আল-ফুরাত নিউজ–এ রেজা মোহসেন আল-হাকিম–এর লেখা একটি নোটে বলা হয়েছে: প্রতি বছর সফর মাসের শুরু থেকে আরবাঈনের দিন পর্যন্ত ইরাকে যে আরবাঈন জিয়ারত অনুষ্ঠিত হয়, তা উদারতা, দানশীলতা ও মহত্ত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এই উদারতা কেবল ইরাকি আতিথেয়তায় সীমাবদ্ধ নয়; বরং বিশ্বজুড়ে আহলে বাইতের (আ.) বহু অনুরাগী নিজেদের সঞ্চয়, শক্তি, এমনকি সন্তানদের অংশগ্রহণ পর্যন্ত, এবং নিজেদের বাড়ি ও হুসাইনিয়াগুলোকে ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর জিয়ারতকারীদের সেবায় উৎসর্গ করেন।
এই জিয়ারত কুরআনের ওই আয়াতের বাস্তব প্রতিফলন: “তোমরা কখনও কল্যাণে পৌঁছাবে না যতক্ষণ না তোমরা সেইসব জিনিস ব্যয় করো যা তোমরা ভালোবাসো” (আল-ইমরান ৯২)।
অতএব, প্রকৃত নেককারিতা পেতে হলে মানুষকে তার প্রিয় জিনিস দান করতে হয়। আরবাঈন জিয়ারতে এটা স্পষ্ট দেখা যায়—যেখানে আতিথেয়তা প্রদানকারী পূর্ব পরিচয় ছাড়াই, এমনকি অতিথির চিন্তাধারা বা মতবাদ না জেনেও, কেবল তিনি ইমাম হুসাইন (আ.)–এর জিয়ারতকারী বলেই নিজের ঘরে আমন্ত্রণ জানায় এবং সর্বোচ্চ মাত্রার উদারতা ও দানশীলতা প্রদর্শন করে।
আধ্যাত্মিক দিক:
যারা আরবাঈনের জিয়ারতকারীদের সেবা করেন, তারা প্রত্যেক বছর নিজেদের রিজিক ও বরকতে বৃদ্ধি অনুভব করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:
“তোমরা যা কিছু ব্যয় করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা জানেন” (আল-বাকারা ২৭৩)।
অতএব, আল্লাহর পথে ব্যয় কখনও হারায় না; বরং দুনিয়াতেই বহু গুণ বৃদ্ধি পায় এবং আখিরাতে তার প্রতিদান পাওয়া যায়।
পরিসংখ্যানগত দিক:
আধা–আধি সরকারি সূত্র জানায়, মোট আরবাঈন জিয়ারতকারীদের প্রায় ৮০% ইরাকি, যা তাদের ব্যাপক উপস্থিতির প্রমাণ। অংশগ্রহণের হার ৩৭% থেকে ৪২%–এর মধ্যে পরিবর্তিত হয়, যা দেখায় এই জিয়ারত কেবল একটি গোষ্ঠী বা জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—বরং সব মত ও সম্প্রদায়কে একত্র করে ইমাম হুসাইন (আ.)–এর পথে যুক্ত করে।
এছাড়া, জিয়ারতের পথে নিবন্ধিত মুকিবের সংখ্যা প্রায় ১৩,০০০–এ পৌঁছেছে, যার মধ্যে ২৫০টি (মোটের ২%) ছিল অ-ইরাকি। গত বছর এই বিপুল সংখ্যক মুকিব ২৫ মিলিয়নেরও বেশি জিয়ারতকারীর খাবার ও প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সরবরাহ করেছে।
জনগণের দিক:
উলামায়ে কেরাম জোর দিয়ে বলেন, জিয়ারতের গণআঙ্গিক সংরক্ষণ জরুরি—যাতে এটি শুধুমাত্র কোনো আনুষ্ঠানিক কাঠামো বা প্রতিষ্ঠান–নির্ভর না হয়। এই জিয়ারতের শক্তি নিহিত রয়েছে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে, যা ইরাক ও সারা বিশ্বে অনুষ্ঠিত হয়। এটি গভীরভাবে মানুষের হৃদয়ে প্রোথিত হুসাইনী আজাদারীর জীবন্ত রূপ, যা তাদের ইসলামি প্রতিশ্রুতি দৃঢ় করে।
আল্লাহ বলেন: “যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের সম্মান করে, নিশ্চয়ই তা অন্তরের তাকওয়া থেকে” (আল-হাজ্জ ৩২)।
এই জিয়ারত দলগত কাজ, সম্মিলিত উদ্যোগ ও মানবতার বিশাল সমাবেশ পরিচালনার দক্ষতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ—যা নবী করীম (সা.)–এর হাদিস “আল্লাহর হাত জামাতের সঙ্গে থাকে”–এর বাস্তব প্রতিফলন।
নৈতিক দিক:
আরবাঈন সমাজকে নৈতিক ও মানবিক দিক থেকে পুষ্ট করে। অধিকাংশ জিয়ারতকারী সর্বোচ্চ পর্যায়ের ঈমান ও ভ্রাতৃত্ববোধে একে অপরের সেবা করে। এখানে ভ্রাতৃত্বের জীবন্ত রূপ দেখা যায়—যেখানে ভাই ভাইয়ের জন্য আত্মোৎসর্গ করে, একে অপরের প্রতি মমতা প্রদর্শন করে, এবং জিয়ারতকারীদের চাহিদা পূরণে প্রতিযোগিতা করে।
এটি আল্লাহর বাণীর প্রতিফলন: “তোমরা নেকি ও তাকওয়ায় একে অপরকে সাহায্য করো, আর পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অপরকে সাহায্য করো না” (আল-মায়িদাহ ২)।
ইমাম হুসাইন (আ.)–এর পথে সহযোগিতা, মর্যাদাপূর্ণ প্রতিযোগিতা ও সৎকর্মে অগ্রগামিতা সুস্পষ্ট।
উলামা ও ফকিহগণ আরবাঈন জিয়ারতের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে অগ্রগামী। তারা এই জিয়ারতের প্রতিষ্ঠাতা ও পথপ্রদর্শক, যাদের মধ্যে অনেকে মৃত্যুদণ্ড বা কারাবাসের মাধ্যমে জীবন উৎসর্গ করেছেন। কুরআন বলে: “আল্লাহকে তাঁর বান্দাদের মধ্যে কেবল আলেমগণই ভয় করে” (ফাতির ২৮)।
আরবাঈন এমন এক মানসিকতা গড়ে তুলেছে যে ইমাম হুসাইন (আ.)–এর দরবারে সবাই সমান। বয়স্ক ও তরুণ, ধনী ও গরিব, পাপী ও পরহেজগার—যে–ই হোক, সবাই “ইমাম হুসাইন (আ.)–এর খাদেম” নামে পরিচিত হয়। এই দৃশ্য হজের কথা মনে করিয়ে দেয়—যেখানে সবাই একই পোশাকে, দুনিয়ার ভোগ–বিলাস ত্যাগ করে, একই স্থানে ও একই সময়ে আল্লাহর ইবাদত করে, আল্লাহর পথে বিনয়ী হওয়ার স্বাদ অনুভব করে।
ইমাম হুসাইনের নাম সব উপাধির ঊর্ধ্বে, আর যে কেউ তাঁর সাথে সম্পর্কিত হতে পেরে এবং তাঁর ছায়াতলে সেবা করতে পেরে গর্বিত বোধ করে।
বিশ্বের নানা জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ সামাজিক ও জাতিগত বিভেদ দূর করতে, পারস্পরিক সংবেদনশীলতা কমাতে এবং ভালোবাসা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। একে বলা যায় আরবাঈনের “সামাজিক কূটনীতি”—যা ভ্রাতৃত্ব ও ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি করে, মতপার্থক্য ভুলে মানুষকে একত্রিত করে। এটি রাজনৈতিক কূটনীতির মতো—যেখানে আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রসমূহের দ্বন্দ্ব সমাধান হয়—কিন্তু এখানে তা জনগণের মধ্যে ঘটে।
আরবাঈন জিয়ারত কোনো ক্ষণস্থায়ী বার্ষিক অনুষ্ঠান নয়; বরং অংশগ্রহণকারীদের পরিচয়ের প্রকাশ, মানবতা, ভালোবাসা ও দানশীলতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এখানে এমন সব দৃশ্য দেখা যায়—যেখানে বিনয় ও দানশীলতা অন্য কোনো উপলক্ষে দেখা যায় না। এসব দৃশ্য দৃষ্টিভঙ্গি ও হৃদয়ের দূরত্ব কমায় এবং এক প্রকার ধর্মীয়–সামাজিক রঙে রঞ্জিত কূটনৈতিক কার্যক্রমে পরিণত হয়।
ইমাম হুসাইন (আ.)–এর প্রতি ভালোবাসা সুখের মাধ্যম, আর তাঁর আন্তর্জাতিক বিদ্যালয়ে বিনয়ী হওয়া গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক। 4298554#