IQNA

বিপজ্জনক সংকট দানা বাধছে বলকান অঞ্চলে

0:02 - November 09, 2021
সংবাদ: 3470943
তেহরান (ইকনা): বলকান অঞ্চলের বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা এলাকাটি ফের গুরুতর সংকটের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। যে সংকটের কারণে আরেকটি বসনিয়া যুদ্ধ বাঁধতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ১৯৯৫ সালের ওই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষকে হত্যার মাধ্যমে মুসলিম নিধন করা হয়।
বসনিয়ার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ক্রিশ্চিয়ান স্মিদ বিষয়টি নিয়ে চলতি সপ্তাহেই কথা বলেছেন। তার ভাষ্যমতে, সার্বিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া হলে এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মার্কিন মধ্যস্থতায় করা শান্তিচুক্তিটি ভেস্তে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
 
বসনিয়ার তিন ব্যক্তির প্রেসিডেন্সির সার্ব নেতা মিলোরাদ ডোডিক বারবার দেশের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। যুদ্ধের পর দুটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত দেশটি একটি কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা সংযুক্ত ও পরিচালিত। সম্প্রতি এই নেতা নতুন এক আইন প্রবর্তন করেছেন যার ফলে সার্ব প্রজাতন্ত্র আলাদা হয়ে যাওয়ার পথটাও সুগম হয়েছে।
 
এ বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে স্মিদ বলেছেন, ‘ওই আইন কোনোরকম ঘোষণা ছাড়াই বিচ্ছিন্নতার সমতুল্য।’ চলতি সপ্তাহেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন শান্তিরক্ষা বাহিনী ‘ইউফোর’ এর একটি মিশন অনুমোদনের আলোচনায় এ কথা তোলেন তিনি।
 
ঐতিহাসিকভাবেই সার্ব, বসনিয়াক ও ক্রোয়েটদের জাতিগত বিভাজন ও বিদ্বেষ রয়েছে। যা তাদেরকে যুদ্ধাপরাধে জড়াতেও দ্বিধার মুখে ফেলেনি। ফলে সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের কারণে সৃষ্ট উত্তেজনা পর্যবেক্ষকদের গভীর চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। 
 
বসনিয়া-হার্জেগোভিনার স্বাধীন এনজিও সংগঠন বসনিয়ান অ্যাডভোকেসি সেন্টারের সভাপতি ইসমাইল সিডিকও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার মতে, এতে কোনো প্রশ্ন নেই বর্তমান পরিস্থিতি ১৯৯৫ সালের পর সৃষ্ট সবচেয়ে বিপজ্জনক সংকট। এটি ক্রমেই এই জাতিগোষ্টীকে আরেকটি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
 
যা নিয়ে মূল সংকট
 
জাতিসংঘ ও ন্যাটোর অদূরদর্শিতা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতানৈক্যের কারণে সাড়ে তিন বছর ধরে চলে বসনিয়ার যুদ্ধ। পরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে যুক্তরাষ্ট্র একপ্রকার বাধ্য হয়েই যুদ্ধ থামাতে ‘জেনারেল ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট ফর পিস ইন বসনিয়া এন্ড হার্জেগোভিনা’ নামক শান্তি চুক্তিতে মধ্যস্থতা করে। চুক্তিটি মূলত ‘ডেটন চুক্তি’ নামে পরিচিত।
 
চুক্তির আওতায় একটি জাতিগত লাইনের মাধ্যমে সার্ব প্রজাতন্ত্র অ্যান্ড ফেডারেশন রাষ্ট্রকে বিভক্ত করা হয়। পরে তিন ব্যক্তির প্রেসিডেন্সি, আন্তর্জাতিক দূত এবং একটি কেন্দ্রীয় সরকার দ্বার সার্ব প্রজাতন্ত্র এবং বসনিয়াক ও ক্রোয়েটকে আবদ্ধ করা হয়। কিন্তু সার্ব নেতা মিলোরাদ ডোডিক সম্প্রতি সার্ব প্রজাতন্ত্রকে আলাদা করার পায়তারা শুরু করেছেন।
 
১৯৯৫ সালে বসনিয়ার মুসলিমদের ওপর সার্বদের চালানো নির্মম হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা বলে আখ্যা দেয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। যা মানতে নারাজ অনেক সার্ব। তাদের নেতা ও উস্কানিদাতা হলেন ডোডিক। আর তাই হাইকমিশনের কার্যালয় থেকে গণহত্যা অস্বীকারকারীকে কারাদণ্ড দেয়ার সুযোগ দিয়ে পাশ করা আইনটি নিয়ে তিনি বিশেষভাবে বিরক্ত।
 
এমনকি বছরের শুরুর দিকে ডোডিক আইনটির বিষোদগার করে বলেন, বসনিয়ার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়া হলো। এখন আমাদের ওখান থেকে আলাদা হয়ে রিপাবলিকা স্রপস্কা শুরু কার ছাড়া কোনো বিকল্পই রইলো না। তার এই ঘোষণার মাধ্যমেই ডেটন চুক্তির বিলুপ্তির ডাক দেয়া হয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষক।
 
অবস্থা কতটা ভয়াবহ
 
পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা ডোডিক এখনই বিচ্ছিন্নতার দিকে অগ্রসর না হলেও, তার কর্মকাণ্ডে এ অঞ্চলটি ভয়ানক অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। সাধারণ জনগণের মধ্যে সহিংসতা, জোরপূর্বক অভিবাসন এবং অসহনীয় দুর্দশার কারণ হবে এই নেতার কর্মকাণ্ড।
 
বসনিয়া-হার্জেগোভিনার নাগরিকরা এখন সহিংসতার আশঙ্কা নিয়ে দিনাতিপাত করছে বলে জানিয়েছেন বসনিয়ার বংশোদ্ভূত রাজনীতিক আরমিনকা হেলিক। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিবের সাবেক বিশেষ এ উপদেষ্টা এখন ব্রিটিশ হাউস অফ লর্ডসের সদস্য। তার মতে, বিচ্ছিন্নতার পথে এগোলে ভয়াবহ এক সংকটের সৃষ্টি হবে।
 
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ হিদার স্টাফ সতর্ক করে বলেছেন, বিচ্ছিন্নতার মতো হিংসাত্মক সংঘাত অঞ্চলটিকে একটি শরণার্থী সংকটের মুখে ফেলবে। যেমনটা আমরা দেখেছি ৯০র দশকে। সে সময় প্রাণভয়ে দলে দলে লোক বসনিয়া থেকে মন্টিনেগ্রোসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোয় পালিয়ে গিয়েছিল।
 
এদিকে ভূরাজনীতির জাতাকলেও পিষ্ট হচ্ছে অঞ্চলটি। ইইউর কাছাকাছি থাকা বলকান অঞ্চলে প্রভাব বেড়েছে রাশিয়ার। তারা তো মুখিয়েই রয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে। ফলে সার্বদের ওপর বেশি চাপও প্রয়োগ করতে পারছে না ইইউর মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো। কেননা চাপ প্রয়োগ করলেই সার্ব এবং সার্বিয়া রাশিয়ামুখী হবে।
 
এ অবস্থায় কি করা যেতে পারে তা নিয়ে ইসমাইল সিডিক বলেছেন, বসনিয়ায় শান্তি রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক তথা পশ্চিমা সম্প্রদায়ের একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। বসনিয়ায় সহিংসতা বৃদ্ধি তাদের ব্যাপকভাবে ক্ষতি করতে পারে। কারণ পশ্চিমারা ন্যাটোর সীমান্তে চীনা এবং অন্যান্য স্বার্থের সঙ্গে জড়িত রাশিয়া-সমর্থিত সংঘাত সহ্য করবে না।
 
এক ন্যাটো কর্মকর্তা বলেছেন, আমরা বরাবরই রাশিয়াকে পশ্চিম বলকানে গঠনমূলক ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাই। কিন্তু রাশিয়া তার বিপরীতটাই করছে সবসময়। ন্যাটো এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা এবং সহযোগিতার জন্য কাজ করে যাবে। দেশীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাইরের কোনো হস্তক্ষেপই মেনে নেয়া হবে না।
 
মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন-এ প্রকাশিত লুক ম্যাকগির বিশ্লেষণের সংক্ষেপিত অনুবাদ
চ্যানেল ২৪
captcha