বার্তা সংস্থা ইকনা: যেসব মুসলিম পিতামাতা অপেক্ষাকৃত কম উন্নত দেশসমূহ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়ে এসেছেন তারা সেখানে অনেকটা পিছিয়ে পড়াদের কাতারে থাকেন। আর যে সকল মুসলিম যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম গ্রহণ করেছেন তাদের বেশিরভাগই সেখানে সংখ্যালঘুর কাতারে পড়ে থাকেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ মুসলিম অভিভাবকই তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে চিন্তায় থাকেন।
ইসলামিক নাকি সাধারণ বিদ্যালয়?
অভিভাবকদের সামনে সাধারণত দুটো পছন্দ থাকে। আর তা হচ্ছে- তারা হয় তাদের সন্তানদের ইসলামিক বিদ্যালয়ে পাঠাবেন, না হয় সাধারণ বিদ্যালয়সমূহে পাঠাবেন। তবে যখন ইসলামিক বিদ্যালয়ে পাঠানোর কথা আসে তখন অভিভাবকেরা অনেক সময় তাদের সন্তানদের জন্য ঘরোয়া বিদ্যালয় খুঁজে নেন।
এসব বিদ্যালয়ে গতানুগতিক শিক্ষার সাথে ইসলামের বিভিন্ন মাজহাবের শিক্ষা দেয়া হয় এবং প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয়। অভিভাবকদের এমন সিদ্ধান্তের সুবিধা এবং অসুবিধা দুটোই রয়েছে।
যে সব পিতামাতা ঘরোয়া বিদ্যালয় পছন্দ করেন তারা হয়ত সেখানে গভীর জ্ঞান এবং অধ্যয়নের জন্য পরিবেশ খুঁজে পান না। আর যারা ফুল-টাইম ঘরোয়া বিদ্যালয় পছন্দ করেন তারা সেখানে অভিজ্ঞতার অভাব, যোগ্য শিক্ষকের অভাব, ভুল শিক্ষা পদ্ধতি এবং শিক্ষা উপকরণের অভাব ইত্যাদি দেখতে পান।
আর অন্যদিকে যেসব পিতামাতা তাদের সন্তানদের জন্য সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সেটি হতে পারে সরকারি বা কোনো বেসরকারি বিদ্যালয় পছন্দ করেন, তারা অনেক সময় তাদের সন্তানদের সহপাঠীদের বা শিক্ষক দ্বারা বৈষম্য ও বর্ণবাদ ইত্যাদির শিকার হওয়ার মত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন।
একই সাথে এসব বিদ্যালয়ে এমন সব বিষয়যুক্ত থাকে যা তাদের ধর্মীয় এবং সংস্কৃতি-গত মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক।
তথাপি সন্তানদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের ৬৬(সূরা আত-তাহরিম) নম্বর সূরার ৬ নম্বর আয়াতে বলে দিয়েছেন।
মানুষের পৃথিবীর জীবন এবং তার মন যথেষ্ট জটিল প্রকৃতির। এমনকি অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের জন্য সবচেয়ে উত্তম শিক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য যে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তা সামাজিক এবং রাজনৈতিক আবহাওয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে।
সংস্কৃতিগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদেরকে একটি মুসলিম পরিচালিত বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য সেখানে বসবাসরত অন্য মুসলিমদের দ্বারা চাপের সম্মুখীন হয়ে থাকেন।
আমি বিশ্বাস করি এর একটি ভিত্তি আছে। আর তা হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলিমগণ সেখানে তাদের মধ্যকার একটি শক্তিশালী সমাজ গড়ে তুলতে একই সাথে তাদের সন্তানদেরকে এর সাথে যুক্ত করতে এমন উদ্যোগ নিয়ে থাকেন।
মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে আমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করতে আদেশ দিয়েছেন। এই আদেশ শুধুমাত্র আমার নিজের জন্যই নয়, বরং এই আদেশ আমার পরিবারের উপরেও প্রযোজ্য।
মুসলিম হিসেবে আমাদের জীবন অন্য মুসলিমদের থেকে আলাদা নয়। মুসলিম সমাজের স্বার্থ আমাদের সবাইকে প্রভাবিত করে।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না। নিশ্চিতরূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ ( সুরা বাকারা ২:২০৮ )
সুতরাং মুসলিম সমাজের অভিজ্ঞতা নিয়েই আমরা ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করতে পারবো। তবে যেসব মুসলিম পিতামাতা তাদের সন্তানদেরকে মুসলিম পরিচালিত বিদ্যালয়ে পাঠাতে চান না, তাদের এমন সিদ্ধান্তেরও কিছু যুক্তি আছে।
এটি হতে পারে অনেকগুলো বৈধ কারণে, যেমন- অর্থনৈতিক অবস্থা, দূরত্ব, শিক্ষকদের যোগ্যতা ইত্যাদি। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সকল মুসলিম একটি দৃঢ় মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য অতোটা সহযোগিতা করেন না।
তবে এসব ইসলামিক বিদ্যালয়গুলোর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেক বিদ্যালয়ে শুধুমাত্র ইসলামের কঠিন কোনো মাজহাবের সাথে সম্পৃক্ত থাকে যা হয়ত নিকটে বসবাস করা কোনো মুসলিম পরিবারের মাজহাবের সাথে মিলে না।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মুসলিম বিদ্যালয় একে অন্যকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং বর্ণের জন্য সমালোচনা করে বিভেদ তৈরি করে। এই বিষয়টি একেবারেই কম নয় বরং ৯০ শতাংশ মুসলিম বিদ্যালয়ে শুধুমাত্র একই মাজহাবে বিশ্বাসী শিক্ষার্থীদের সুযোগ দেয়া হয়।
এ বিষয়টি যতই আড়াল করতে চেষ্টা করা হোক না কেন যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমদের জন্য এটি একটি লজ্জাজনক দিক।
আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়ে আসা মুসলিমদের চাইতে সেখানে জন্ম গ্রহণ করা মুসলিমদেরকে আনুপাতিক হারে অবশ্যই তাদের নিজেদের গোত্রগত ধারণা থেকে বের হয়ে আসা উচিত।
বিশ্বাস, সংস্কৃতি এবং গোত্র
যুক্তরাষ্ট্রের একটি শহরে আফ্রিকান-আমেরিকান মুসলিমদের দ্বারা একটি ইসলামিক বিদ্যালয় চালু করা হয়েছে। বিদ্যালয়টির উদ্যোক্তাদের অধিকাংশেরই শিক্ষাক্ষেত্রে ২৫ বছরের বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিদ্যালয়টি চালু করা হয়েছে এমন একটি স্থানে যেখানকার মুসলিমগণ বিভিন্ন জাতি এবং গোত্র থেকে এসেছেন।
এভাবে বিভিন্ন জাতি এবং দেশ থেকে আসা মুসলিম অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদেরকে ইসলামিক বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে কাছের কোনো সরকারি বা বেসরকারি বিদ্যালয়ে পাঠাতে শুরু করেছেন।
কিছু পিতামাতা সংস্কৃতিগত ভাবেই আমেরিকান হয়ে গেছেন। তারা যুক্তরাষ্ট্রের বৈচিত্র্যে বিশ্বাস করেন এবং তাদের সন্তানদেরকে ধর্মীয় পরিচয়ের চাইতেও আমেরিকান পরিচয়ে বড় করতে ভালোবাসেন।
অন্যদিকে যেসব পিতামাতা যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়ে এসেছেন তারা আমেরিকান সমাজের সাথে মিশে যেতে প্রাণপণ চেষ্টা করে থাকেন এবং এর অংশ হিসেবে তারা তাদের সন্তানদেরকে স্থানীয় বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে থাকেন।
আর কিছু মুসলিম পিতামাতার হাতে কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় তারা তাদের সন্তানদেরকে স্থানীয় বিদ্যালয়ে পাঠাতে বাধ্য হন।
যে কারণেই মুসলিম পিতামাতারা তাদের সন্তানদের জন্য এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা পছন্দ করে থাকেন তাদেরকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। যেমন, তাদের অনেকে স্থানীয় বিদ্যালয়সমূহের নীতির সাথে নিজেদেরকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন অথবা তারা স্থানীয় রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন।
যেসব অভিভাবক বিদ্যালয়গুলোর নীতির সাথে খাপ খাইয়ে চলার জন্য সিদ্ধান্ত নেন তারা সচরাচর পরিবর্তনে আগ্রহী নন। আর যারা রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন তারা বিদ্যালয়সমূহের নেয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাদের উদ্বিগ্নতা জানিয়ে থাকেন।
তারা বিদ্যালয়ের দুপুরের খাবার থেকে শুকরের মাংস পরিহার করতে, রমজান মাসে শারীরিক শিক্ষামূলক অনুশীলন বাদ দিতে এবং বিদ্যালয়ে মুসলিম মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করারসহ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে বিদ্যালয়গুলোকে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করে থাকেন।
এ সব পিতামাতা শিক্ষকদের সাথে একসাথে কাজ করতে ভালোবাসেন এবং বিদ্যালয়ের ছুটির তালিকায় মুসলিম ছুটির দিনগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করাতে চেষ্টা করেন। তথাপি, এ ধরনের অভিভাবকেরা সচরাচর বৈষম্য এবং বর্ণবাদের শিকার হয়ে থাকেন।
সত্যি কথা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের পিতামাতাদের জন্য সঠিক একটি শিক্ষা পদ্ধতি খুঁজে বের করা কঠিন একটি ব্যাপার। আর তাদের সন্তানদের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা পদ্ধতির বিষয়ে সঠিক দিক নির্দেশনা পেতে এই মুহূর্তে মুসলিম পিতামাতাদের সালাতুল-ইস্তিখারার নামাজ আদায় করা প্রয়োজন। যাতে করে তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুপথ প্রাপ্ত হন।
সূত্রঃ এবাউট ইসলাম ডট নেটে প্রকাশিত মহসিন সামসিদ্দীন নামক গবেষকের কলাম থেকে।