IQNA

স্মরণীয় আলেম ও আধ্যাত্মিক সাধক আয়াতুল্লাহ বাহজাত (র)

23:22 - May 30, 2016
সংবাদ: 2600873
গত ১৬ মে ছিল ইরানের প্রখ্যাত আলেম এবং আধ্যাত্মিক সাধক ও বিশেষজ্ঞ আয়াতুল্লাহ মুহাম্মাদ তাকি বাহজাত (রহ.)’র সপ্তম মৃত্যু-বার্ষিকী। তাঁকে সমসাময়িক যুগের বিজ্ঞ ফকিহ বা ইসলামী আইনবিদ ও বহুমুখী প্রতিভাধর আলেমদের মধ্যে আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক পূর্ণতার দিক থেকেও একজন শীর্ষস্থানীয় তারকা বলে মনে করা হয়।

বার্তা সংস্থা ইকনা:  বিশ্বনবী (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের আদর্শের গভীর অনুরাগী আয়াতুল্লাহ বাহজাতের অসাধারণ খোদাভীতি এবং আত্মশুদ্ধি ও খোদামুখী আধ্যাত্মিক-সাধনার চর্চা তাঁকে দিয়েছিল এইসব ক্ষেত্রে এক অনন্য শিক্ষকের মর্যাদা।

আলেম বা জ্ঞানী হওয়া সহজ কিন্তু ইসলামী জ্ঞানের ভিত্তিতে আমল-আখলাককে মার্জিত ও উন্নত করার জন্য খোদাভীতির কোনও বিকল্প নেই। আর আত্ম-সংশোধন ছাড়া যে সমাজকে বা অন্যদের সংশোধন করা সম্ভব নয় তার ওপর বিশেষভাবে জোর দিতেন আয়াতুল্লাহ বাহজাত। তাঁর মধ্যে খোদাভীতি ও খোদা-প্রেম ছিল এতই প্রবল যে নামাজের জামাআতের ইমামতি করার সময়ও তিনি চেপে রাখতে পারতেন না অন্তরের গভীর থেকে গুমরে-ওঠা কান্না। আয়াতুল্লাহ বাহজাত ছিলেন খোদামুখী মানুষদের জন্য সাধনা, অনুপ্রেরণা ও উৎসাহের এক বড় উৎস এবং এক মহান সেতু-বন্ধন।

নবী-রাসুলদের পর নিষ্পাপ ইমাম ও ন্যায়পরায়ন সাহাবা এবং তাদের অনুসারী যোগ্য আলেমরাই হলেন মানুষকে ইসলামের পথে এগিয়ে নেয়ার সবচেয়ে বড় অবলম্বন। এ ধরনের যোগ্য আলেমদের দিক-নির্দেশনা ছাড়া ইসলামী জ্ঞান ও শিক্ষা এবং ঈমানের বিকাশ অসম্ভব হয়ে পড়ত। 

মহান আল্লাহর মনোনীত নেতাদের অনুপস্থিতিতে যোগ্য আলেমরাই হলেন মুসলমানদের হৃদয়ের চিকিৎসক ও তাঁদের অন্তরের রাজা। তাঁরাই হলেন মুসলিম উম্মাহ-রূপ বিশাল কিশতির কাণ্ডারি ও মাঝি-মাল্লা। ফলে তাঁদের যোগ্যতা, ন্যায়-নিষ্ঠা ও মানব-প্রেমের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে তাঁরা মহান আল্লাহর প্রতি আন্তরিক বলেই মানুষের অন্তরেও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই জেগে ওঠে। মরহুম আয়াতুল্লাহ বাহজাতের ক্ষেত্রেও এইসব সত্য ও বাস্তবতা অত্যন্ত প্রোজ্জ্বল হয়ে আছে। সুরা মারিয়ামের ৯৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদের জন্য দয়াময় আল্লাহ মানুষের হৃদয়ে ভালবাসা জাগিয়ে দেবেন।

আয়াতুল্লাহ মুহাম্মাদ তাকি বাহজাতের জন্ম হয়েছিল ১৯১৬ সালে উত্তর ইরানের ফুমেন শহরের এক ধার্মিক পরিবারে। ১৬ বছর বয়সে তিনি স্নেহময়ী মাকে হারান। পিতা মাহমুদ বাহজাত কারবালায়ি ছিলেন একজন সৎ, সমাজসেবক ও ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে সুপরিচিত। তিনি বিশ্বনবীর (সা) আহলে বাইতের বিশেষ করে শহীদদের নেতা ইমাম হুসাইন (আ)’র শানে প্রশংসাসূচক ও শোক গীতির চর্চা করতেন।

শৈশবেই জ্ঞান-পিপাসু বাহজাতের মধ্যে ফুটে উঠেছিল ধার্মিকতা ও জ্ঞান-প্রতিভার নানা চিহ্ন। নিজ ঘরেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের পর তিনি একই শহরে অর্থাৎ ফুমেন শহরেই ধর্মীয় শিক্ষা চর্চা শুরু করেন। ১৪ বছর বয়সে তিনি ইরাকের পবিত্র কারবালা শহরে যান এবং সেখানে প্রায় চার বছর থাকেন। এ সময় তিনি আত্মশুদ্ধির চর্চায় নিয়োজিত হন। একই সময়ে তিনি ইরাকের কয়েকজন বড় আলেমের কাছে ধর্মীয় আইনের মূলনীতি বা উসুল ও ফিকাহ বা ধর্মীয় আইন বিষয়ে ব্যাপক পড়াশুনা করেন।

জ্ঞান-পিপাসু বাহজাত কেবল উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষা লাভের জন্যই আকুল ছিলেন না। উচ্চতর মানবীয় গুণ অর্জনের লক্ষে আল্লাহর ওলিদের সাহচর্য লাভের জন্যও তিনি ব্যাকুল ছিলেন। নৈতিকতা ও আত্মিক উন্নয়নের প্রখ্যাত শিক্ষকদের কাছ থেকে তালিম নেয়ার জন্য তিনি ১৮ বছর বয়সে ইরাকের পবিত্র নাজাফ শহরে যান। এখানে তিনি প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক ও আলেম আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী কাজী তাবাতাবায়ির (র) শাগরেদ হন। আয়াতুল্লাহ কাজী এই উৎসাহী ছাত্রকে বিশেষ যত্ন নিয়ে তালিম দিতে থাকেন। ফলে খুব শিগগিরই মুহাম্মাদ তাকি বাহজাত ইরফান বা আধ্যাত্মিক সাধনার এক উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যান।

এভাবে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার এক উচ্চ পর্যায় শেষ করার পর তিনি ১৯৪৫ সালে ইরানে ফিরে আসেন এবং পবিত্র কোম শহরে বসবাস করতে থাকেন। এখানে তিনি প্রখ্যাত আলেম ও শিক্ষক আয়াতুল্লাহ বরুজেরদিসহ (র) কয়েকজন প্রখ্যাত আলেমের কাছ থেকে শিক্ষা নিতে থাকেন। এরপর আয়াতুল্লাহ বাহজাত নিজেও ফিকাহ ও উসুল বিষয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। তিনি গড়ে তোলেন অনেক সুযোগ্য ছাত্র ও আলেম। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আয়াতুল্লাহ বাহজাত উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষা দানের পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

আত্মিক উন্নয়নের লক্ষে কুপ্রবৃত্তির সঙ্গে তথা নফসের বিচিত্র খাহেশগুলোর সঙ্গে যে জিহাদ সেই বড় জিহাদে জয়ী হওয়ার জন্য অবিরাম প্রচেষ্টা ও সাধনা জরুরি বলে উল্লেখ করতেন আয়াতুল্লাহ বাহজাত। আত্মিক পরিশুদ্ধি ছাড়া কেবলই জ্ঞান অর্জনকে তিনি ভয়ানক বিপদজনক বলে মনে করতেন। এ দু’টি দিককে সমান তালে এগিয়ে নেয়ার ওপর জোর দিতেন তিনি।

নিখাদ ও আন্তরিক খোদা-প্রেমের পথিক হিসেবে ধন-সম্পদ, পদমর্যাদা, খ্যাতি ও দুনিয়ার অন্যান্য আকর্ষণকে এড়িয়ে চলতেন আয়াতুল্লাহ বাহজাত। পার্থিব আকর্ষণগুলোর ভেতরকার কদর্যতা ও ক্ষতিগুলোকে হৃদয়ের চোখ দিয়ে দেখতে পেতেন তিনি। বিনম্রতা, অল্পে তুষ্টি ও সহজ-সরল জীবন ছিল তাঁর ভূষণ। নিয়মিত নফল ইবাদত, অত্যধিক জিকর ও রাত জেগে ইবাদত করা ছিল এই আধ্যাত্মিক সাধকের কয়েকটি অসাধারণ অনুকরণীয় বৈশিষ্ট্য।

আয়াতুল্লাহ বাহজাত (র) ইজতিহাদ বা ইসলামী আইন বিষয়ে গবেষণার ভিত্তিতে মতামত দেয়ার ক্ষেত্রে সর্বজনস্বীকৃত ব্যাপক যোগ্যতা এবং সুনাম অর্জন করা সত্ত্বেও ততদিন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত বিষয়ে তার মতামত কোনও বইয়ে তুলে ধরার অনুমতি দেননি যতদিন তার চেয়েও বয়স্ক এবং তাঁর দৃষ্টিতে বেশি অভিজ্ঞ মুজতাহিদরা কোম শহরে উপস্থিত ছিলেন। অবশ্য আলেম সমাজের বার বার অনুরোধের পর তিনি তার ফতোয়াগুলোকে ছাপার অক্ষরে প্রকাশের অনুমতি দেন। তবে তিনি তাঁর জীবদ্দশায় ইসলামী আইন বিষয়ক নিজের ফতোয়া ও মতামত প্রদান এবং এ বিষয়ক বই সরবরাহের জন্য অর্থ গ্রহণের অনুমতি দেননি।  এমনকি যেসব মজলিস বা সভা তার উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হত সেসব সভায় তার নাম তুলে ধরা বা তার সম্পর্কে প্রশংসাসূচক কিছু বলতেও তিনি বক্তাদের নিষেধ করতেন।

আয়াতুল্লাহ বাহজাত (র) মুসলমানদের অবস্থার উন্নতির ব্যাপারে সচেতন ছিলেন এবং ইসলামী জাগরণের জন্য উৎসাহ দিতেন ও শত্রুদের ওপর নির্ভর করা বা তাদের ওপর বিশ্বাস রাখার ব্যাপারে সতর্ক করে দিতেন। ইসলামী ঐক্যের ওপর ব্যাপক জোর দিতেন এবং অনৈক্যের ধ্বংসাত্মক পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করতেন।

আয়াতুল্লাহ বাহজাত (র)’র উপদেশ ও বক্তব্য সত্য-সন্ধানী যুব সমাজকে আকৃষ্ট করত। তিনি তাদের বলতেন,

‘বয়স্ক ও কম বয়স্ক সবারই এটা জানা উচিত যে আল্লাহর দাসত্ব করার মধ্যেই রয়েছে মানুষের ইহকালীন ও পারলৌকিক মুক্তি আর সৌভাগ্য। আর দাসত্ব বা বন্দেগির জন্য দরকার হল পাপ-বর্জন। চিন্তাগত ও কর্মগত পাপ-দুইই বর্জন করতে হবে। যা জানি তা যেন আমল করি। আর যে বিষয়ে জ্ঞান নেই সে বিষয়ে স্পষ্ট জ্ঞান অর্জন না করা পর্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। মানুষের মধ্যে এই প্রতিজ্ঞা যখন দৃঢ় ও স্থায়ী হবে মহান আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেন ও সফল করবেন।’  সূত্র: পার্সটুডে

captcha