
তার অবদান গোপন করা বা অস্বীকার করা সেই অধিকার খর্ব করার শামিল। যা সেই পবিত্র আমানতের খিয়ানত হিসেবে পরিগণিত হয়। এতে বৈষম্য ও অবিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। পবিত্র কোরআনে মানুষের আমানত রক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত তার হকদারকে ফিরিয়ে দিতে। তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন তা কত উত্কৃষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।
’
(সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৮)
এই আয়াতে সব ক্ষেত্রে আমানত ও সুবিচার রক্ষার প্রতি তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কোনো ক্ষেত্রেই কারো সঙ্গে বেইনসাফ করার সুযোগ নেই। ইসলাম যেখানে মানুষকে শত্রুর সঙ্গেও ইনসাফভিত্তিক আচরণের শিক্ষা দেয়, সেখানে সহযোদ্ধা বা সহকর্মীদের সঙ্গে তো কোনোভাবেই ইনসাফবহির্ভূত কাজ করার সুযোগ থাকে না। কারো অবদান বা কৃতিত্ব স্বীকারের ক্ষেত্রেও ইনসাফের দিকটা বিবেচনা করা আবশ্যক। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সঙ্গে সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে সদা দণ্ডায়মান হও।
কোনো কওমের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদের কোনোভাবে প্ররোচিত না করে যে তোমরা ইনসাফ করবে না। তোমরা ইনসাফ করো, তা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই তোমরা যা করো, আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।’
(সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৮)
নবীজি (সা.) তাঁর সাহাবিদের সর্বদা ইনসাফের শিক্ষা দিতেন। কখনো বৈষম্য বরদাশত করতেন না। কোথাও বৈষম্য হতে দেখলে তিনি তার প্রতিবাদ করতেন। যার নজির বহু হাদিসে পাওয়া যায়। নুমান ইবনে বাশীর (রা.) বলেন, আমাকে আমার পিতা তাঁর সম্পদ থেকে কিছু প্রদান করেন। আমার মা আমরাহ বিনতে রাওয়াহা বলেন, আমি সন্তুষ্ট হতে পারছি না, যতক্ষণ না আপনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সাক্ষী রাখেন। এরপর আমার পিতা আমাকে নিয়ে নবী (সা.)-এর কাছে আসেন, আমার দানের ওপর তাঁকে সাক্ষী রাখার জন্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে বললেন, এরূপ কাজ কি তুমি তোমার আর সব পুত্রের সঙ্গে করেছ? তিনি বললেন, না। নবী (সা.) বলেন, আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমার সন্তানদের মধ্যে ন্যায়বিচার করো। তখন আমার পিতা চলে আসেন এবং সে দান ফিরিয়ে নেন। (মুসলিম, হাদিস : ৪০৭৩)
সুবহানাল্লাহ! এভাবে নবীজি (সা.) তাঁর সাহাবিদের ইনসাফ শিখিয়েছেন, বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠনে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি কখনো নিজের সহযোদ্ধাদের সঙ্গেও বৈষম্য করেননি। তাদের অবদান গোপন বা তুচ্ছ করেননি, বরং সহযোদ্ধাদের যার হক যেভাবে আদায় করা প্রয়োজন, তিনি ঠিক সেভাবেই তার হক আদায় করেছেন। সহযোদ্ধাদের প্রতি নবীজি (সা.)-এর ইনসাফ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শন হুনায়ন বিজয়ের পর গণিমতের সম্পদ বণ্টনের ঘটনায় পাওয়া যায়। বিভিন্ন হাদিস ও ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ আছে, হুনায়ন যুদ্ধের দিনে মহান আল্লাহ মুসলমানদের বিজয় দান করলে রাসুলুল্লাহ(সা.) যুদ্ধলব্ধ সম্পদ মানুষের মধ্যে বণ্টন করেন।
তবে দানের ক্ষেত্রে নবীজি (সা.) তাদেরকে প্রাধান্য দেন, যারা মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণ করলেও তখনো তাদের ঈমান দুর্বল ছিল। নবীজি (সা.) সেদিন দানের ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দেন, যাতে করে তাদের মধ্যে ইসলামের প্রতি আগ্রহ ও স্থায়িত্ব বাড়ে। তবে আনসারদের তিনি কিছু দেননি (যেহেতু তাঁরা মজবুত ঈমানের অধিকারী ছিলেন)। (কিন্তু বিষয়টি তাৎক্ষণিক না বুঝতে পেরে) এতে কিছু আনসার সাহাবি দুঃখ পেয়েছিলেন, কারণ তাঁরা অন্যদের মতো কোনো গনিমত পাননি।
যখন নবীজি (সা.) তাঁদের দুঃখের কথা জানতে পারেন, তখন তিনি একটি আবেগঘন ভাষণ দেন :
‘হে আনসার সম্প্রদায়! আমি কি তোমাদের এমন অবস্থায় পাইনি যে তোমরা পথভ্রষ্ট ছিলে, তখন আল্লাহ আমাকে দিয়ে তোমাদের হেদায়েত দিলেন?
তোমরা পরস্পরে বিভক্ত ছিলে, আল্লাহ আমাকে দিয়ে তোমাদের একত্র করলেন?
তোমরা অভাবগ্রস্ত ছিলে, আল্লাহ আমাকে দিয়ে তোমাদেরকে ধনবান বানালেন?’
প্রত্যেক প্রশ্নে আনসাররা উত্তরে বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই সবচেয়ে বড় অনুগ্রহকারী।’ এটা ছিল আনসারদের নম্রতা ও আদব। এরপর নবীজি (সা.) বললেন, তোমরা আমাকে উত্তর দাও না কেন? তোমরা তো বলতে পারতে—‘হে আল্লাহর রাসুল, আপনি আমাদের কাছে এসেছিলেন তখন আপনার প্রতি কেউ বিশ্বাস করছিল না, আমরা বিশ্বাস করলাম। আপনাকে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছিল, আমরা সমর্থন দিলাম। আপনি বিতাড়িত ছিলেন, আমরা আশ্রয় দিলাম। আপনি দরিদ্র ছিলেন, আমরা আপনাকে সাহায্য করলাম।’
এই কথাগুলো নবীজি নিজেই তাঁদের পক্ষ থেকে বলে দিলেন। এটা ছিল তাঁর বিনয় ও ন্যায়পরায়ণতার প্রকাশ। সাহাবি ও সহযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসার প্রকাশ। এরপর নবীজি (সা.) তাঁদের মন রক্ষা করে বলেন, ‘তোমরা কি খুশি নও যে মানুষ ছাগল ও উট নিয়ে ঘরে ফিরছে, আর তোমরা আল্লাহর রাসুলকে নিয়ে ফিরছ?’ এরপর তিনি বলেন, ‘যদি হিজরত না করতাম, তবে আমি নিজেকে আনসারদের একজন হিসেবে গণ্য করতাম। যদি মানুষ একটি উপত্যকা ও পাহাড়ি পথ দিয়ে চলে, আর আনসাররা অন্য পথে চলে, আমি আনসারদের পথই গ্রহণ করতাম। আনসাররা আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু, আর অন্যরা বাইরের পোশাকের মতো।’ তারপর নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা আমার পরে অন্যদের পক্ষ থেকে বৈষম্য দেখতে পাবে। তখন তোমরা ধৈর্য ধরো, যতক্ষণ না তোমরা হাউজে কাউছারে আমার সঙ্গে মিলিত হও।’
সিরতে ইবনে হিশামের বর্ণনামতে, ‘(এই কথা শুনে) সাহাবিরা এমনভাবে কাঁদতে লাগলেন যে, তাঁদের দাড়ি ভিজে গেল। তাঁরা বললেন, ‘আমরা আল্লাহর রাসুলকেই আমাদের (গনিমতের) অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি।’ এরপর রাসুলুল্লাহ (সা.) সেখান থেকে চলে গেলেন, আর তাঁরা (আনসাররা) ছড়িয়ে পড়লেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৪৩৩০, মুসনাদে আহমদ, সিরতে ইবনে হিশাম : ২/৪৯৮)
তাই মুমিনের উচিত সর্বদা ইনসাফের চেষ্টা করা। কারো কৃতিত্ব ছিনতাই না করা। অপরের প্রাপ্য সম্মান ও কৃতিত্ব তাকে দেওয়ার চেষ্টা করা। কেননা রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৫৪)
লেখক: মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা