IQNA

মহানবীর (সা) নিরাপত্তা ও ইসলামের প্রসারের জন্য যে মু'মিন ব্যক্তি ঈমান গোপন রেখে মহানবী (সা) ও ইসলামের জন্য অনবদ্য খেদমত করেছেন তাঁর শাহাদাত সম ওফাত বার্ষিকী আজ

10:58 - February 17, 2023
সংবাদ: 3473356
তেহরান (ইকনা): আজ ২৬ রজব ( ১৭ -২-২০২৩ ) শুক্রবার রাসূলুল্লাহর (সা) অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক , সমর্থক এবং সহায়তা প্রদান ও রক্ষাকারী হযরত আবু তালিব ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের ( আ ) শাহাদাত সম ওফাত বার্ষিকী। তিনি এ দিন ৮৬ মতান্তরে ৯০ বছর বয়সে নুবুওয়াতের দশম বর্ষে ইন্তেকাল করেন ।

তাঁর ওফাতের আরো কিছু তারিখ উল্লেখিত হয়েছে । তিনি ( আবূ তালিব ) এবং হযরত খাদীজা ( আ ) ছিলেন ইসলাম ধর্ম প্রচারে ( তাবলীগ ) হযরত রাসূলুল্লাহ ( সা ) ও মুসলমানদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সহায়তাকারী । পবিত্র মক্কা নগরীর অন্যতম প্রধান ও গণ্যমান্য নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তি এবং বনী হাশিমের গোত্রপতি হিসেবে  হযরত আবু তালিব ( আ ) যে বিরল সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থান , প্রতিপত্তি ও মর্য্যাদার অধিকারী ছিলেন তা দিয়ে নিজের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মহানবীকে ( সা ) শারীরিক , মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক ভাবে কুরাইশদের অনিষ্ঠ সাধন থেকে রক্ষা করেছেন এবং হযরত খাদীজা (আ)ও যোগ্য পতিব্রতা সহধর্মিণী হিসেবে মহানবীকে ( সা ) সান্ত্বনা , সার্বিক সহায়তা , সহযোগিতা, মানসিক সমর্থন , সাহচর্য ও উৎসাহ দিয়েছেন এবং নিজের যাবতীয় অর্থ সম্পদ মহানবীর (সা) জন্য , নও মুসলিমদের কল্যাণ সাধনে এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসারে উৎসর্গ করেছেন । রাসূলুল্লাহর ৮ বছর বয়সে দাদা আব্দুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর চাচা হযরত আবু তালিব তাঁর ( রাসূলুল্লাহ) প্রতিপালন ও ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন । 
 
প্রসিদ্ধি ও খ্যাতি লাভ করেছে যে , হযরত আবু তালিবের (আ) সামাজিক, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থন , হযরত খাদীজার (আ) অর্থায়ন এবং যুদ্ধের ময়দান এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ক্রান্তি লগ্ন সমূহে হযরত আলীর (আ) অপার আত্মত্যাগ ও উৎসর্গ অর্থাৎ হযরত আলীর তরবারির কারণে মহানবীর (সা) ইসলাম প্রচার মিশন সফল হয়েছে এবং পবিত্র ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে বিশ্বে । 
রাসূলুল্লাহর (সা) নুবুওয়াত ও রিসালত ঘোষিত হওয়ার ( বে'সাত ) সময় আবূ তালিব ছিলেন ৭৫ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ । কিন্তু কুরাইশী সরদার ও নেতা দের সাথে মহানবীর রিসালত ও ইসলাম প্রচার সংক্রান্ত আলাপ আলোচনা চলাকালে আবূ তালিব আনুষ্ঠানিক ভাবে মহানবীকে সমর্থন দিয়েছিলেন । তিনি মহানবীকে (সা) এতটাই সহায়তা করতেন যে তিনি ও তাঁর স্ত্রী ( ফাতিমা বিনতে আসাদ ) রাসূলুল্লাহর ( সা ) পিতা-মাতা বলে গণ্য হতেন । কুরাইশরা মহানবীর (সা) বদলে আম্মারাহ ইবনে ওয়ালীদ আল - মাখযূমীকে দত্তকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব দিলে আবূ তালিব কুরাইশদের ভর্ৎসনা ও তিরষ্কার করেছিলেন ।
 
হযরত আবু তালিব ( আ ) নিজের ও নিজ সন্তানদের জীবন বিপন্ন করে মহানবী (সা)কে সর্বাবস্থায় বিশেষ করে পবিত্র মক্কার শেবে আবী তালিবে ( আবূ তালিবের উপত্যকায় ) মক্কার কাফির - মুশরিকদের আরোপিত তিন বছরের সর্বাত্মক কঠিন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ ও বয়কট চলা কালীন অবস্থায় রক্ষা করেছেন এবং কুরাইশদের আরোপিত সীমাহীন কষ্ট , ক্লেশ ও যাতনা ভোগে মহানবীর (সা) এর সাথে সমান অংশীদার হয়েছিলেন । অথচ তাঁর ( সা ) অপর এক এক চাচা আবূ লাহাব এ অবস্থায় মহানবী (সা) থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ দূরে রেখেছিল বরং কুরাইশ কাফির মুশরিক দলপতিদের সাথে সহযোগিতা করেছিল এবং মহানবী ( সা ) ও ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে তৎপর ছিল। আর এ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে চাচা হয়েও আবূ লাহাব ছিল মহানবীর (সা) ভয়ঙ্কর শত্রু এবং তাঁর ( সা ) প্রতি ও ইসলামের প্রতি কাফির ( অবিশ্বাসী ) যার প্রমাণ হচ্ছে সূরা -ই আল - মাসাদ ( তাব্বাত ইয়াদা আবী লাহাব ) এবং রাসূলুল্লাহর ( সা ) অপর দুই পিতৃব্য হযরত আবু তালিব ( আ ) ও হযরত হামযা (আ) তাঁর ( সা ) প্রতি এবং ইসলামের প্রতি ছিলেন আন্তরিক ভাবে বিশ্বাসী ( মু'মিন ) এবং নিষ্ঠাবান ত্যাগী ও আত্মোৎসর্গ্যকারী ( ফিদাকার ) এবং এ কারণে তাঁরা অশেষ যাতনা , কষ্ট ও ক্লেশও ভোগ করেছেন। আর ঐ তিন বছরের প্রাণান্তকর বয়কট ও অবরোধের ভয়াবহ চাপের কারণে অল্প কিছু দিনের ব্যবধানে হযরত আবু তালিব ( নুবুওয়তের দশম বর্ষের ২৬ রজব  ) ও হযরত খাদিজা ( আ ) ( নুবুওয়তের ১০ম বর্ষের ১০ রমযান ) মৃত্যু বরণ করেন ।  আর এ কারণেই এ দুই মহান ব্যক্তিত্বের ওফাৎকে শাহাদাত সম ওফাত বলে অভিহিত করা হয়েছে ইসলামের ইতিহাসে ও তারীখে। 
 
এ দুই ঘনিষ্ঠ আপনজন এবং প্রধান সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা দানকারীর মৃত্যুতে মহানবী (সা) অত্যন্ত শোকাভিভূত হয়েছিলেন এবং এ কারণেই এ দুই জনের মৃত্যুর বছরকে ( নুবুওয়াতের দশম বর্ষ ) চির স্মরণীয় রাখার জন্য মহানবী ( সা ) নামকরণ করেছিলেন আমুল হুয্ন্ অর্থাৎ দু:খ ও শোকের বছর । আর মহানবীর এ উদ্যোগ থেকে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিশেষ করে মহানবীর (সা) রেহলাত ( মহাপ্রয়াণ ) , হযরত ফাতিমা যাহরা (আ) , হযরত যাইনাব ( আ ) , হযরত আলী ( আ ) , ইমাম হাসান ( আ ) , ইমাম হুসাইন ( আ ) , এবং আহলুল বাইতের (আ) অন্য সকল মাসূম ইমামের ( আ ) শাহাদাত বার্ষিকী পালন জায়েয ( বৈধ ) হওয়ার বিষয়টিও সমর্থিত ও প্রমাণিত হয়ে যায় । আসলে আবূ তালিব মহানবীর প্রতি ঈমান এনে তা গোপন রেখেছিলেন হযরত মূসার ( আ ) সময় মু'মিন - ই আল - ই ফির'আউনের ( ফির'আউন বংশীয় মুমিন ব্যক্তি ) মতো পবিত্র কুরআনের মতে যিনি নিজের ঈমান গোপন রেখেছিলেন। আর আবু তালিব ঈমান গোপন রেখে মহানবীকে সর্বাত্মক সাহায্য ও সহযোগিতা করতে পেরেছিলেন কুরাইশদের মধ্যে স্বীয় সামাজিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি বজায় রাখার মাধ্যমে । 
 
হযরত আবু তালিব শক্তিশালী সামাজিক অবস্থানে থেকে মহানবীকে ( সা ) হত্যা করা সংক্রান্ত কুরাইশদের যাবতীয় ষড়যন্ত্র ভণ্ডুল করে দিলে কাফির মুশরিক নেতারা মহানবী (সা) এবং বনী হাশিমের বিরুদ্ধে কঠোর সার্বিক অর্থনৈতিক , সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবরোধ আরোপ করে এক ঘরে করেছিল ও নির্বাসনে পাঠিয়েছিল যা তিন বছর স্থায়ী হয়েছিল এবং ইতিমধ্যে তা উল্লেখ করা হয়েছে । হযরত আলীর (আ) প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ , তাকে ঘৃণা এবং তাঁর মর্য্যাদা খাটো করার জন্যই বনী উমাইয়া ও বনী আব্বাসের খেলাফত প্রশাসন হযরত আবু তালিবকে কাফির মুশরিক ( অবিশ্বাসী ) প্রমাণ করার জন্য পবিত্র কুরআনের কতিপয় আয়াতের শানে নুযূলের হাদীস জা'ল করে প্রচার করেছে । 
 
আবু তালিবের স্ত্রী যিনি হযরত আলীর (আ) মা তিনি প্রথম দিককার মুসলমান এবং মহানবীর (সা) রিসালতের ঘোষণার অল্প কিছু দিন পরেই তিনি ঈমান এনেছিলেন এবং আমরা সবাই জানি যে কোনো মুসলিম নারী অমুসলিম পুরুষকে বিবাহ করতে পারে না এবং ঈমান আনা ও মুসলমান হওয়ার পর কোনো মুসলিম নারীও তার কাফির বা মুশরিক অর্থাৎ বিধর্মী অমুসলিম স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে পারে না । অথচ ফাতিমা বিনতে আসাদ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর আবু তালিবের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থেকেছেন এবং তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হন নি । আর এ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে আবূ তালিব ঈমান এনেছিলেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন । তবে তিনি প্রয়োজনের খাতিরে নিজের ঈমান গোপন রেখেছিলেন মুমিন - ই আল - ই ফির'আউনের মতো এবং এ কারণে তিনি ( আবূ তালিব) ছিলেন মু'মিন - ই কুরাইশ ( কুরাইশ গোত্রের মুমিন ) এবং মু'মিন - ই আল - ই হাশিম ( হাশিম বংশের মুমিন )। আর তাঁর পিতা আবদুল মুত্তালিবকে আরবীয় কবিলা ও গোত্র সমূহ মহান ব্যক্তি এবং হযরত ইব্রাহীমের ( আ ) দ্বীন - ই হানীফের প্রচারক হিসেবেই জানত । অতএব এ থেকেও স্পষ্ট হয়ে যায় যে আব্দুল মুত্তালিবের সুযোগ্য উত্তরসূরী আবূ তালিব ও বনী হাশিম এমনকি ইসলামের আবির্ভাবের আগে থেকেই ছিলেন মু'মিন মুওয়াহহিদ ( বিশ্বাসী ও একত্ববাদী ) এবং দ্বীনে হানীফের একনিষ্ঠ অনুসারী। আর হযরত আবূ তালিবের ( আ ) মৃত্যু হলে রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত আলীকে ( আ ) নির্দেশ দেন হযরত আবু তালিবের দেহ গোসল দিয়ে ও কাফন পরিয়ে দাফন করার । 
 
হযরত আবু তালিবকে (আ) পবিত্র মক্কার জুহূন গোরস্থানে তার পিতার পাশে দাফন ( সমাহিত ) করা হয় । আর ইসলামী শরয়ী প্রক্রিয়ায় মহানবী (সা) ও হযরত আলী ( আ ) কর্তৃক হযরত আবু তালিবের জানাযার গোসল দান , কাফন পরিয়ে দাফন ( অর্থাৎ মৃত সৎকার পদ্ধতি ) থেকে প্রমাণিত হয় যে হযরত আবু তালিব (আ) হযরত রাসূলুল্লাহ(সা) এবং ইসলামের প্রতি ঈমান এনেছিলেন ।
 মহানবীর (সা) পৃষ্ঠপোষক ও ইসলামের সুমহান সহায়তা ও সমর্থনদানকারী তাঁর চাচা হযরত আবু তালিব ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশিমের ( আ ) শাহাদাত সম ওফাত দিবস উপলক্ষে সবাইকে জানাই আন্তরিক হুয্ন্ ও তাসলিয়াত ( শোক ও সমবেদনা) । 

ইসলামী চিন্তাবিদ এবং গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান

২৬ রজব ১৪৪৪ হি
captcha