IQNA

মোগল জৌলুসের মলিন আখ্যান বাহাদুর শাহ

13:58 - July 12, 2021
সংবাদ: 3470301
তেহরান (ইকনা): ১৮৫৭ সালে বেনিয়াদের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠল : খালক-ই খুদা, মুলক-ই বাদশাহ, হুকুম-ই সিপাহি অর্থাৎ সৃষ্টিকুলে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, বাদশাহর রাজত্ব এবং সিপাহির কর্তৃত্ব। দেশপ্রেমিক সিপাহিরা বাহাদুর শাহকে ভারতের স্বাধীন সম্রাট ঘোষণা করে ‘দেওয়ান-ই খানোসে’ সম্মাননা জানায়।

বাহাদুর শাহ ছিলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতিভু। দুই ধর্মের হাজার হাজার সিপাহি স্বাধীনতাসংগ্রাম তথা সিপাহি বিদ্রোহে যোগ দেয়। চার মাস পর ব্রিটিশরা স্বাধীনতাসাংগ্রামীদের স্তব্ধ করে দেয়। ব্রিটিশরা অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক, আলিম-উলামা, সুফি-দরবেশকে নির্দয়ভাবে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড দেয়। তাঁদের ঝুলিয়ে দেওয়া হয় বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্কের বড় বড় গাছের ডালে।

১৮৫৮ সালের মাত্র কয়েক দিনের প্রহসনমূলক বিচারে বাহাদুর শাহকে নির্বাসনে দণ্ডিত করা হয়। ইয়াঙ্গুনের বিখ্যাত শোয়ে ডন প্যাগোডার পূর্বপাশে ৬ জিওয়াকা সড়কের সেনাছাউনির একটি বাড়িতে বাহাদুর শাহ ও তাঁর স্বজনদের রাখা হয়।

বাহাদুর শাহ ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ও সাহিত্যমনষ্ক। ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডালরিম্পিল তাঁর ‘লাস্ট মুঘল’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘বাহাদুর শাহ একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তিনি ইসলামী শিল্পরীতিতে পারদর্শী, তুখোড় কবি এবং সুফি-পীর...।’

বাহাদুর শাহ ‘জাফর’ ছদ্মনামে সাহিত্যচর্চা করতেন। তাঁর বিখ্যাত গজল বা ‘মুশায়িরাত’ (কবিতাগুচ্ছ) আজও ইয়াঙ্গুনে গীত হয়। জীবনের অন্তিম সময়ে এক কঠিন বাস্তবতার কল্পচিত্র রচনা করেছিলেন বাহাদুর শাহ। মানবজীবন সম্পর্কে এ এক অনন্য আত্মোপলব্ধি। তাঁর ভাষায় : ‘উমর দরাজ মাঙগঁকে লায়েথে চাঁর দিন,/দো আরজু মে কাটগায়ে, দো ইন্তেজার মেঁ।’ অর্থাৎ ‘চার দিনের জন্য আয়ু নিয়ে এসেছিলাম,/দুদিন কাটলো আকাঙ্ক্ষায় আর দুদিন অপেক্ষায়।’

অপমান, অভাব ও পক্ষাঘাতের মতো দুরারোগ্য অসুস্থতার মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে তাঁর জীবন। মোগল আভিজাত্যের সঙ্গে মর্যাদহীন ‘সম্রাট’ উপাধিকে উপহাস করে চরম বিষাদ-বিষণ্নতায় বাহাদুর শাহর কঠিন উচ্চারণ : ‘ইয়ে মুঝে আফছার-ই-শাহানা বানায়া হোতা/ইয়ে মেরা তাজ গাদাইয়্যানা বানায়া হোতা।’

অর্থাৎ ‘আপনি আমাকে রাজাদের প্রধান করা উচিত অথবা,/পরিবর্তে আপনি আমাকে একটি মুকুট,/যা এক ভিক্ষুক পরতে পারে দেওয়া উচিত।’

মোগল আভিজাত্যের সঙ্গে জীবনের অসার-অসহায়ত্ব যখন বাহাদুর শাহকে দারুণ মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছিল, তখন তিনি তা প্রকাশ করলেন অনন্য উচ্চারণে : আমি কারো চোখের আলো না,/না আমি কোনো হৃদয়ের সান্ত্বনা করছি না/যে কেউ কখনো দরকারী হতে পারে না।/আমি যে তুচ্ছাতি তুচ্ছ, ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র,/আমার চেহারা ধ্বংস হয়েছে,/আমার প্রেমিক হারিয়ে গেছে।/আমি বসন্ত ফসল,/বাগানের যেটা তার প্রজাপতিতে ভিজে গেছে।

১৮৬২ নিভৃতচারী, নির্বাসিত, নিরপরাধ, নিঃসঙ্গ বাহাদুর শাহ মারা যান। তাঁর তদারকির জন্য থাকা ক্যাপ্টেন ডারিসের বর্ণনায় আছে, ‘বাহাদুর শাহর মৃত্যুর দিনটি ছিল শুক্রবার, সময় ভোরবেলা। ওই দিন বিকেলেই মুসলিম রীতিতে তাঁকে সমাহিত করা হয়। কবরের পাশে দেওয়া হয় বাঁশের বেড়া এবং গড়ে ওঠে ঘাসের আচ্ছাদন।’

অযত্ন, অবহেলায় স্মৃতির অতলান্ত গভীরে হারিয়ে যাচ্ছিল সর্বশেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধি। ১৯০৩ সালে তা শনাক্ত করা হয়। ১৯০৫ সালে ঐতিহাসিক সমাধিটি পূর্ণ ধর্মীয় মর্যাদা ও গাম্ভীর্যে সংরক্ষণের জোড় দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বাহাদুর শাহর সমাধি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। বাহাদুর শাহর সমাধিতে পাথরখচিত স্মৃতিফলকে লেখা হয় তাঁরই পঙিক্তমালা : ‘কিতনা হায় বদ-নসিব ‘জাফর’/দাফন কি লিয়ে দুগজ জমিন ভি না মিলি কু-ই-ইয়ার মেঁ।

অর্থাৎ ‘এতই হতভাগা জাফর, যে তার দাফনের প্রয়োজনে,/স্বজনের দেশে (যে জমিন সে ভালোবাসত) দুগজ মাটি—/তাও মিলল না’।

১৯৮৭ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, বাহাদুর শাহর সমাধি পরিদর্শনে গিয়ে সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে পরিদর্শকদের জন্য রক্ষিত বইয়ে মন্তব্য করেন :/দুগজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তাঁ মে,/পার তেরি কুরবানি ছে উঠি আজাদি কি আওয়াজ।/বদ-নসিব তো নেহি জাফর,/জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউর শওকত মে,/আজাদি কি পয়গাম ছে।’

রাজীব গান্ধীর মন্তব্যের অনুবাদ হলো : ‘হিন্দুস্তানে তুমি দুগজ মাটি পাওনি—এটা সত্য। তবে তোমার আত্মত্যাগ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিল। দুর্ভাগ্য তোমার নয় জাফর, স্বাধীনতার বার্তার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম ও গৌরবের সঙ্গে তোমার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।’

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, কাপাসিয়া, গাজীপুর/ কালের কণ্ঠ

captcha