বার্তা সংস্থা ইকনা: এই নিবন্ধে এক জাপানি নারীর সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে; যিনি মুসলিম পুরুষকে বিয়ে করার পর ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছেন।
ভালবাসা, ক্যারিয়ার এবং বিয়ে
তুর্কি নাগরিক মোহাম্মদ আলী জেরেজ তার স্ত্রী ইউরিকে নিয়ে ডিনার করতে ‘কাপলস রেস্টুরেন্ট’ বসে আছেন। ২০১৬ সালে টোকিওর নাকানো স্টেশনের কাছেই ছোট আকারের এই কাবাবের দোকানটি চালু করেন তারা।
ইউরি জাপানের একটি প্রধান আবাসন কোম্পানির একজন স্থপতি। যদিও তিনি ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছেন, তবে সাধারণত মুসলিম নারীদের মতো তিনি সবসময় হিজাবে তার মাথা ঢেকে রাখেন না।
তিন বছর আগে একটি রেস্টুরেন্টে এই দম্পতির প্রথম পরিচয় ঘটে। খাবার খেতে রেস্টুরেন্টটিতে তারা প্রায়ই যেত। এই কারণে তাদের নিয়মিত দেখা হতো এবং খাবার নিয়ে তারা প্রায়ই আলোচনা করত এবং তাদের এই আলোচনা থেকে প্রেম এবং শেষ পর্যন্ত বিয়ের পিঁড়িতে।
সম্পর্কের শুরুতে ইউরি জানতেন না যে আলী একজন মুসলিম। এব্যাপারে ইউরি বলেন, ‘তিনি যে মুসলিম (মোহাম্মদ আলী) তা আমাকে বলেননি। আমি লক্ষ্য করতে পারি টেবিলে রাখা কিছু খাবার সে খাচ্ছিল না। এরপর অবশেষে আমি তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করি।’
ইসলাম নিয়ে অধিকাংশ জাপানি নাগরিকের সীমিত জ্ঞানের কারণে আলী তার বিশ্বাস সম্পর্কে কাউকে কিছু বলতেন না। ইউরি বলেন, ‘জাপানিরা ভুল বুঝতে পারে- এই ভয়ে তিনি অন্য লোকদের সামনে আলী প্রার্থনাও করতেন না।’
ইউরি স্বীকার করেন যে যখন আলীর সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় হয়, তখন মুসলিমদের সম্পর্কে একটি বিষয়ে নিশ্চিতভাবেই জানতেন যে মুসলিমরা শূকরের মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকেন।
তিনি জানান, মিডিয়ায় উপস্থাপন করা নেতিবাচক চিত্রগুলি ইসলাম সম্পর্কে তার ধারণাকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু তার স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক তাকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে একটি ভিন্ন ধারণা দিয়েছে।
যে জিনিসটি তাকে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত করেছিল, সেটি হচ্ছে আলীর সৌজন্যতাবোধ। একবার, ইউরিকে একটি মশা চট করে মারার জন্য প্রস্তুতি দেখে আলী সেটি হত্যা না করে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তাকে প্ররোচিত করেছিলেন। এমনকি বিরক্তিকর মাছিগুলোকে ধরে সেগুলো বাইরে ছেড়ে দিতেন তিনি।
ইউরি বলেন, ‘তার পরিশুদ্ধতা এবং আন্তরিকতা আমাকে বিস্মিত করেছিল। এটা আমাকে বুঝাতে সহায়তা করেছে যে, মিডিয়ায় মুসলিমদের নিয়ে প্রায়ই যে সংবাদ প্রচার করা হয়, তা থেকে তারা অনেক আলাদা।’
একটি ব্যক্তিগত পছন্দ
তাদের বিবাহপূর্ব সম্পর্ক ও বিয়ের পুরোটা সময়জুড়ে আলী তাদের সম্পর্কের আধিপত্য থেকে তার ধর্ম বিশ্বাসের বিষয়ে সতর্ক ছিলেন। যখন তারা বিয়ে নিয়ে আলোচনা শুরু করেন, তখন ইউরি আলীর কাছে জানতে চেয়েছিল যে বিয়ের পর তাকে শূকরের মাংশ খাওয়া ত্যাগ করা উচিৎ হবে কিনা। যদিও আলী দৃঢ়তার সঙ্গে তাকে বলেছিল যে বিষয়টি নিয়ে তার কোনো কথা নেই। তাকে বলছিলেন যে তাকে প্রথমে তার নিজের লাইফস্টাইলকে অনুসরণ করা উচিত।
আলীর দৃষ্টিতে, আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক নির্মাণ নিয়ে কারো ওপর একজন ব্যক্তির মতামত চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়। আলীর এই দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইউরি তার নিজের ইচ্ছায় ইসলাম নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। তিনি অবশেষে শূকরের মাংস এবং অ্যালকোহল পান ছেড়ে দেন। এমনকি শূকরের মাংসের সংস্পর্শে আসা যাবতীয় রান্না-সরঞ্জাম রান্নাঘর থেকে সরিয়ে ফেলেন।
কমিউনিটি বন্ধন তৈরি
ইউরি জানান, জাপানে মুসলিমরা কি ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন- আলীর সঙ্গে তার সম্পর্কের কারণে তিনি এখন তা ভালভাবেই অনুধাবন করতে পারছেন। এই দম্পতি যখন তাদের রেস্টুরেন্ট চালু করেন, তখন ইউরি দোকান চালানোর জন্য এমন স্পেসের সন্ধান করেন অর্থাৎ প্রার্থনার জন্য যাতে একটি রুম সংযোজন করতে পারে- যেখানে আলী ও মুসলিম গ্রাহকরা স্বাচ্ছন্দ্যে প্রার্থনা করতে পারেন।
ইউরি তার কর্মজীবনে সাংস্কৃতিক প্রত্যাশার সঙ্গে তার বিশ্বাসের ভারসাম্য রক্ষা করে চলেন। ইউরি বলেন, ‘হিজাব পরিধান করা এবং আমার সময়সূচীতে থেকে প্রার্থনার জন্য সময় বের করার বিষয়টি বিবেচনা করেছি, কিন্তু জাপানের কর্ম পরিবেশের জন্য এটি কার্যকারী মনে করি নাই।’
তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ জাপানি বিশ্বাসের মৌলিক ধারণা বিবেচনা করে, আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম যে আমার সহকর্মীরা এবং আমার চারপাশের অন্যরা অস্বস্তি বোধ করবে। তাই আমি প্রার্থনার জন্য যখন মসজিদে যাই, কেবল তখনই হিজাব পরিধান করি।’
জাপানি সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বামীকে সংহত করার জন্য ইউরি আলীকে সহায়তা করছেন। এই দম্পতি নিয়মিত প্রতিবেশীর বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান করেন এবং তাদের রেস্টুরেন্টের জন্য স্থানীয় দোকান থেকে উপাদানসামগ্রী কিনেন। এটি প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার স্বামীকে সংহত করতে সহজ করেছে।
ইউরি বলেন, তিনি তার স্বামীর কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে ধীরে ধীরে শিখছেন এবং আশা করছেন যে একদিন আলী ও অন্যান্য মুসলিমদের জন্য জাপানে বসবাসের আরো ভাল সুযোগ তৈরি হবে। আরটিএনএন