচনের অধিকারও জনগণের নেই। সম্পদে প্রাচুর্য সৌদি রাজ পরিবারের সদস্যরা অত্যন্ত আরাম-আয়েশি জীবন যাপন করলেও সেদেশটির জনগণের একটা বিরাট অংশ দরিদ্র, বেকার এবং বৈষম্যের শিকার। সামাজিক ব্যবধান বাড়তে থাকায় জনমনে সরকার বিরোধী প্রতিবাদ, ক্ষোভ ও সমালোচনা বাড়ছে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সৌদি নাগরিকদের বিরুদ্ধে শাসকবর্গের জুলুম নির্যাতনের ব্যাপারে একদিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ নীরব রয়েছে অন্যদিকে বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকারের দাবিদার বৃহৎ শক্তিগুলোও টু শব্দটিও করছে না। পার্সটুডে

captcha