বার্তা সংস্থা ইকনা: দৈনিকটি কয়েকজন মার্কিন কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১৩ সালে সিরিয়ায় লড়াইরত বিদ্রোহী তথা সন্ত্রাসীদের গোপনে সাহায্য করতে মার্কিন গোয়েন্দা-সংস্থা সিআইএ’র প্রতি নির্দেশ দেন। আর এই গোপন মিশনের শরিক ও অর্থের যোগানদাতা হিসেবে সিআইএ বেছে নেয় সৌদি সরকারকে। সৌদি সরকার সন্ত্রাসীদের বিপুল অংকের অর্থ ছাড়াও যোগান দেয় অস্ত্রের। আর সিআইএর একে-৪৭ রাইফেল ও ট্যাংক-বিধ্বংসী রকেট চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়। ২০১৩ সাল থেকে সন্ত্রাসীদেরকে গোপনে অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে সিআইএ। সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় জর্দানে সিআইএ’র মাধ্যমে। প্রশিক্ষিত এইসব সন্ত্রাসীর অনেকেই পরে যোগ দেয় তাকফিরি-ওয়াহাবি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশ তথা আইএসআইএল-এ।
ওই মার্কিন কর্মকর্তারা নিউইয়র্ক
টাইমসকে আরও জানিয়েছেন, আসাদ সরকারকে
উৎখাতের লক্ষ্যে সূচিত এ মিশনের জন্য
সৌদি সরকার কয়েক শত কোটি ডলার যুগিয়েছে। তবে আরও বেশি অর্থ দিয়েছে পারস্য উপসাগরীয় কয়েকটি দেশের রাজতান্ত্রিক
সরকার।
সৌদি আরব থেকে এভাবে বিপুল অংকের অর্থ নেয় বলেই সৌদি সরকার ইয়েমেন ও বাহরাইনসহ বিভিন্ন অঞ্চলে
মানবাধিকার পদদলন করে আসলেও মার্কিন
সরকার প্রকাশ্যে এ ব্যাপারে রিয়াদের সমালোচনা করতে চায় না।
নিউইয়র্ক টাইমসের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, তৎকালীন সৌদি
গোয়েন্দা-প্রধান বন্দর বিন সুলতান সিরিয়ায় তৎপর সন্ত্রাসীদের জন্য হাজার হাজার কালাশিনকভ
রাইফেল ও লাখ লাখ গুলি কেনার অর্ডার দেন। আর
সিআইএ’র প্রধান
ক্রোয়েশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র
সন্ত্রাসীদের জন্য কেনার সৌদি পদক্ষেপে সহায়তা দেন।
মার্কিন দৈনিকটি আরও জানিয়েছে, ‘আলওয়ার চেনার’ সাংকেতিক নামে এইসব সহযোগিতা বিনিময় হয়েছে সৌদি ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে। রিয়াদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের এ ধরনের ব্যাপক ও দ্বিপাক্ষিক গোয়েন্দা সহযোগিতা চলে আসছে দশকের পর দশক ধরে।
আজ পশ্চিমা ও কয়েকটি আরব সরকার দায়েশ বা আইএসআইএলকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বলে অভিহিত করে আসলেও মূলত
কয়েকটি আরব দেশের গোয়েন্দা
সংস্থা - বিশেষ করে, মার্কিন গোয়েন্দা
সংস্থা সিআইএ ও ইসরাইলি গোয়েন্দা
সংস্থা মোসাদ এবং সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে ২০১১ সালে গড়ে তোলা হয় এই ওয়াহাবি
সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। দায়েশের আজ যে এত
ব্যাপক অস্ত্র ও অর্থ-বল এবং মধ্যপ্রাচ্যে এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যে এত ব্যাপক সহিংসতা ও নৃশংসতা তার জন্ম, বিস্তার ও ক্রম-বিকাশ ইসরাইলি-মার্কিন ও সৌদি সরকারের সর্বাত্মক সহায়তারই ফসল।
দুধ-কলা দিয়ে যে সাপটিকে পশ্চিমারা পুষেছে এতদিন ধরে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদকে
ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তাদের সেই প্রকল্প
৫ বছরের সব চেষ্টার পর ব্যর্থ হলেও দায়েশ নামক সেই সাপ আজ তাদের এবং এমনকি তাদের মিত্রদের জন্যও
দানবীয় হুমকিতে পরিণত হয়েছে। দায়েশের সহযোগী
অন্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য।
দায়েশসহ সিরিয়ার আসাদ-বিরোধী সন্ত্রাসী
গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা দিয়ে এসেছে ইহুদিবাদী ইসরাইল। এ ছাড়াও সৌদি আরব,
কাতার, তুরস্ক ও জর্দানসহ
পশ্চিমা শক্তির সেবাদাস সরকারগুলোও সহায়তা দিয়েছে এইসব ওয়াহাবি-তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে। ইহুদিবাদী
ইসরাইলের যুদ্ধ-মন্ত্রী
মোশে ইয়ালুন সম্প্রতি বলেছিলেন, সিরিয়ায় ইরানের
উপস্থিতি বা প্রভাবের চেয়ে
সেখানে দায়েশের উপস্থিতি ইসরাইলের কাছে বেশি পছন্দনীয়। ইসরাইল চায় দায়েশের মত তাকফিরি-ওয়াহাবি
গোষ্ঠীগুলো মুসলিম, বিশেষ করে ইসরাইলের আশপাশের আরব দেশগুলোতে ছড়িয়ে
পড়ুক যাতে এই দেশগুলো গৃহযুদ্ধের আগুনে জ্বলতে থাকে
এবং ইসরাইল নিরাপদ থাকে।
এদিকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি বলেছেন, সৌদি আরব এখন তেলআবিবকে ‘শত্রুর পরিবর্তে বন্ধু’ হিসেবে দেখে। তিনি আরও দাবি করেছেন, এটি ফিলিস্তিন ইস্যুতে সৌদি নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের আভাস।
সম্প্রতি পাশ্চাত্যের সঙ্গে পরমাণু সমঝোতার জের ধরে তেহরানের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা
উঠে গেছে। শুরু থেকেই ওই সমঝোতার
প্রচণ্ড বিরোধিতা করে এসেছে সৌদি আরব ও ইহুদিবাদী ইসরাইল। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে
ইরানের ভূমিকা জোরদার হবে বলে তারা শঙ্কিত।
গত সপ্তাহে মার্কিন দৈনিক ওয়াল
স্ট্রিট জার্নাল খবর দেয়, ইরানের পরমাণু
সমঝোতার জের ধরে আরব শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক
শক্তিশালী করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে ইসরাইল।
উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী
সৃষ্টি হয়েছে ওয়াহাবি মতবাদকে কেন্দ্র করে যা প্রচার করেন সৌদি আলেমরা এবং বাস্তবায়ন করে সৌদি সরকার। রিয়াদ ও তেল
আবিব প্রকাশ্যে দায়েশের বিরুদ্ধে কথা বললেও এই
মুসলমানদের প্রথম কিবলা ও ফিলিস্তিন দখলদার ইসরাইল এবং সৌদি আরবের বিরুদ্ধে দায়েশ এখন পর্যন্ত কোনো
হামলা চালায়নি। বরং দায়েশের সন্ত্রাসী সেনারা
ইসরাইলি হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা-সেবাও পাচ্ছে।
এটা স্পষ্ট যে দায়েশ বা আইএসআইএল এখনও পশ্চিমাদের নানা এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবেই
ব্যবহৃত হচ্ছে। পশ্চিমাদের
সহায়তাপুষ্ট এই গোষ্ঠী এখন ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের স্টাইলে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর জন্য বিশেষ
ধরনের ড্রোন তৈরি করছে বলে জানা গেছে।
দায়েশ এরই মধ্যে ইরাকে বেশ কয়েকবার ড্রোন ব্যবহার করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। পশ্চিমাদের সহায়তা ছাড়া দায়েশ কখনও ড্রোন বানাতে পারত না। দায়েশ পশ্চিমাদের সহায়তা নিয়েই এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে।
আলকায়দা ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর
আমেরিকায় হামলা চালিয়েছে-এই অজুহাত দেখিয়ে মার্কিন সরকার প্রথমে আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা
করেছিল। রহস্যজনক ওই হামলার সঙ্গে মার্কিন সরকার ও
গোয়েন্দা সংস্থার যোগসাজশ ছিল বলে মনে করা হয়। অন্য কোনো দেশে হস্তক্ষেপের জন্য মার্কিন সরকার
আবারও একই ধরনের নাটক মঞ্চস্থ করতে
পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
ওদিকে ইয়েমেনের সরকারী সেনা মুখপাত্র বলেছেন, ইঙ্গ-মার্কিন ও
ইসরাইলি জঙ্গি বিমান সরাসরি ইয়েমেনে হামলা চালাচ্ছে। কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে
এফ-সিক্সটিনের মত উন্নত জঙ্গি বিমান চালানোর মত দক্ষতা সৌদি পাইলটদের নেই। সৌদি আরব
ইয়েমেনের বিরুদ্ধে আমেরিকার দেয়া নিষিদ্ধ অস্ত্র
ক্লাস্টার বোমা বা গুচ্ছ বোমাও ব্যবহার করে যাচ্ছে। তাই এটা স্পষ্ট মার্কিন, ইসরাইলি ও সৌদি সরকার এখন বিশ্ব-অঙ্গনে
দুষ্কৃতির তিন প্রধান অক্ষে
পরিণত হয়েছে।
দায়েশ ইসলামের নামে ধর্মান্ধতায় লিপ্ত হওয়ায় সরলমনা ও বিভ্রান্ত কিছু ব্যক্তি ছাড়া এখন পর্যন্ত
কোনো দেশেরমুক্তিকামী জনগণ কিংবা কোনো বিপ্লবী ও সচেতন ইসলামী
আন্দোলন বা সংগঠন এই
ওয়াহাবি-তাকফিরি গোষ্ঠীকে সমর্থন দেয়নি।
সম্প্রতি কাশ্মিরের হুররিয়াত কনফারেন্সের চেয়ারম্যান
সাইয়্যেদ আলী শাহ গিলানি বলেছেন, ভারত উপমহাদেশে- বিশেষ করে, কাশ্মিরে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশের প্রতি মুসলমানদের কোনা সমর্থন নেই। তিনি বলেছেন, দায়েশ যদি সত্যিই ইসলাম বা মুসলিম-দরদি
হত তাহলে তারা মুসলমানদের
প্রথম কিবলা আল-আকসা মসজিদকে ইসরাইলের দখল থেকে মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট হত। মজলুম ফিলিস্তিনিরা ছয়
দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসরাইলের মাধ্যমে নির্যাতন, গণহত্যা এবং বিতাড়নের শিকার হয়ে আসছে।
দায়েশ কেবল মুসলিম দেশগুলোর
মুসলমানদের মধ্যে হানাহানি ও সহিংসতারই কারণ হয়েছে বলে তিনি জানান। আর তাই দায়েশের অপরাধযজ্ঞের কারণে
ইসরাইলই লাভবান হচ্ছে বলে গিলানি স্মরণ করিয়ে দেন।
সূত্র: irib