IQNA

বাংলার প্রাচীন মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়

0:04 - February 08, 2023
সংবাদ: 3473308
তেহরান (ইকনা): একসময় বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়ে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও আশপাশের এলাকা নিয়েই ছিল প্রাচীন গৌড়। বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ছোট সোনা মসজিদ ও কোতোয়ালি দরজার মধ্যবর্তী স্থানে ওমরপুরের সন্নিকটে এটি অবস্থিত। মহানন্দা নদীর তীর ঘেঁষে তিন কিলোমিটার দূরে বিজিবির সীমান্ত তল্লাশিচৌকি পেরিয়ে আরো কিছুদূর হেঁটে গেলেই দরসবাড়ি মসজিদ-মাদরাসা কমপ্লেক্স।

দরসবাড়ি মাদরাসা গৌড় লখনৌতির বাংলাদেশ অংশের মধ্যে সর্ববৃহৎ মসজিদ-মাদরাসা কমপ্লেক্স। এটি ছোট সোনা কোতোয়ালি দরওয়াজা রোডের পশ্চিমে মধ্যযুগীয় শহরের দরসবাড়ি এলাকায় অবস্থিত, যা বর্তমানে ভারতীয় সীমান্তের নিকটবর্তী একটি পতিত এলাকা। মসজিদের পূর্ব দিকে একটি মাদরাসা আছে, যা একটি বড় জলাধার দ্বারা মসজিদ থেকে বিচ্ছিন্ন। মসজিদ, মাদরাসা ও জলাধার—এসব মিলিয়ে একটি মুসলিম শিক্ষা কমপ্লেক্সের রূপ দেওয়া হয়েছে। কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত শিলালিপি অনুযায়ী, মসজিদটি ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে শামসুদ্দীন আবুল মুজাফফর ইউসুফ শাহ কর্তৃক নির্মিত হয়েছে। (বাংলাপিডিয়া)

 

অন্য বর্ণনা মতে, বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দীন শাহর রাজত্বকালে ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে ৯০৯ হিজরির পহেলা রমজান সুলতানের আদেশে বাংলার আদি রাজধানী গৌড়ের ফিরোজপুর এলাকায় দরসবাড়ি মাদরাসা নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। সুবিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে সমবেত হতেন শিক্ষা গ্রহণের জন্য। বাংলার বুকে সর্বপ্রথম এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বুখারি, মুসলিমসহ সিহাহসিত্তাহ হাদিস শিক্ষা দেওয়া হতো। হুসেন শাহ্ পরবর্তী সময়ে ঢাকার সোনারগাঁ মাদরাসা থেকে সিহাহসিত্তাহ হাদিস শিক্ষা দেওয়া হতো। মোহাম্মদ বিন ইয়াজদান বখশ নামের এক আলেমকে দিয়ে বুখারি শরিফ নকল করিয়ে (অনুলিপি তৈরি করে) বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার গড়ে তোলা হয়। [করিম, আবদুল (জানুয়ারি ১৯৯৪)। মুসলিম বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্য, বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা ১২০]

 

আরবিতে দরস অর্থ পাঠ। বাংলার প্রথম যুগের মুসলিম স্থাপত্যকীর্তির এক অনন্য নিদর্শন এই দরসবাড়ি মাদরাসা এবং সন্নিকটেই আছে আরেক ঐতিহাসিক ইসলামী স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন দরসবাড়ি মসজিদ। ঐতিহাসিকদের মতে, দরসবাড়ি মাদরাসার পাঠক্রম এবং অন্যদিক বিবেচনায় এটি ছিল একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য। বিভিন্ন জনপদ থেকে শিক্ষার্থীরা এসে এখানে জ্ঞানার্জনের জন্য সমবেত হতেন এবং এটি পুরোটাই ছিল আবাসিক।

 

সুপ্রাচীন এই ইসলামী স্থাপত্য নিদর্শনটি ছিল বর্গাকৃতির। সব বাহুর দৈর্ঘ্য ৫১.৫২ মিটার। কমপ্লেক্সের মাঝামাঝি অংশে ৩৭.৫ মিটার পরিমাপের বর্গাকার চত্বরের পশ্চিম বাহু ছাড়া অপর তিন বাহুতে এক সারি করে প্রকোষ্ঠ এবং তিন বাহুর মধ্যবর্তী ছিল তিনটি নামাজের জায়গা বা ইমামের কক্ষ। তিনটি কক্ষেই আছে আলাদা তিনটি অবতল মেহরাব। স্থাপনাগুলোর দেয়াল পোড়ামাটির ফলক ও নকশায় অলংকৃত। দরসবাড়ি কমপ্লেক্সে আরো ৩৭টি কক্ষ ছিল। ছিল ওয়াক্তিয়া মসজিদ একটি, অফিস একটি। ছিল তিনটি প্রবেশপথ। বাহ্যিকভাবে দরসবাড়ি ইসলামী কমপ্লেক্স বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কক্ষসংখ্যা ৪০টি হওয়ার কারণে দরসবাড়িকে ৪০ ঘর বা ৪০ বাড়িও বলা হতো।

 

দরসবাড়ি মাদরাসার কাঠামোর ভগ্নাবশেষ এখনো টিকে আছে। এটি প্রমাণ করছে, একদা এ অঞ্চলে ছিল সুশিক্ষিত আধুনিক মুসলিম সভ্যতার সূতিকাগার। প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক কারণে হারিয়ে গেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাঁচ শতাব্দী প্রাচীন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

captcha