IQNA

মুসলিম সভ্যতায় বেসরকারি খাতের বহুমুখী উদ্যোগ

0:02 - February 09, 2023
সংবাদ: 3473314
তেহরান (ইকনা): ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সঙ্গে বেসরকারি খাতের সম্পর্ক সহযোগিতাপূর্ণ। ইসলামী রাষ্ট্রে সরকার বেসরকারি খাতের জন্য পথনির্দেশক ও সহযোগীর ভূমিকা পালন করে এবং বেসরকারি খাত রাষ্ট্রের জন্য সম্পূরক হিসেবে কাজ করে। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় বেসরকারি খাত আইনানুগ স্বাধীনতা ভোগ করবে এবং জনস্বার্থে রাষ্ট্র বেসরকারি খাতের ওপর নিয়ন্ত্রণও রাখবে।

ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি : ইসলাম সম্পদে ব্যক্তিমালিকানা, মানুষের আর্থিক লেনদেনসহ জীবনযাপনের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। কেননা ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ সত্তাগতভাবে স্বাধীন। তাই বৈধ কর্তৃপক্ষ ছাড়া কেউ স্বাধীন মানুষের কাজে বাধা দিতে পারবে না। তবে এই স্বাধীনতা ভোগের নামে মানুষ আল্লাহর বিধি-বিধান ও মানুষের অধিকার ক্ষুণ্ণ করতে পারবে না। যদি সে তা করে তবে রাষ্ট্র ও সমাজ তাকে আইনসংগত উপায়ে প্রতিহত করবে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘তোমরা মানুষকে কখন দাসে পরিণত করলে, অথচ তাদের মা তাঁকে স্বাধীন হিসেবেই জন্ম দিয়েছে।’ (তারিখে ইবনে ইসহাক)

 

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যা দ্বারা আল্লাহ তোমাদের কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন তোমরা তার লালসা কোরো না। পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ। আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা কোরো, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩২)

 

বেসরকারি খাতের বহুমুখী ভূমিকা

 

ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় বেসরকারি খাত বলতে শুধু আর্থিক খাতকেই বোঝায় না, বরং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বাইরে সাধারণ মানুষের যেকোনো কর্মকাণ্ড বেসরকারি খাতের অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম আগমনের সময় থেকে ইসলামী সমাজ, সভ্যতা ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় বেসরকারি খাত বহুমুখী ভূমিকা পালন করে আসছে। নিম্নে তার কয়েকটি বর্ণনা করা হলো।

 

১. ইসলামী সভ্যতার প্রসার : ইসলাম ও ইসলামী সভ্যতার প্রসারে মুসলিম বণিকদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও তৎপরতার বিশেষ ভূমিকা ছিল। বিশেষত মধ্য, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকাসহ পৃথিবীর বিস্তৃত অঞ্চলে ইসলাম, ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বাহক হিসেবে আরব বণিকরা অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছে।

 

২. বাজারব্যবস্থাপনা : মদিনায় হিজরত করার পর মহানবী (সা.) ব্যবসায়ীদের জন্য করমুক্ত স্বাধীন বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আরব উপদ্বীপে এটাই ছিল মুসলিমদের প্রতিষ্ঠিত প্রথম বাজার। এরপর সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বহু বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বেশির ভাগ বাজারের করমুক্ত ব্যবসার অবাধ সুযোগ ছিল। বেসরকারি বাজারগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো—ক. বসরা বাজার, ইরাক : ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ বিন আমের বিন কারিজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

 

খ. ওয়ারদান বাজার, মিসর : আমর ইবনুল আস (রা.)-এর দাস ওয়ারদান রুমি এটি প্রতিষ্ঠা করেন।

 

গ. সাকালা বাজার, সিরিয়া : খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান এটি সুফিয়ান ইবনে আবরাদের জন্য বরাদ্দ দিয়েছিলেন।

 

৩. সমাজসেবা : মুসলিম শাসনামলে ব্যবসায়ীরা সমাজসেবা কার্যক্রমে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। তাঁরা মসজিদ ও মাদরাসা নির্মাণ, হাসপাতাল ও এতিমখানা, পানির কূপ খনন ও গোসলখানা নির্মাণ ইত্যাদি কাজে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। এ ক্ষেত্রে ফাতেমি আমল বিশেষভাবে স্মরণীয়। যেমন ব্যবসায়ী নুরুদ্দিন আলী বিন মুহাম্মদ কায়রোতে বিশাল একটি গোসলখানা নির্মাণ করেন। ব্যবসায়ী ইজ্জুদ্দিন আল-সালামি বাগদাদে বিশাল এক মাদরাসা ও হিফজখানা নির্মাণ করেন। ব্যবসায়ী উসমান বিন আফফান চীনা শহর কানসাতে বড় মেহমানখানা ও সুফি খানকা প্রতিষ্ঠা করেন।

 

৪. কর্মসংস্থান সৃষ্টি : জাতীয় অর্থনীতি সচল রাখা এবং কর্মসংস্থান তৈরিতে বেসরকারি খাত সব সময় এগিয়ে ছিল। বিশেষত শিল্পবিপ্লবের আগ পর্যন্ত কৃষি ও বাণিজ্য খাতই ছিল মানুষের প্রধান কর্মসংস্থান, যা প্রধানত বেসরকারি ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভরশীল। যদিও ভিন্ন পেশায়ও বহু মানুষ কর্মরত ছিল। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে একাদশ শতক পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বে কৃষিসংশ্লিষ্ট ৬৩টি, উৎপাদনসংশ্লিষ্ট ৬৯৭টি, সরকারি-বেসকারি প্রতিষ্ঠানে ৭৩৬টি স্বতন্ত্র পেশা ছিল। সুতরাং বলাই যায়, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বেসরকারি খাতের ভূমিকাই মুখ্য ছিল।

 

৫. নগরায়ণ : বাগদাদ, বসরা, কুফা, মারাকেশ, কায়রো, কারাউইন, তিউনিস ইত্যাদির মতো মুসলিম শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত প্রধান নগরগুলো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তবে এসব নগরীর বিকাশ ও সমৃদ্ধি বেসরকারিভাবেই হয়েছিল। মুক্তবাজার অর্থনীতি, বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক যোগাযোগ, অর্থের প্রবাহ এসব নগরীর জীবনযাত্রার মান অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। স্পেনের কর্ডোভায় এবং ইরাকের বাগদাদে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে একাধিক পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছিল।

 

৬. শিল্পায়ন : মুসলিম শাসকরা শিল্পের বিকাশে সহযোগিতা করলেও রাষ্ট্রের শিল্প খাত প্রধানত বেসরকারিভাবেই পরিচালিত হতো। বেসরকারি উদ্যোগে মুসলিম বিশ্বে যেসব শিল্পের বিকাশ ঘটে, তার কয়েকটি হলো—

 

ক. খনিজ শিল্প : বেসরকারি উদ্যোগে লোহা, তামা, স্বর্ণ ও রৌপ্য পরিশোধন ও আসবাব তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছিল।

 

খ. খাদ্যশিল্প : বেসরকারি উদ্যোগে ফল, ফসল ও চিনি উৎপাদন করা হতো। নানা উপায়ে তা সংরক্ষণ করা হতো। মাছ আহরণ করে তা বাজারজাত করা ও শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হতো। শস্য প্রক্রিয়াজাত করতে বায়ুচালিত কলেরও প্রচলন ছিল।

 

গ. পোশাকশিল্প : মুসলিম ব্যবসায়ীরা সুতি, লিলেন ও রেশমের কাপড় উৎপাদন করতেন।

 

ঘ. কাঠশিল্প : মুসলিম বিশ্বের বহুমুখী কাঠের ব্যবহার ছিল। যেমন কাঠের দরজা, জানালা, সদর দরজা, নানা ধরনের আসবাব ও তৈজসপত্র।

 

ঙ. কার্পেটশিল্প : কার্পেটশিল্পে মুসলমানের আধিপত্য ছিল সর্বকালেই। নানা ধরনের কার্পেটের পাশাপাশি মাদুর, পাটি ও জায়নামাজ উৎপাদন করা হতো।

 

চ. অন্যান্য শিল্প : এ ছাড়া জ্বালানি তেল, লবণ, মার্বেল, সাবান, কাগজ, সিরামিক, ওষুধ, সুগন্ধি, কাচ ও সালফার শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল বেসরকারি উদ্যোগে।

 

৭. স্থায়ী দানে সামাজিক সুরক্ষা : জনস্বার্থে মুসলিম ব্যবসায়ী ও ধনী ব্যক্তিরা বিপুল পরিমাণ সম্পদ ওয়াকফ করতেন। যার মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা হতো। ওয়াকফকৃত সম্পদ সাধারণত ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ব্যয় হতো। এর বাইরে অসহায় ব্যক্তিদের হজ করানো, অভিভাবকহীনদের বিয়ে, বন্দি মুক্তি, পথিক ও অসহায়দের আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা, হাসপাতাল ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা, কবি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানীদের বিশেষ ভাতা প্রদান, রাস্তাঘাট সংস্কার ইত্যাদি কাজেও তা ব্যবহৃত হতো।

 

৮. বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র নির্মাণ : মুসলিম আমলে রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোও বেসরকারিভাবেও নির্মিত হয়েছে। যেমন আরব ভূগোলবিদ আল-মাকদিসি উল্লেখ করেছেন, তাঁর দাদা আবু বকর আল-মাকদিসি মিসর ও শামের শাসক ইবনে তুলুনের (২৫৪-২৭০ হি.) জন্য ‘অ্যাকর’ বন্দর (ফিলিস্তিন অঞ্চলে অবস্থিত) নির্মাণ করেন। বন্দর নির্মাণে তিনি কাঠ ও পাথর ব্যবহার করেন। বন্দরের নিরাপত্তার জন্য জেটি, নিরাপত্তা চৌকি ও দেয়াল নির্মাণ করেন।

 

এ ছাড়া একজন আরব মুসলিম ব্যবসায়ী পূর্ব আফ্রিকায় লোহিত সাগরের উপকূলে বসতি স্থাপন করেন, যা আধুনিক ইরিত্রিয়ার মাসাওয়াতে অবস্থিত। তিনি ১৩৪৯ হিজরিতে সমুদ্রবন্দরে একটি মসজিদ, দুটি রাস্তা, একাধিক ডেক নির্মাণ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বন্দরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৪০টি ঘর নির্মাণ করেন। একইভাবে একজন মুসলিম হাজি নবম হিজরিতে সুদানে সোয়াকিন নামে একটি বন্দর নির্মাণ করেন। যা ১৯০৫ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল।

 

৯. আন্তর্জাতিক বাণিজ্য : মুসলিম শাসনামলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যগুলো প্রধানত বেসরকারি উদ্যোগেই হতো। মুসলিম ব্যবসায়ীরাই ব্যক্তিগত বাণিজ্য কাফেলা ও নৌবহর নিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতেন। মুসলিম ব্যবসায়ীরা যেসব পথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালনা করতেন তার মধ্যে মধ্য এশিয়ার সিল্করোড, যা এশিয়াকে আফ্রিকা ও ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত করেছে, ট্রান্স সাহারান ট্রেড রোড, ভারত মহাসাগর ধরে দূরপ্রাচ্য পর্যন্ত বিস্তৃত নৌবাণিজ্য পথ উল্লেখযোগ্য। মূলত তিনটি পথ তৎকালীন সভ্য পৃথিবীকে বাণিজ্যিকভাবে একত্র করেছিল।

 

এ ছাড়া মুসলিম বণিকরা স্থানীয় পর্যায়ে এমন সব কেন্দ্র নির্মাণ করতেন, যেখানে অন্য দেশের বণিকরা এসে লেনদেন করত। যেমন বসরার ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ বিন জাফর ১০০ হিজরিতে ফোরাত নদীর পশ্চিম তীর থেকে শাত-ইল-আরব একটি কৃত্রিম খাল খনন করেন এবং একটি বাণিজ্যকেন্দ্র নির্মাণ করেন। যেন বিদেশি ব্যবসায়ীরা সহজেই বাণিজ্য জাহাজ নিয়ে সেখানে উপস্থিত হতে পারে। আবদুল্লাহ বিন জাফরের সাফল্য দেখে একাধিক বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল।

 

১০. সুশাসন প্রতিষ্ঠা : ইসলামী রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠায়ও সাধারণ মানুষের অনন্য অবদান রয়েছে। মূলত সাধারণ মানুষই ইসলামী রাষ্ট্রের পাহারাদার। তারা রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ইসলামচর্চা হচ্ছে কি না তা সাধারণ মানুষই লক্ষ্য করবে এবং জাতীয় নেতৃত্ব ভুল পথে চললে তাদের সতর্ক করবে। এক ব্যক্তি ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-কে বলেন, হে আমিরুল মুমিনিন, আল্লাহকে ভয় করুন। তখন একজন তাকে বলল, তুমি আমিরুল মুমিনিনকে বলছ, আল্লাহকে ভয় করুন! ওমর (রা.) বললেন, তাকে বলতে দাও। সে আমাকে কতই না উত্তম কথা বলেছে। তোমাদের জন্য কোনো কল্যাণ নেই, যদি তোমরা তা (শাসকদের সতর্ক করা) না বলো। আমাদের কোনো কল্যাণ নেই যদি আমরা তোমাদের থেকে তা গ্রহণ না করি।

 

মারওয়ান হাদ্দাদের গবেষণাপত্র ‘প্রাইভেট সেক্টরস রোল ইন মুসলিম সিভিলাইজেশন ডেভেলপমেন্ট’ অবলম্বনে

captcha