IQNA

ইমাম হুসাইনের (আ) চিরঞ্জীব মহাবিপ্লব-৮

ইমাম হুসাইনের (আ.) রক্তের কাছে নবীজীর (সা.) উম্মত ঋণী

20:53 - August 06, 2022
সংবাদ: 3472245
তেহরান (ইকনা): শোকাবহ মহররম উপলক্ষে ইমাম হুসাইনের (আ) চিরঞ্জীব মহাবিপ্লব শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার অষ্টম পর্ব তথা তাসুয়া পর্ব থেকে সবাইকে জানাচ্ছি সংগ্রামী সালাম ও গভীর শোক আর সমবেদনা।
আজ মহান তাসুয়া বা আশুরার পূর্ব দিন। প্রায় ১৩৮৩ বছর আগে এই দিনে অর্থাৎ ৬১ হিজরির নয়ই মহররম কুফায় ইয়াজিদের নিযুক্ত কুখ্যাত গভর্নর ইবনে জিয়াদ  ইমাম হুসাইন (আ.)’র ছোট্ট শিবিরের ওপর অবরোধ জোরদারের ও হামলার নির্দেশ দেয়। ইয়াজিদ বাহিনীর সেনা সংখ্যাও ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং দশই মহররমের দিনে তা প্রায় বিশ বা ত্রিশ হাজারে উন্নীত হয়।
 
ইমাম হুসাইন (আ.) নয়ই মহররমের বিকালের দিকে এক দিনের জন্য যুদ্ধ পিছিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেন যাতে দশই মহররমের রাতটি শেষবারের মত ইবাদত বন্দেগিতে কাটানো যায়। ইয়াজিদ বাহিনীরপ্রধান প্রথমে রাজি না হলেও পরে এ প্রস্তাবে রাজি হয়। বিকালেই হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) নিজ সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন। সঙ্গীরা আবারও তাঁর প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করেন।
 
৯ মহররমের আগেই ইমাম হুসাইনের শিবিরের ওপর আরোপ করা হয়েছিল অমানবিক পানি-অবরোধ। পশু-পাখী ও অন্য সবার জন্য ফোরাতের পানি ব্যবহার বৈধ হলেও এ অবরোধের কারণে কেবল নবী-পরিবারের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় এই নদীর পানি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাই মহররম কবিতায় লিখেছেন: 
 
 
মা’র স্তনে দুধ নাই, বাচ্চারা তড়্‌পায়!
 
জিভ চুষে কচি জান থাকে কিরে ধড়্‌টায়?
 
দাউদাউ জ্বলে শিরে কারবালা-ভাস্কর,
 
কাঁদে বানু–’পানি দাও, মরে জাদু আস্‌গর!’
 
কলিজা কাবাব সম ভুনে মরু-রোদ্দুর,
 
খাঁ খাঁ করে কার্‌বালা, নাই পানি খর্জুর,
 
পেল না তো পানি শিশু পিয়ে গেল কাঁচা খুন,
 
ডাকে মাতা, –পানি দেবো ফিরে আয় বাছা শুন্!- একই কবির লেখা এক গানে বলা হয়েছে:
 
শোকে ছল ছল কাঁদে অবিরল আজো ফোরাতের পানি....!
 
যেসব বৈশিষ্ট্য হুসাইনী আন্দোলনকে মহতী ও পবিত্র করেছে সেসবের অন্যতম হলো ইমাম হুসাইনের (আ.) দূরদর্শিতা ও উন্নত চিন্তাধারা। অর্থাৎ এ আন্দোলন এ কারণেই মহান যে,আন্দোলনকারী যা বুঝতে ও দেখতে পারছেন তা অন্য কেউ দেখতে পাচ্ছে না। তিনি তাঁর একাজের সুদূর প্রসারী প্রভাব দেখতে পাচ্ছেন। তার চিন্তাধারা সমসাময়িক যেকানো চিন্তাশীল লোকের উর্ধ্বে । ইবনে আব্বাস, ইবনে হানাফিয়া,ইবনে উমর প্রমুখ হয়তো পুরোপুরি নিষ্ঠার সাথে ইমামকে (আ.) কারবালায় যেতে নিষেধ করছিলেন। তাদের চিন্তার মান অনুযায়ী ইমামকে বাধা দেয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু হুসাইন (আ.) যা দেখেছিলেন তারা তা দেখতে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ.) সবকিছুই দিনের আলোর মতো দেখছিলেন। তিনি একাধিকার বলেছেন: ওরা আমাকে হত্যা করবেই;আর আল্লাহর শপথ করে বলছি যে,আমার হত্যার পর ওদের অবস্থা বিপন্ন হবে। এ ছিল ইমাম হুসাইনের (আ.) তীক্ষ্ণ দূরদর্শিতা।
 
ইমাম হুসাইন (আ.) এক মহান ও পবিত্র আত্মার নাম। মূলত যখন কোন আত্মা মহান হয় তখন বেশী কষ্টের সম্মুখীন হয়। কিন্তু ছোট আত্মা অধিক নির্ঝঞ্ঝাটে থাকে। এ এক সার্বিক নিয়ম। আরবের খ্যাতনামা কবি ‘মোতানাববী’ এক কবিতায়  বলেছেন :  ‘‘যখন কোনো আত্মা মহান হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই সে অন্যদের পরিত্রাণে ছোটে,অন্যদের জন্যে কষ্ট ও যন্ত্রণা বরণ করে নেয়। কিন্তু যার আত্মা ছোট সে কেবল নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়েই ব্যস্ত থাকে।’’ ছোট আত্মা একটু ভাল খাবারের জন্যে চাটুকারও হয় এবং ক্ষমতা বা খ্যাতির লোভে হত্যা-লুণ্ঠনও করতে রাজি। কিন্তু যার রয়েছে মহান আত্মা, সে শুকনো রুটি খেয়ে তৃপ্ত হয়,তারপর ঐ সামান্য আহার শেষে সারারাত জেগে আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন হয়। দায়িত্ব পালনে বিন্দুমাত্র গাফলতির ভয়ে তাঁর শরীর কাঁপতে থাকে। মহাত্মা ব্যক্তি আল্লাহর পথে ও নিজের মহান লক্ষ্যে নিজ জীবন বিলিয়ে দিতে চায়। আর এ পথে সফল হলে আল্লাহর শোকর করে। আত্মা মহান হলে আশুরার দিনে এক শরীরে নানা অস্ত্রের তিনশ’ ঘায়ের ব্যথা সহ্য করে ও তাঁর লাশ ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট হয়। এভাবেই সে বীরত্ব,সত্য-প্রেম এবং শহীদী আত্মার জন্য জরিমানা দেয়!
 
এই মহান আত্মা বলে ওঠে আমি আমার রক্তের মূল্য দিতে চাই। শহীদ কাকে বলে? প্রতিদিন কত মানুষ নিহত হচ্ছে । কিন্তু তাদেরকে কেন শহীদ বলা হয় না? শহীদ শব্দটি ঘিরে কেন এক পবিত্রতার আবেশ পাওয়া যায়? কারণ শহীদ সেই ব্যক্তি যার এক মহান আত্মা আছে সে আত্মা এক মহান লক্ষ্যকে অনুসরণ করে। শহীদ সে ব্যক্তি যে নিজ ঈমান ও আকীদা রক্ষায় প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, যে নিজের জন্যে তো নয়ই বরং মনুষ্যত্ব ও মানবতার স্বার্থে,সত্য ও হাকিকতের স্বার্থে মহান আল্লাহর পথে চরমদুঃখ-দুর্দশা এমন কি মৃত্যুকেও সাদরে বরণ করে নেয়। শহীদ তাঁর বুকের রক্ত দিতে চায় যেমনভাবে একজন ধনী তার ধনকে ব্যাংক বন্দী না করে তা সৎপথে দান-খয়রাত করে নিজ ধনের মূল্য দিতে চায়। সৎপথে ব্যয়িত প্রতিটি পয়সা যেমন লক্ষ -কোটি পয়সার মতো মূল্য লাভ করে তেমনি শহীদের প্রতি ফোটা রক্ত লক্ষ-কোটি ফোটায় পরিণত হয়। অনেকে হয়তো নিজ চিন্তাশক্তির মূল্য দেয় ও একটি আদর্শিক গ্রন্থ ও কেউ কেউ নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে একটি উপকারী শিল্প মানুষকে উপহার দেয়। কিন্তু শহীদরা তাদের রক্ত দিয়ে মানবের শান্তি ও কল্যাণের পথকে মসৃণ ও সুনিশ্চিত করে। এদের মধ্যে কে মানবতার সবচেয়ে বড় সেবক ?
 
 
অনেকে হয়তো ধারণা করতে পারে যে, একজন লেখক বা একজন ধনী কিংবা একজন শিল্পীর সেবাই সবচেয়ে বেশী। কিন্তু আসলে  এ ধারণা একবারেই ভুল। শহীদদের মতো কেউই মানুষকে তথা মানবতাকে সেবা করতে পারে না। শহীদরাই সমস্ত কণ্টকময় পথ পেরিয়ে মানবতার মুক্তি ও স্বাধীনতাকে বয়ে নিয়ে আসে। তারাই ন্যায়-নীতিবান ও শান্ত সমাজ গড়ে দিয়ে যায় যাতে জ্ঞানীর জ্ঞান, লেখকের কলম, ধনীর ধন, শিল্পীর শিল্প সুস্থ পরিবেশে বিনা বাধায় বিকাশ লাভ করতে পারে এবং মানবতা নিশ্চিন্তে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে পারে। শহীদরাই প্রদীপের মতো একটি পরিবেশকে আলোকিত করে রাখে যাতে সবাই অনায়াসে পথ চলতে পারে।
 
পবিত্র কুরআন রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে একটি প্রদীপের সাথে তুলনা করেছে। জগতে অবশ্যই প্রদীপ থাকতে হবে। অন্ধকার জগত নীরব-বধির, জীবনযাত্রা সেখানে অচল। এ সম্বন্ধে প্রখ্যাত কবি পারভিন এ’তেসামী সুন্দর একটি উপমার অবতারণা করেছেন। তিনি একজন দক্ষ শিল্পী ও একটি প্রদীপের কথোপকথনকে এভাবে চিত্রিত করেছেন-
 
শিল্পী প্রদীপকে বলে: ‘তুমি জান না,আমি গত রাতে এক মুহূর্তও ঘুমাইনি। সারা রাত জেগে কত সুন্দর সুন্দর ফুল তুলেছি। আমার জামাটিকে গুলবাগিচা বানিয়েছি। তুমি কখনোই আমার মতো ফুল তুলতে পারবে না। আমি আমার শরীরকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করতে অসামান্য দক্ষতা খরচ করেছি।’
 
শিল্পীর একথা শুনে প্রদীপ একটু মুচকি হেসে বললোঃ তুমি যে দাবী করছো সারা রাত জেগে তোমার রুচি ও দক্ষতাকে ফুটিয়ে তুলেছো-এসবই ছিল আমার আত্ম-উৎসর্গের ফল। আমি তিলে তিলে ক্ষয় হয়েছি ও তোমাকে আলো দিয়েছি বলেই তো তুমি তোমার দক্ষতাকে সুঁই ও সুতোয় আঁকতে পেরেছো। তোমার এসব দক্ষতা আমার জীবনের বিনিময়েই সম্ভব হয়েছে। তারপর বলছে:  ‘তাই তুমি সারা রাত ধরে যা করেছ বলে দাবী করছো-এসবই আমি করেছি।’
 
আজকে ইবনে সিনা-ইবনে সিনা হতো না, শেখ সাদী-শেখ সাদী হতো না,জাকারিয়া রাজী-জাকারিয়া রাজী হতে পারতো না যদি শহীদরা তাজা রক্ত খরচ করে ইসলামের চারাগাছকে সজীব না করতেন, ইসলামী সভ্যতাকে বাঁচিয়ে না রাখতেন। তাঁদের সমস্ত অস্তিত্বে একত্ববাদ, খোদাভীতি,ন্যায়পরায়ণতা,সৎসাহস আর বীরত্বে ভরপুর। তাই আমরা আজ যারা মুসলমান হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি তারা সবাই এ শহীদদের প্রতি ঋণী। ইমাম হুসাইনের (আ.) রক্তের কাছে নবীজীর (সা.) উম্মত ঋণী।  
 
ইতিহাসের সব স্মরণীয় পুরুষই এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন,যে পরিস্থিতিতে ইমাম হুসাইন (আ.) পড়েন আশুরার রাত্রে । অর্থাৎ বস্তুগত দিক দিয়ে তিনি সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েন এবং শত্রুকে পরাজিত করার বিন্দুমাত্র আশা নেই বরং অতিশীঘ্রই তিনি তাঁর সঙ্গী-সাথীসহ শত্রুদের হাতে খণ্ড-বিখণ্ড হবেন এটিই নিশ্চিত হয়ে ওঠে। অনেকেই এ মুহূর্তে অভিযোগ করেন,আফসোস করেন। বলা হয় যে,নেপোলিয়ন যখন ঐ পরিস্থিতিতে পড়লো তখন বলেছিল : হায় প্রকৃতি! তুমি আমাকে এভাবেই মারলে।
 
কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ.) সবকিছু বুঝতে পেরেও মৃত্যু নির্ঘাত জেনেও আশুরার রাতে কী বলেছেন? তিনি সঙ্গী-সাথীদেরকে সমবেত করলেন যেন যে কোনো বিজয়ীর চেয়েও তার মানসিকতায় উজ্জ্বলতার ঢেউ খেলে যাচ্ছ । তিনি বললেন : আল্লাহর জন্য সর্বোত্তম প্রশংসা। সুখে ও দুঃখে তোমারই প্রশংসা করছি। হে আল্লাহ তোমার প্রশংসা করছি আমাদেরকে নবুওতের ঘরানার সম্মান দিয়েছ বলে এবং কুরআনের ও ধর্মের বিধি-বিধানের জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছ বলে।
 
যেন সবকিছুই ইমাম হুসাইনের (আ.) অনুকূলে আছে এবং সত্যি -সত্যিই সবকিছু তাঁর অনুকূলে ছিল। কারণ, এ পরিস্থিতি একমাত্র তার জন্যেই দুঃখবহ ও প্রতিকূল, যে কেবল দুনিয়া ও ক্ষমতা চায় আর ব্যর্থ হয়ে এখন মৃত্যুর প্রহর গুনছে। কিন্তু যার সবকিছুই আল্লাহর জন্যে, এমন কি যদি হুকুমতও চান তাহলেও তা আল্লাহর জন্যই চান এবং জানেন যে আল্লাহর পথেই এগিয়ে এসেছেন তাহলে তার কাছ তো এ পরিস্থিতি অবশ্যই অনুকূল। এজন্যে তিনি আল্লাহর কাছে শোকরগুজারী-ই তো করবেন।
 
‘‘আল্লাহকে সর্বোৎকৃষ্ট প্রশংসা জানাই এবং সুখে-দুঃখে সব অবস্থাতেই তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। আল্লাহ আমাদেরকে নবুওয়াত দিয়ে সম্মানিত করেছেন,আমাদেরকে কোরআনের জ্ঞান দিয়েছেন এবং আপনার দীন পালনে আমাদেরকে সফল করেছেন-তাই আপনার লাখো শোকরিয়া আদায় করছি।’’
 
মোটকথা আমরা দেখলাম যে, এ আন্দোলনের গোড়া থেকে মাথা পর্যন্ত কেবল পৌরুষত্ব, বীরত্ব, সত্যানুসরণ এবং সত্য-প্রেম। কিন্তু এ বীরত্ব কোনো গোত্র বা দেশ বিশেষে সীমাবদ্ধ নয়, এতে কোনো ‘‘আমিত্ব’’ এবং আত্মস্বার্থ নেই। সবই ও সবকিছুই আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর পথে। তিনি এ পথে শেষ নিশ্বাস নেয়া পর্যন্ত ও অটল ছিলেন। যুদ্ধক্লান্ত ইমাম হুসাইন (আ.) যখন শেষ তীর খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন তখনও তিনি কেবলা থেকে কখনও পথভ্রষ্ট হননি যে কেবলার দিকে ফিরে পরম শান্তিতে বললেন :‘আপনার বিচারে আমি সন্তুষ্ট, আপনার আদেশের প্রতি আমি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পিত, আপনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই হে অসহায়দের সহায়।’ পার্সটুডে
captcha