IQNA

মুহম্মদ মুহসিন;

বীর যোদ্ধা তিতুমীর ।। পর্ব-৩

17:54 - September 26, 2020
সংবাদ: 2611538
তেহরান (ইকনা): নারিকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লার ঐতিহাসিক স্থানে তিতুমীরের কবরটি অনেক খোঁজাখুঁজির পর হঠাৎই পুরনো ইতিহাসের পাঠ থেকে আমার মনে পড়েছিল যে, তিতুমীরের কোনো কবর নেই। ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর মেজর স্কটের অধীনে পদাতিক বাহিনী ও গোলন্দাজ বাহিনী নারিকেলবাড়িয়ার কেল্লা গুঁড়িয়ে দিয়ে তিতুমীরসহ তাঁর ৫০জন অনুসারী হত্যা করে। আগের অভিযানগুলোয় তিতুমীর বাহিনির কাছে পরাজয়ের প্রতিশোধে নিতে উন্মত্ত হিংস্রতায় সেদিন ইংরেজ বাহিনি তিতুমীর ও তাঁর ৫০ জন সহযোগীর লাশ ইসলামিক কায়দায় দাফনেরও সুযোগ দেয়নি। তারা এই লাশগুলো নির্মম হিংস্রতায় আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল।

ইংরেজ বিরোধী সশ্রস্ত্র সংগ্রামের প্রথম বাঙালি শহীদ বীর তিতুমীরকে ইংরেজরা এভাবে এই মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে প্রয়াস পেয়েছিল। আমার সেই ইতিহাস তখন স্মরণে না পড়ায় মনে মনে এই ভাবনা নিয়েই আগাচ্ছিলাম যে তিতুমীরের কবর জেয়ারাতে যাচ্ছি।

সেই জেয়ারাতের কথা ঐ লোকগুলোকেও শোনালাম। তিতুমীর বেঁচে নেই একথা জানলেও ঐ লোকগুলোও মনে হয় আমার মতোই জানতো না যে, তিতুমীরের কোনো কবর নেই। জানলে তো আমার ঐ বাক্যও তাদের শুধরে দেয়ার কথা। কিংবা আমার দ্রুত প্রস্থানের কারণে হয়তো সেই সময় তারা পায়নি। আমার দ্রুত চলার পা বেশিক্ষণ চালাতে হলো না। একটি অটোরিকশা জাতীয় বস্তু পেলাম যাকে ওখানে আবার- ‘অটো’ বলে না, বলে ‘টোটো’। আমাদের অটো-রূপ ইন্ডিয়ান সেই টোটোতে উঠলাম। টোটো কিছুক্ষণেই আমাকে নামালো সেই জায়গায় যেখানে লেখা দেখে গিয়েছিলাম- ‘তিতুমীর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। সেখানেই নাকি হুগলি টালিকারখানা। ফলে পথনির্দেশদাতাদের অসিয়ত মোতাবেক সেখানেই নামলাম।

একবার ভাবলাম তিতুমীর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে কিছু একটা খেয়ে যাই, কারণ, সকাল থেকে দানাপানি মুখে কিছু পড়েনি। কিন্তু একটি হঠাৎ ভাবনায় তিতুমীর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে ঢোকা থেকেই বিরত থাকলাম। ভাবনাটি অবশ্য বালখিল্যগোছের। কিশোর শ্রেণির কোনো বইতেই মনে হলো তিতুমীরের নামের ইতিহাস পড়েছিলাম। পড়েছিলাম যে, নিসার আলী নামের এই ছেলের নাম তিতুমীর হয়ে যাওয়ার পিছনে ছিল তাঁর ‘তিতা’স্বাদের প্রতি অস্বাভাবিক অনুরাগের একটি ঘটনা। ছোটবেলায় তার এক কঠিন অসুখ করেছিল। সে অসুখের ওষুধ প্রচণ্ড তিতা স্বাদের হওয়ায় বাবা-মা চিন্তায় পড়েছিল যে এই ওষুধ তো এই ছোট ছেলেকে খাওয়ানোই যাবে না। কিন্তু ওষুধ নিসার আলীকে খেতে দেয়ার পরে দেখা গেল পুরো উল্টো দৃশ্য। খুব মজা করে সেই তেতো ওষুধ বালক নিসার আলী খেয়ে ফেললো। শুধু তাই নয়, পরবর্তীকালেও দেখা গেল তিতা স্বাদের প্রতিই বালক নিসারের বেশি আগ্রহ। ঐ অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে আশেপাশে সর্বত্র তার নাম ‘তিতা’ থেকে ‘তিতু’হয়ে গেল। বংশ ঐতিহ্যের মীর পদবী যুক্ত হয়ে কালক্রমে ‘তিতু’হয়ে গেল ‘তিতুমীর’- আর চিরকালের জন্য চাপা পড়ে গেল তার মূল নাম নিসার আলী।

ভাবলাম নিসার আলীর স্বাদ ও আগ্রহ যেহেতু তিতার প্রতি সেহেতু তার স্মৃতির ভিটায় যাওয়ার পথে মিষ্টি খেয়ে হাঁটা দেয়াটা ঠিক হবে না। তাই ঢুকলাম না মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। বরং, যে রাস্তা ধরে হাঁটা দিতে হবে নারিকেলবাড়িয়ার বাঁশের কেল্লার দিকে সেই রাস্তার মুখে দাঁড়ানো মুদী জাতীয় এক দোকানদারের কাছে আরেকবার নিশ্চিত হয়ে নিলাম যে এটা তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার দিকের রাস্তা কিনা। তারপর সেই রাস্তা ধরে শুরু করলাম হাঁটা। রাস্তা ধরে হাঁটছি আর ভাবছি সকাল থেকে এত পথ পাড়ি দিয়ে বৃটিশভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামীর দুর্গ বাঁশের কেল্লার দিকে আসতে আসতে একেবারে কেল্লার কাছে এসে পড়লাম, অথচ এতক্ষণে ঐ একটিমাত্র মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সাইনবোর্ডে ছাড়া এই মহান লোকটির নামটি অন্য কোথাও কোনোরূপে একবার চোখে পড়লো না- এ তো বড় রহস্যময়। এমনকি একেবারে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার দিকের এই রাস্তাটির মুখেও তো অন্তত উচিত ছিল একটি তীর-অঙ্কিত নির্দেশনা দিয়ে লিখে রাখা যে এই দিকে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা। সেটুকুও নেই। একই সাথে মনে পড়ছিল যে, কলকাতা-হুগলীসহ সারা ভারতজুড়ে বিভিন্ন স্থানেই তো ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামীদের নামে রাস্তঘাট, সরকারী প্রতিষ্ঠান, পার্ক অনেক অনেক দেখলাম। সে-সব জায়গায়ও তো এই নামটি কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়লো না। পরে অবশ্য খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে, বারাসাতে তিতুমীরের নামে একটি বাসটার্মিনাল আছে এবং বারাসাতের জেলা পরিষদের কনফারেন্স রুমটিও তিতুমীরের নামে। আমি সে-জায়গায় যাইনি বলেই তো আমার চোখে পড়েনি। সুতরাং এ নিয়ে কর্তৃপক্ষ বিষয়ে বদগুমান করা অবশ্যই ঠিক না।

প্রস্তাবিত তিতুমীর সংগ্রহশালার বহির্দেয়াল
অবশ্য এই খোঁজ তখনো জানি না বলেই এই কথাগুলো নিয়ে ভাবছিলাম আর হাঁটছিলাম। সাথে একটু আনন্দ পাচ্ছিলাম এই ভেবে যে, আমার বাংলাদেশ এই জায়গায় অন্তত পশ্চিমবঙ্গকে একখানা ট্রাম্প মারতে পেরেছে। তিতুমীরের জন্ম যদিও বাংলাদেশে নয়, তারপরও ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের প্রথম বীর ও প্রথম শহীদ হিসেবে বাংলাদেশের মাটিতে তাঁর মর্যাদাব্যঞ্জক স্মরণে একটি সরকারী কলেজ এবং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ খ্যাতিসম্পন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হাঁটার পথে এই আনন্দ আরো একটু বেড়ে গেল একটি হঠাৎ দৃশ্যে। রাস্তার পাশে দেখলাম একটি লতার মাচান থেকে প্রচুর পটল ঝুলছে। পটল অনেক দেখেছি তবে সবই বাজারে। গাছে পটল ঝুলতে এই জীবনে প্রথম দেখে মেজাজটা বেশ ফুরফুরে হওয়ার মতো ভালো লাগলো। পটল বিষয়ক অভিজ্ঞতায় নিজেকে বেশ জ্ঞানী মনে হলো। ইচ্ছে হচ্ছিলো চিৎকার দিয়ে বলি- তোমরা জ্ঞানীরা শোনো সবাই, পটলও যে লতার মতো গাছে ধরে সে কথা তোমাদের কারো চেয়ে আমি আর কম জানি না। স্বচক্ষে দেখে ফেলেছি। তোমরা চাইলে আমি এখন এখানে পটল তুলতেও পারি। অবশ্য এ চিৎকার গলার ভিতর থেকে বাইর করলাম না। ঘুরতে গিয়ে একবার পাগল সাব্যস্ত হয়েছিলাম ১৯৯২ সালে বরগুনার আমতলীতে। সেই রকম অভিজ্ঞতা আর বাড়িয়ে লাভ নেই।

লাভ বরং বিশাল পরিমাণে অপেক্ষা করছে সামনে। তিতুমীরের মাজার জিয়ারাত করার ইহকালীন ও পরকালীন দোজাহানের লাভ। সেই লাভের লোভে জোর কদম হাঁটছি। পথে যারে পাচ্ছি তার কাছেই বলতে গেলে নিশ্চিত করে নিচ্ছি আমি ঠিক পথে হাঁটছি কিনা। বারবার এমন নিশ্চিতকরণ অবশ্য শুধু পথের দিশার উদ্দেশ্যেই ছিল না। যার সাথেই দেখা হচ্ছিলো দাঁড়ি ও চেহারাসুরতে তাদের সকলকেই আমার জিগরি আলাপের মুসলমান ভাই বলে মনে হচ্ছিলো। ফলে সুযোগ হচ্ছিলো একখানা লম্বা সালাম দেওয়ার এবং একই সাথে কোনো এক অদৃশ্য সখ্যের বদৌলতে আশা করার যে, কোনো আপন গোপন কথা হয়তো কথা বলতেই তার কাছ থেকে জেনে ফেলবো। কিন্তু অল্পক্ষণেই বুঝতে পারছিলাম যে আমার এমন আশা করাটা ছিল নেহায়েতই মূর্খ-সুলভ কল্পনা যেমন মূর্খতায় আমি তখনো পথ চলছিলাম তিতুমীরের মাজার জেয়ারত করবো বলে। আমি ওপার থেকে আসা মুসলমান শুনেই এখানকার মুসলমানরা আমাকে তাদের মায়ের পেটের ছোট ভাই মনে করে সুখদুঃখের সব কথা কইতে শুরু করবে এমনটা ছিল একেবারেই আমার মূর্খতার এক্সটেনশন। বরং ব্যাপারটা এমন ছিল যে, তারা একথা শুনেই আমাকে কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করছিল। ভাবছিল, আমি তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা দেখতেই এতদূর এসেছি নাকি অন্য কোনো মতলব আছে। মাঝে মাঝে কিছুটা জেরাও করছিল।
(চলবে)...

সূত্র: banglatribune

captcha