IQNA

ইরানে ইসলামি বিপ্লবের ৪১ বছর; মার্কিন ষড়যন্ত্রের নানা দিক: পর্ব-দুই

20:17 - February 24, 2020
সংবাদ: 2610292
তেহরান (ইকনা) ১৯৮০ সালের ৮ এপ্রিল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন করার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার ১৬ দিন পর ইরানের হাতে আটক মার্কিন গুপ্তচরদের উদ্ধারের জন্য অভিযান চালাতে আমেরিকা তাবাস মরুভূমীতে সেনা সমাবেশ ঘটায়। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ঝড়ের কবলে পড়ে মার্কিন হেলিকপ্টারগুলো অকেজো হয়ে পড়ে এবং এ ঘটনায় আট মার্কিন সেনা নিহত ও পাঁচজন আহত হয়।

ওই ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর আমেরিকা ১৯৮০ সালের জুলাইয়ে ইরানের ইসলামি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযানের চেষ্টা চালায়। এ পরিকল্পনার আওতায় কথা ছিল হামেদানের বিমান ঘাঁটি থেকে কিছু বিমান উড়ে এসে তেহরানে ইমাম খোমেনী (র.)এর বাসভবন, পার্লামেন্ট, রেডিও টেলিভিশন ভবন ও বিমান ঘাঁটিগুলোতে বোমা বর্ষণ করবে এবং পাশ্চাত্য সমর্থনপুষ্ট ব্যক্তিদেরকে ক্ষমতায় বসাবে। কিন্তু এ অভিযান শুরুর মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে ইরানের বিপ্লবীরা তা ব্যর্থ করে দেয়।

মার্কিন সরকার যখন দেখল ইরানে সরাসরি সামরিক অভিযান কিংবা অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা চালিয়েও কোনো লাভ হয়নি তখন তারা ইরানের বিরুদ্ধে পরোক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ লক্ষ্যে আমেরিকা ইরাকের সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দামকে দিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। প্রকৃতপক্ষে, সামরিক অভিযান ও অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইরানের ইসলামি সরকার ব্যবস্থাকে উৎখাত করতে ব্যর্থ হওয়ার পর কার্টার সরকারের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডমন্ড মাস্ককি সীমান্ত পার হয়ে সরাসরি ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা উত্থাপন করেন। আমেরিকা এ ক্ষেত্রে সাদ্দামকে ব্যবহার করেছিল কারণ সাদ্দামও ইরানের ইসলামি সরকারের বিজয় এবং ইসলামি বিপ্লব রপ্তানির ব্যাপারে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা রুবিগনিউ ব্রেজেনিস্কি আসন্ন যুদ্ধে ইরাককে প্রস্তুত করার জন্য গোপনে জর্দান, ইরাকসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোতে সফর করেছিলেন। সমস্ত প্রস্তুতি শেষ করে আমেরিকার সমর্থন নিয়ে সাদ্দাম ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে ইরানের বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধ শুরু করেছিল যা আট বছর ধরে চলে।

ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন শত্রুতার আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে, ইরান বিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সুসংগঠিত করা ও তাদেরকে সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা দেয়া। সাদ্দামকে দিয়ে ৮ বছর ধরে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েও ইরানের ইসলামি সরকার ব্যবস্থাকে উৎখাত করতে না পেরে আমেরিকা এ দেশটির ক্ষতি করার জন্য ভিন্ন পন্থা বা কৌশল অবলম্বন করে। এ লক্ষ্যে তারা ইরান বিরোধী মোনাফেকিন গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসীদেরকে সহায়তা দেয়া শুরু করে। সাবেক মার্কিন শীর্ষ কূটনীতিক জন ক্রুইজ প্রথমবার ইরানের ইসলামি সরকারকে উৎখাত করার জন্য বিভিন্ন গ্রুপকে সহযোগিতার গোপন উদ্দেশের কথা স্বীকার করেন। অবশ্য ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর থেকেই আমেরিকা সন্ত্রাসী মোনাফেকিন গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছিল। এদের সহযোগিতায় মার্কিন সরকার ইরানের অভ্যন্তরে ব্যাপক নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালায় এবং বিপ্লবী সরকারের বহু গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে হত্যা করে। মার্কিন সমর্থন নিয়ে সন্ত্রাসীদের ওই গুপ্ত হামলায় ১৭ হাজারের বেশি ইরানি শাহাদাত বরন করেন।


আরও পড়ুন:

ইরানে ইসলামি বিপ্লবের ৪১ বছর; মার্কিন ষড়যন্ত্রের নানা দিক: পর্ব-এক


ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকারের শত্রুতার আরেকটি পন্থা হচ্ছে দেশটির বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা ও নরম যুদ্ধ চালানো যাতে ইসলামি সরকার ব্যবস্থা ভেতর থেকেই ধ্বসে পড়ে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার পর আমেরিকার ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান মার্ক পলমার ইরান-মার্কিন সম্পর্ক বিষয়ক এক প্রতিবেদনে ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার নরম যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেন। তিনি ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক হামলার কৌশলের বিরোধিতা করে বলেছেন, ভৌগোলিক অবস্থান, বিপুল জনসংখ্যা, দক্ষ জনশক্তি, সামরিক শক্তি, প্রাকৃতিক সম্পদ প্রভৃতি ইরানকে নজিরবিহীন আঞ্চলিক পরাশক্তিতে পরিণত করেছে। তাই সামরিক হামলা চালিয়ে এ রকম একটি দেশের সরকার ব্যবস্থাকে উৎখাত করা সম্ভব নয় বরং একমাত্র পথ হচ্ছে প্রচার ও নরম যুদ্ধ চালানো। ইরানের বিরুদ্ধে নরম যুদ্ধ চালানোর মাধ্যমে আমেরিকা দেশটির অর্থনীতিকে ধ্বংস ও গণঅসন্তোষ তৈরি করা, ব্যাপক সংখ্যক বেসরকারি সংস্থা গড়ে তোলা, প্রচার যুদ্ধ চালানো, ইসলামি সরকারকে অকার্যকর হিসেবে তুলে ধরা, নাগরিক আন্দোলন গড়ে তোলার নামে সরকারকে দুর্বল করা, ধর্মীয় বিশ্বাসকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের শাসনামল থেকে পশ্চিম এশিয়ায় যে প্রক্সিযুদ্ধ শুরু হয়েছে তার পেছনে তারা এ পর্যন্ত সাত ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। ইরানের প্রতিরোধ শক্তি এবং এ অঞ্চলে দেশটির সামরিক শক্তি ও প্রভাব বিস্তারের কারণে ওয়াশিংটন সরাসরি হামলার সাহস হারিয়ে ফেলেছে। এ কারণে ইরান ও এ অঞ্চলের প্রতিরোধ শক্তির বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধের কৌশল হিসেবে আমেরিকা উগ্র আইএস সন্ত্রাসীদেরকে লেলিয়ে দেয়। সিরিয়া ও ইয়েমেনের বিরুদ্ধে আইএস সন্ত্রাসীদের লিলিয়ে দেয়া ছাড়াও ইরাকের অভ্যন্তরে গোলযোগ বাধানো ও ওই দেশটিকে খণ্ডবিখণ্ড করার চেষ্টা করছে আমেরিকা যাতে ইরান কেন্দ্রিক প্রতিরোধ শক্তি কোনোভাবেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে এবং ইরানও যাতে দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু শত্রুদের ধারণার বিপরীতে ইরানসহ এ অঞ্চলের প্রতিরোধ শক্তিগুলো দুর্বল তো হয়নি বরং আগের চেয়ে আরো শক্তিশালী হয়েছে।

ইরানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য মার্কিন সরকারের কৌশল ব্যর্থ হওয়ার পর এখন তারা সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। গত ৩ জানুয়ারি ইরাকের রাজধানী বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি'র কুদস ব্রিগেডের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানি ও তার সহযোগীদেরকে হত্যার ঘটনা এর প্রমাণ। পেন্টাগন জানিয়েছে, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই হত্যাকাণ্ডের পর ট্রাম্প দাবি করেছিলেন সোলাইমানি নাকি ইরাকে মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর চেষ্টা করছিলেন।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী সোলাইমানি হত্যাকে কাপুরুষোচিত হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, 'এটা আমেরিকার জন্য কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে।

জেনারেল সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা থেকে বোঝা যায়, ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার শত্রুতা তো কমেনি বরং তা অব্যাহত রয়েছে। আসল কথা হচ্ছে মার্কিন সরকার ইরানের ইসলামি বিপ্লবী শাসন ব্যবস্থা ও দেশটির স্বাধীন নীতির তীব্র বিরোধী এবং কেবল সংলাপের মাধ্যমে এ বিরোধের অবসান ঘটবে না।
সূত্র: parstoday

captcha