মহান আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ করো, তোমরা ছিলে স্বল্পসংখ্যক, পৃথিবীতে তোমরা দুর্বলরূপে পরিগণিত হতে। তোমরা আশঙ্কা করতে যে লোকেরা তোমাদেরকে অকস্মাৎ ধরে নিয়ে যাবে। অতঃপর তিনি তোমাদের আশ্রয় দেন, স্বীয় সাহায্য দ্বারা তোমাদের শক্তিশালী করেন। আর তোমাদের উত্তম বস্তুগুলো জীবিকারূপে দান করেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও।
’
(সুরা : আনফাল, আয়াত: ২৬)
আমি আপনাদের সামনে সুরা আনফালের একটি বিশেষ আয়াত পাঠ করেছি। আপনাদের এই বৃহৎ জমায়েত দেখে আয়াতটি আমার স্মরণে এসেছে। মহান আল্লাহই যেন আমার অন্তরে ঢেলে দিয়েছেন। আজ এখানে লাখো মানুষ সমবেত হয়েছে।
এমন সুবিশাল সমাবেশের কল্পনা হিজরি প্রথম শতকের মুসলমানরা কখনো করতে পারেনি। যখন বড় যুদ্ধ হয়েছে, যেসব যুদ্ধ এখনো উজ্জীবিত করে। যখন মুসলমানরা আরব উপদ্বীপ ছাড়িয়ে সভ্য পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং বহু জ্ঞানী, গুণী, বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান মানুষ সেসব অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার পরও হিজরি প্রথম শতকে মুসলমানদের প্রকৃত অবস্থা ছিল আয়াতে বর্ণিত অবস্থার মতোই।
কোরআনে মুসলমানদের, যাদের সংখ্যা কয়েক হাজারের বেশি ছিল না, তাদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে, ‘যখন তোমরা সংখ্যায় কম ছিলে, পৃথিবীতে দুর্বল ছিলে এবং সব সময় ভয় পেতে যে তোমাদের ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে, যেন তোমরা খাবারের লোকমা। পৃথিবীর বড় বড় শক্তি তো দূরের কথা, আরব উপদ্বীপ; বরং কুরাইশরা তোমাদের নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। মুসলমানদের অবস্থা কোরআনের অন্য একটি আয়াতেও বর্ণিত হয়েছে, ‘তারা আল্লাহর নুর ফুঁ দিয়ে নেভাতে চায়।’ (সুরা : সাফ, আয়াত : 8)
অর্থাৎ মুসলমানদের জীবনের আলো, ইসলাম নামক প্রদীপের আলো নিভু নিভু অবস্থায় ছিল। ফলে তারা তা নিভিয়ে ফেলতে বিশেষ কোনো আয়োজনের প্রয়োজন নেই, কেবল মুখের ফুৎকারই যথেষ্ট।
আল্লাহ কোরআনের একাধিক স্থানে এমন শব্দ-বাক্য ব্যবহার করেছেন, যার মাধ্যমে মুসলমানের প্রকৃত অবস্থা বোঝা যায়। এরপর আল্লাহ বলেন, ‘তিনি তোমাদের আশ্রয় দেন, স্বীয় সাহায্য দ্বারা তোমাদেরকে শক্তিশালী করেন। আর তোমাদের উত্তম বস্তুগুলো জীবিকারূপে দান করেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও।’ আয়াতে ব্যবহৃত ‘তাইয়িবাত’ শব্দটি ব্যাপকার্থক, যা সাধারণ বসন-ব্যসন থেকে শুরু করে রাষ্ট্র ও রাজত্ব পর্যন্ত সব কিছু অন্তর্ভুক্ত করে। মান, সম্মান, ইচ্ছা, স্বাধীনতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, উন্নয়ন, উন্নতি সব কিছুই উত্তম বস্তুর অন্তর্ভুক্ত। বিপরীতে মুসলমানদের কাছে মহান রবের প্রত্যাশা কেবল তাদের কৃতজ্ঞতা।
আজ এই বিশাল জনসমুদ্রে বসে আপনারা সেদিনের মুসলমানের কথা চিন্তা করুন। সামান্য সংখ্যক মুসলমানকে আল্লাহ তাঁর দয়া ও অনুগ্রহের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ বান্দার নিষ্ঠাপূর্ণ প্রচেষ্টাকে কখনো ব্যর্থ করেন না। আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহে আজ আমরা একটি ছোট কসবায় (উপজেলা মানের অঞ্চল) এত বিপুল সংখ্যায় সমবেত হয়েছি। আরাফার ময়দানে আল্লাহর প্রিয় বান্দা ইবরাহিম (আ.)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা একত্র হই। মূলত আল্লাহর মুখলিস বান্দার আহ্বানে আল্লাহ সম্মোহনী শক্তি রেখেছেন। আল্লাহ মুসলমানের আহ্বানে যে শক্তি রেখেছেন, পৃথিবীর কোনো পরাশক্তি তার অধিকারী হতে পারেনি।
এখন আমাদের বুঝতে হবে, গুণ ও বৈশিষ্ট্য স্বল্পসংখ্যক মুসলমানকে বড় শক্তির বিরুদ্ধে বিজয়ী করেছিল। তাদের শূন্য থেকে পৃথিবীর নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছিল। আমি আরবদের লক্ষ্য করে বলেছিলাম, ইসলাম তোমাদের শূন্য হাত পূর্ণ করে দিয়েছে। আর এ কথা আমি ভারতবর্ষের লোকদের বারবার বলি। ভারতবর্ষের লোকেরা কি ইসলাম-পূর্ব ভারতের কল্পনা করতে পারবে? তারা কোথায় ছিল এবং ইসলাম তাদের কোথায় নিয়ে এসেছে? আমরা কখনো মুসলিম জাতির অন্তর্নিহিত শক্তির কথা চিন্তা করেছি? পৃথিবীর হাজারো ঝড়-তুফান ও প্লাবনের মধ্যে কিভাবে টিকে আছি?
আপনারা ভারতবর্ষের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখুন। এই ভূমিকে বলা হয় ‘রাক্ষসী ভূমি’ এবং ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে এই রাক্ষসী প্রবণতা বিদ্যমান। এটা বলার কারণ হলো অতীতে যত জাতি-গোষ্ঠী ভারতে আগমন করেছে তাদের সবাই বিলীন হয়ে গেছে। তাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছে। ঠিক যেমন ‘যা কিছু লবণের গুদামে পড়ে তা লবণ হয়ে যায়’। তাদের বংশধারাকে কোনোভাবেই সমাজ থেকে পৃথক করা যায় না। বিপরীতে মুসলমান এমন এক জাতি, তারা হাজার বছর ধরে ভারতে তাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পেরেছে। তারা এটা পেরেছে নিষ্কলুষ একত্ববাদের বিশ্বাস, মহানবী (সা.)-এর আনুগত্য, আল্লাহর অস্তিত্বের সামনে সব শক্তিকে অস্বীকার করা এবং অন্তরে মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসা ধারণ করার কারণে। এগুলোই ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম জাতির অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস।
আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা নিজেদের বিশ্বাস ও পরিচয়কে জীবনে ধারণ করুন, আত্মসম্মান ও ব্যক্তিত্ববোধ নিয়ে চলুন। আমরা মুসলমান- এই পরিচয় দিতে আমাদের কোনো সংকোচ নেই। আমার পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, ইসলামের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যের সঙ্গেই থাকব এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত। কোনো মুসলমানের জীবনের চূড়ান্ত প্রত্যাশা কখনো ‘নিরাপদ ব্যক্তিজীবন’ হতে পারে না। শুধু ব্যক্তিগত জীবন তো পশুর জীবন, আমরা এমন জীবন প্রত্যাখ্যান করব, হাজারবার প্রত্যাখ্যান করব। আমরা পৃথিবীর আকাশে-বাতাসে আজান-ইকামতের ধ্বনি ছড়িয়ে দিতে চাই। তাহাজ্জুদ, তারাবি ও ইশরাকের মাধ্যমে নিজের পরিচয়কে আরো উজ্জ্বল করতে চাই। আমাদের জীবনের সর্বত্র সুন্নতে নববীর চাপ থাকবে। মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিত সামনে রেখে আমরা আমাদের জীবনের নকশা তৈরি করব, বরং জীবনের নকশা সংশোধন করে নেব। এ ছাড়া আমাদের জীবনের আর কোনো নকশা নেই, নেই আমাদের কোনো পরিচয়।
তামিরে হায়াত থেকে আলেমা হাবিবা আক্তারের ভাষান্তর