IQNA

বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের অগ্রদূত ইবনে আল-শাতির

0:02 - November 10, 2022
সংবাদ: 3472794
তেহরান (ইকনা): পৃথিবী বিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনে আল-শাতির। তাঁর পূর্ণ নাম আল-আলাদিন আবুল হাসান আলী ইবনে ইব্রাহিম ইবনে আল-শাতির। জন্ম ১৩০৪ সালে। তিনি ছিলেন একজন আরব মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, প্রকৌশলী ও আবিষ্কারক।
তিনি সিরিয়ার দামেস্কে বিখ্যাত উমাইয়া মসজিদে মুয়াক্কি বা সময়রক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। এ কাজের জন্য তার সময় দেখতে হতো। সময় দেখার জন্য তার জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞান থাকার প্রয়োজন হতো। আর এভাবে তিনি বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানীতে পরিণত হয়েছিলেন। ইবনে আল-শাতির হলেন জ্যোতির্বিদ্যায় বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের অগ্রদূত।
জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হলো, ‘কিতাব নিহায়াত আল-সাল ফি তাশহি আল-উসুল  (The Final quest Concerning the Rectification of the planetary Principles)
 
। বইটিতে তিনি নিজস্ব মডেল ব্যবহারের মাধ্যমে সূর্য, চন্দ  ও গ্রহ নক্ষত্রের টলেমি মডেল ব্যাপকভাবে সংশোধন করেন। ইবনে আল-শাতির তার মডেলে এপিসাইকেল বা বৃহত্তর বৃত্তে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বৃত্তের ভেতর নির্দিষ্ট কক্ষপথে গ্রহগুলোর আবর্তনের ধারণা পরিত্যাগ করেন। তুসি কাপল-এর মধ্য দিয়ে তিনি বহুকেন্দ্রিকতা ও ইকুয়ান্ট প্রত্যাখ্যান করেন। এ ছাড়া তিনি লিউনার মডেলের সব বহুকেন্দ্রিকতা, এপিসাইকেল ও ইকুয়ান্ট বর্জন করেন। পূর্ববর্তী মারাগা মানমন্দিরের মডেল ছিল টলেমি মডেলের মতো নিল। কিন্তু আল-শাতিরের জ্যামিতিক মডেল ছিল টলেমির মডেলের চেয়ে সত্যিকারভাবে উন্নততর। তিনি বিজ্ঞানসম্মত পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। দার্শনিক যুক্তির পরিবর্তে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে টলেমি মডেল বর্জন করা ছিল আল-শাতিরের আরেকটি সাফল্য। পূর্ববর্তী বিজ্ঞানীরা সৃষ্টিতত্ত্ব ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নীতিমালা অনুসরণ করতেন। অন্যদিকে ইবনে আল-শাতির এসব নীতি অনুসরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। এরিস্টোটলীয় পদার্থ বিজ্ঞানের নীতিমালাও তিনি অনুসরণ করেননি, বরং তিনি এমন একটি মডেল উদ্ভাবন করেন, যা ছিল বিজ্ঞানসম্মত পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। তার প্রণীত গ্রন্থ জ্যোতির্বিজ্ঞানে একটি মোড় পরিবর্তনের সূচনা করে। যাকে রেনেসা পূর্ব একটি বৈজ্ঞানিক বিপ্লব হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।
 
শাতির একটি জিজ তৈরির মধ্য দিয়ে সৌরমণ্ডলীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর কাজ শুরু করেছিলেন। টলেমির সৌরমণ্ডলীয় থিওরির ওপর রচিত এ জিজের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে তিনি যেসব পর্যবেক্ষণ ও পদ্ধতির ভিত্তিতে একটি নয়া সৌরমণ্ডলীয় মডেল নির্মাণ করেছিলেন তালিক আল-আরশাদ শিরোনামে একটি গ্রন্থে তার বর্ণনা দেন। এ গ্রন্থটিরও কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে অন্য কয়েকটি পাণ্ডুলিপিতে শাতিরের ‘আল-জিজ আল-জাদিদ’  (The New astronomical handbook)  সংরক্ষিত। এসব পাণ্ডুলিপিতে তার একগুচ্ছ নয়া সৌরমণ্ডলীয় তালিকা খুঁজে পাওয়া যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মারাগা মানমন্দিরের কয়েকজন পণ্ডিতের রচনাবলিতে শাতিরের গ্রন্থের সূচনা উল্লেখ করা হয়।
 
ইবনে আল-শাতির একটি বিস্ময়কর অনুভূমিক সূর্যঘড়ি তৈরি করেছিলেন। ঘড়িটি দামেস্কে উমাইয়া মসজিদের উত্তর মিনারে বসানো হয়েছিল। ঘড়িটির মূল যন্ত্রপাতি দামেস্কের জাতীয় জাদুঘরের বাগানে সংরক্ষিত। এ সূর্যঘড়ি দেখে মুয়াজ্জিন আজান দিতেন। মূল্যবান মার্বেল পাথরে তৈরি ঘড়িটির আকার ছিল ২ – ১ মিটার। শাতির আরেকটি ছোট ঘড়িও তৈরি করেছিলেন। এ ঘড়িটি আলেপ্পোতে সংরক্ষিত। ‘সানডুক আল-ইয়াওয়াকু’ (রত্ম বাক্স) নামে একটি বাক্সে ঘড়িটি রাখা হতো। এ ঘড়িটির আয়তন ছিল ১২ – ১২ – ৩ সেন্টিমিটার। জোহর ও আসরের নামাজ আদায়, স্থানীয় সময় এবং কেবলা নির্ধারণে ঘড়িটি ব্যবহার করা হতো। শাতির একটি চৌম্বকীয় কম্পাসও তৈরি করেছিলেন। ইবনে আল-শাতির প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক একটি বহুমুখী কম্পেনডিয়াম  (Compendium) নির্মাণ করেছিলেন। তার কস্পেনডিয়ামে অন্যান্য যন্ত্রপাতির মধ্যে ছিল জ্যোর্তিবিজ্ঞান বিষয়ক যন্ত্র এলহাইডাড  (Alhidade) এবং সূর্যঘড়ি। ইউরোপে রেনেসাঁ যুগে এ কম্পেনডিয়াম অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
 
ইবনে আল-শাতির তার ‘আল-আশিয়া আল-লামিয়া ফিল-আমল বিল আলা আল জামিয়ায়  (Rays of light on operations with the Universal instrument) আরেকটি জ্যোর্তিবিজ্ঞান বিষয়ক যন্ত্রের বর্ণনা দিয়েছেন। এ যন্ত্রকে তিনি ইউনিভার্সেল বা সর্বজনীন যন্ত্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। অটোমান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী তকি আল-দীন কিতাব আল-ছিমার আল-ইয়ানিয়া আন কুতাফ আল-আলা’  (Book of Ripe Fruits from Clusters of Universal Instrument) শিরোনামে শাতিরের এই গ্রন্থটির ওপর একটি ভাষ্য রচনা করেন। তকি আল-দীন ১৫৭৭-১৫৮০ সালে ইস্তাম্বুলে তার নামানুসারে নির্মিত একটি মানমন্দিরে এ যন্ত্রটি ব্যবহার করেন।
 
তথ্যঋণ : স্বর্ণযুগে মুসলিম
captcha