IQNA

উস্তাদ ফারশচিয়ানের চিত্রকর্মে লুকিয়ে থাকা রহস্যগুলো কী?

22:20 - August 14, 2025
সংবাদ: 3477890
ইকনা- উস্তাদ মাহমুদ ফারশচিয়ান, ইরানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমকালীন শিল্পী এবং ইরানি চিত্রকলা ও মিনিয়েচার শিল্পের প্রতীক। তাঁর শিল্পকর্ম শুধু ইরানেই নয়, বরং বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এবং সমকালীন শিল্পে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

১৯২৯ সালে ইরানের কেন্দ্রস্থল ইসফাহান শহরে জন্মগ্রহণ করা ফারশচিয়ান ছোটবেলা থেকেই শিল্প ও চিত্রকলায় আগ্রহী ছিলেন। সহজাত প্রতিভা এবং নিরলস সাধনার মাধ্যমে তিনি ইরানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পীতে পরিণত হন।

এক কিংবদন্তির যাত্রা

শৈশবেই তাঁর শিল্পযাত্রা শুরু হয়। আঁকাআঁকিতে তার আগ্রহ দেখে তার বাবা তাকে নিয়ে যান ইসফাহানের প্রখ্যাত নকশাচিত্রশিল্পী হাজ মির্জা আগা ইমামির কাছে। ঐতিহ্যবাহী চিত্রকলায় পারদর্শী ইমামি ভালোবাসা ও যত্নের সঙ্গে ছোট্ট এই শিক্ষার্থীকে শিল্পের প্রাথমিক পাঠ দেন এবং তাঁর প্রতিভাকে লালন করেন।

উস্তাদ মাহমুদ ফারশচিয়ান

কৈশোরে ফারশচিয়ান ভর্তি হন ইসফাহান ফাইন আর্টস স্কুলে, যেখানে তিনি কামাল আল-মুলকের অন্যতম শিষ্য উস্তাদ ঈসা বাহাদুরীর অধীনে শিক্ষা নেন। বাহাদুরি তাকে মিনিয়েচার, তেলচিত্র, কার্পেট ডিজাইন এবং স্বর্ণলিপি শিল্পকর্ম শিখিয়েছিলেন, যা তাঁর সৃজনশীলতাকে আরও উজ্জীবিত করে।

ফারশ্চিয়ানের মিনিয়েচার ও স্বর্ণলিপি শিল্পকর্ম অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও নান্দনিক। তিনি প্রাণবন্ত রঙ ও অনন্য কৌশলে ইরানের সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতাকে ফুটিয়ে তোলেন। তাঁর প্রতিটি চিত্রকর্ম একটি গল্প বলে, যা দর্শককে পারস্যের রূপকথার জগতে নিয়ে যায়।

অমর শিল্পকর্ম:

'আশুরার বিকেল' থেকে ইমাম হুসাইনের (আ.) রওজা পর্যন্ত

ফারশচিয়ান শতাধিক চিত্র সৃষ্টি করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে আশুরার বিকেল, জামিনে আহু (হরিণের জামিনদার), শামস ও মাওলানা, স্তব, শামে গারিবান, এবং সৃষ্টির পঞ্চম দিন। তিনি ফেরদৌসীর শাহনামা, ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত এবং হাফিজের দেওয়ান–এর জন্যও অলংকরণ এঁকেছেন।

'সৃষ্টির পঞ্চম দিন' শিরোনামের চিত্রকর্ম

'আশুরার বিকেল' চিত্রকর্মটি আবেগপূর্ণভাবে কারবালার ঘটনাকে তুলে ধরে, যা দর্শকের মনে গভীর শোক ও বেদনা সৃষ্টি করে। শামস ও মাওলানা–তে প্রতিফলিত হয়েছে ইরানি প্রেম ও আধ্যাত্মিকতা, আর জামিনে আহু–তে ফুটে উঠেছে শিল্পীর নিজস্ব আরোগ্যের গল্প ও ইমাম রেজা (আ.)–এর প্রতি তাঁর তাওয়াসসুল।

তিনি ইমাম হুসেইন (আ.), ইমাম রেজা (আ.) এবং কারবালার শহীদদের মাজারগুলোর পবিত্র জালি ডিজাইন করেছেন। তাঁর শিল্পকর্ম ইরান, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং এশিয়ার শতাধিক প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছে।

উস্তাদ মাহমুদ ফারশচিয়ান

'জামিনে আহু': অনুপ্রেরণার প্রতিচ্ছবি ও আরোগ্যের গল্প

ফারশচিয়ানের অন্যতম আবেগময় কাজ 'জামিনে আহু', যা তিনি এক কঠিন চিকিৎসাজনিত অভিজ্ঞতার পর আঁকেন। ১৯৭৯ সালে, ফারশ্চিয়ানের ডান হাত স্নায়ুর সমস্যায় অকেজো হয়ে যায়। ডাক্তাররা তাঁকে আর কখনো না আঁকার পরামর্শ দেন। কিন্তু ইমাম রেজা (আ.)-এর নামে মানত করে তিনি অলৌকিকভাবে সুস্থ হন। তাঁর ভাষ্যমতে, তিনি স্বপ্নে তিন রাত ধরে ইমাম রেজা (আ.)–এর মুখ দেখেন এবং ইমাম তাঁকে বলেন: “আমাকে আঁকো!” অবশেষে তিনি সেই মুখাবয়বকে চিত্রে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হন। ১৯৭৯ সালে অ্যাক্রিলিক–অন–বোর্ড কৌশলে আঁকা এই চিত্রটি বর্তমানে মাশহাদের ওস্তানে কুদসে রাজাভি জাদুঘরে সংরক্ষিত এবং এটি তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় কাজগুলোর একটি।

'জামিনে আহু': অনুপ্রেরণার প্রতিচ্ছবি ও আরোগ্যের গল্প

ধর্মীয় শিল্পে নিবেদিতপ্রাণ 

ফারশচিয়ান বহুবার বলেছেন, তাঁর কাছে ধর্মীয় শিল্প একটি দায়িত্ব ও আল্লাহপ্রদত্ত সৌভাগ্য। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইমাম রেজা (আ.)–এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভরসা তাঁকে তাঁর সকল ধর্মীয় কাজ 'ওস্তানে কুদস রাজাভি জাদুঘর'-এর জন্য ওয়াকফ করতে অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর কথায়—“আমি কোনোদিন ধর্মীয় কাজের জন্য অর্থ নেইনি, সবই আস্তান কুদস রাজাভির ওয়াকফ। এটি আমার জন্য এমন এক সম্পদ যা কখনো শেষ হবে না।”

ফারশচিয়ান তাঁর শিল্পের মাধ্যমে শুধু শিল্পক্ষেত্রে নয়, মানুষের হৃদয়েও বিশেষ স্থান দখল করেছেন। প্রতিটি চিত্রের মাধ্যমে তিনি গল্প বলেন এবং আমাদের নিয়ে যান সৌন্দর্য ও কল্পনার রাজ্যে। তাঁর কাজ বিশ্বজুড়ে শিল্পী ও শিল্পপ্রেমীদের অনুপ্রেরণা জোগাতে থাকবে।

এক মহান শিল্পীর বিদায়

উস্তাদ মাহমুদ ফারশচিয়ান ২০২৫ সালের ৮ আগস্ট ৯৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি আমৃত্যু শিল্প সৃষ্টি করে গেছেন, রেখে গেছেন অসংখ্য ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক শিল্পকর্ম। তাঁর মৃত্যু ইরানের শিল্পজগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি।#

পার্সটুডে

captcha