IQNA

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা সম্পর্কে আমরা কতটা জানি?

0:03 - February 19, 2021
সংবাদ: 2612269
তেহরান (ইকনা): "দেখুন, আমাদের মধ্যেতো আত্মীয়তার সম্পর্ক হতে যাচ্ছে। সবই ফাইনাল। বিষয়টা হলো আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আপনার স্ত্রীও তাই। আপনাদের সার্বিক অবস্থা ভালো। কিন্তু আমার অবস্থাতো সে রকম নয়। আমার বইগুলো ছাড়া বাসার সব কিছু জমা করলে একটা পিকআপেই জায়গা হয়ে যাবে। আমার বাসভবনের ভেতরে দু'টি রুম, বাইরে আরেকটা রুম আছে সেখানে দেশের কর্মকর্তারাসহ বিভিন্ন লোকজন আসেন আমার সঙ্গে বৈঠক করতে। বাড়ি কেনার মতো টাকা আমার নেই।

একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছি, সেখানে একটা ফ্লোরে মোস্তাফা থাকে। আর অন্য ফ্লোরে থাকে মোজতাবা। আপনি একটু আপনার মেয়ের সঙ্গে কথা বলুন। সে যেন এমনটা না ভাবে যে দেশের সর্বোচ্চ নেতার পুত্রবধূ হতে যাচ্ছে। না জানি কত কী! কিন্তু আমাদের জীবনযাপন এরকমই। আপনাদের অবস্থাই তুলনামূলকভাবে আমাদের চেয়ে ভালো। আপনার মেয়েকে এসব বিষয় একটু খুলে বলবেন।"

ইরানের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. হাদ্দাদ আদেলের মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে সম্পন্ন করার আগে হবু বেয়াইয়ের কাছে এভাবেই নিজের আর্থিক ও পারিবারিক অবস্থা বর্ণনা করেছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী।

এই কথোপকথন ১৯৯৯ সালের কোনো এক সময়ের। এরও ১০ বছর আগে আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। সর্বোচ্চ নেতার পদ গ্রহণের আগে দুই মেয়াদে ইরানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। এরও আগে সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছেন ইরানের ইসলামী বিপ্লবের এই নেতা। কিন্তু ভোগ-বিলাসিতার আতিশয্য তাঁকে কখনোই স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর সততা, পবিত্রতা ও দানশীলতায় মানুষ বিস্মিত।

আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর ছয় সন্তান: চার ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলেদের চারজনই আলেম। উচ্চশিক্ষিত ছয় সন্তানের কাউকেই সরকারি-বেসরকারি কোনো পদে ঢুকতে দেননি এবং অর্থনৈতিক তৎপরতায় জড়াতে দেননি সর্বোচ্চ নেতা। বড় দুই ছেলেই ইরাক-ইরান যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ইরাক যুদ্ধে নিজের এক নাতিকে হারিয়েছেন আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী। ইরাকের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে তিনি নিজেও সৈনিকের পোশাক পরে ফ্রন্ট লাইনে অংশ নিয়েছেন।

১৯৮০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি প্রথম যুদ্ধে যান। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে যখন বিদায় নেন তখন একবারের জন্যও ভাবেননি যুদ্ধ থেকে অক্ষত ফেরা সম্ভব হবে। ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি সেই মুহূর্তের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- "যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আবার ফিরব এমন কোনো আশা আমার মধ্যে ছিল না। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, আর ফেরা হবে না। আমার মনে আছে, আমি যখন ঘর-বাড়ি ও বউ-বাচ্চাদের দিকে তাকাচ্ছিলাম তখন শেষ বিদায় ধরেই নিয়ে সব কিছু দেখছিলাম। আমি ভেবেছিলাম এটাই শেষ যাওয়া, তাদের সঙ্গে আর দেখা হবে না।"

আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর সঙ্গে যারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন তাদের অনেকেরই আর ফেরা হয়নি। ইসলামী বিপ্লবী ইরানের ইতিহাসের আরেক প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব ও প্রথম প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোস্তফা চামরান তাদের অন্যতম। মোস্তফা চামরান ও আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীকে একইদিনে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন ইমাম খোমেনী (রহ.)। মোস্তাফা চামরান পরবর্তীতে শহীদ হন।

যুদ্ধ থেকে অক্ষত ফিরলেও ১৯৮১ সালের ২৭ জুন বড় ধরণের বোমা হামলার শিকার হন আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী। তেহরানের আবুজার মসজিদে বক্তৃতা দেওয়ার সময় টেবিলে পেতে রাখা এক বোমায় মারাত্মকভাবে আহত হন। তিনি ঐ বিস্ফোরণ থেকে কোনো ক্রমে বেঁচে যান। সবচেয়ে বেশি আঘাত পান ডান হাত ও ডান পায়ে। কয়েক দফা অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হয়ে উঠলেও ডান হাত আজও পুরোপুরি ঠিক হয়নি। তাঁর ডান হাতটি এখনও অবশ বলেই মনে হয়। সেদিন আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর বেঁচে যাওয়াকে অলৌকিক ঘটনা বলে মনে করেন অনেক প্রত্যক্ষদর্শী। সেদিনের হামলা পরবর্তী অনুভূতি প্রসঙ্গে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন-

"মনে হলো মরেই যাচ্ছি। পুরোপুরি বুঝতে পারছিলাম যে, আমার প্রাণ নিয়ে নেওয়া হচ্ছে, আমি চলে যাচ্ছি। এ সময় হঠাৎ মনে হলো, আমি যে মরে যাচ্ছি আখিরাতের জন্য সঙ্গে করে কী নিয়ে যাচ্ছি? বাস্তবে যেন আমি একটা খড়ের টুকরোর মতো জমিন ও আসমানের মাঝাখানে ভাসছিলাম। একদম কোথাও সংযোগ ছিল না। হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। বললাম, হে পারওয়াদিগার আমি আপনার কাছে ফিরছি।"

একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে বলেই হয়তো অলৌকিকভাবে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসেন আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী। ইরানে বিপ্লব বিজয়েরও প্রায় ১১ বছর আগের কথা। হঠাৎ একরাতে আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী স্বপ্নে দেখলেন ইমাম খোমেনী ইন্তেকাল করেছেন। আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী তার স্মৃতিকথায় সেই স্বপ্নের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-

"স্বপ্নে দেখলাম ইমাম খোমেনী ইন্তেকাল করেছেন। এ সময় বিশ থেকে ত্রিশ জন ব্যক্তি- যাদের মধ্যে আমিও ছিলাম- মরদেহের সঙ্গে সামনে এগিয়ে যেতে থাকি। এক সময় মরদেহ একটি টিলায় পৌঁছে যায়। বেশিরভাগ মানুষ টিলার নীচে থেকে যায়। মাত্র চার-পাঁচ জন মরদেহ নিয়ে টিলার উপরে উঠে যায় এবং আমিও তাদের সঙ্গে টিলায় উঠি। সাধারণত মাটিতে দাঁড়িয়ে টিলার উপরিভাগকে নীচের তুলনায় ছোট মনে হয়; কিন্তু মানুষ যখন সেখানে পৌঁছায় তখন সে টিলার চূড়াকে অনেক বড় ও বিস্তৃত দেখতে পায়। কিন্তু আমার স্বপ্নে ওই টিলার চূড়াকে নীচ থেকে যেমন দেখা গিয়েছিল উপরে ওঠার পরও তেমনি ছোট মনে হয় এবং আমি দেখতে পাই সেখানে একটি ছোট খাট রাখার মতো জায়গা রয়েছে। আমরা কফিনকে সেখানেই রাখি। আমি বিদায় নেয়ার জন্য মরদেহের পায়ের কাছে আসি এবং ইমামের মুখের দিকে তাকাই। হঠাৎ দেখি ইমামের ডান হাত নড়ে উঠেছে ও মুষ্টিবদ্ধ হাতে তিনি তর্জনী তাক করে আছেন এবং তাঁর হাতটি ক্রমেই উপরের দিকে উঠছে। বিস্ময় ও ভয়ে আমার আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে। এরপর দেখি ইমাম চোখ বন্ধ রেখেই উঠে বসার চেষ্টা করছেন; এ সময় তার তর্জনী আমার কপাল পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং তাঁর তর্জনীর সঙ্গে আমার কপালের স্পর্শ অনুভব করি। আমি বিস্মিত ও হতবিহবল অবস্থায় গোটা দৃশ্য অবলোকন করতে থাকি। এ অবস্থায় ইমামের ঠোট নড়ে ওঠে এবং তিনি দু’বার বলেন: তুমি ইউসুফ হবে, তুমি ইউসুফ হবে।"

এই স্বপ্নের প্রায় ১১ বছর পর ইরানে ইসলামী বিপ্লব সফল হয়। বিপ্লবের প্রায় দুই বছর পরই আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রবল জনপ্রিয়তা ও ব্যাপক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দুটিই পান তিনি। এরপর বিপ্লবের স্থপতি ইমাম খোমেনীর ইন্তেকালের পর সবচেয়ে সম্মানজনক আসনটির জন্য তাঁকেই নির্বাচন করেন নির্বাচকমণ্ডলী। এ যেন সেই স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন। নবী ইউসুফ (আ.) দাসত্বের জীবনসহ নানা পরীক্ষা ও প্রতিকূলতা জয় করে আল্লাহর রহমতে মিশরের ক্ষমতার শীর্ষে আসীন হতে হয়েছিলেন। আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর জীবনের একটা বড় অংশও পার হয়েছে এমন প্রতিকূলতা ও পরীক্ষার মধ্যদিয়ে।

পবিত্র কুরআনের সূরা ইউসুফে বলা হয়েছে, 'আমি ইউসুফকে সে দেশের বুকে প্রতিষ্ঠা দান করেছি। সেখানে সে যেখানে ইচ্ছা স্থান করে নিতে পারত। আমি নিজের রহমত যাকে ইচ্ছা পৌছে দেই এবং আমি পূণ্যবানদের প্রতিদান বিনষ্ট করি না।' এই সূরারই অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘হে আমার রব! আপনি আমাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছেন।'
লেখক: রেডিও তেহরানের সিনিয়র সাংবাদিক

captcha