IQNA

নির্বাচনে জিলতে হিজাব নিষিদ্ধের ঘোষণা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট প্রর্থীর/ ইসলামী চিন্তাবিদের তীব্র প্রতিবাদ

16:36 - April 23, 2022
সংবাদ: 3471746
তেহরান (ইকনা): টেলিভিশন বিতর্ক চলাকালে লা পেন বিতর্কিত পরিকল্পনা হিজাব নিষিদ্ধ করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

হিজাব মুসলিমদের চাপিয়ে দেওয়া বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে আমার যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। এ সময় লা পেনকে উদ্দেশ্য করে ম্যাক্রোঁন বলেন, ‘আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি আপনি গৃহযুদ্ধের সূচনা করতে যাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, ফ্রান্স হচ্ছে আলোকবর্তিকা ও সভ্যতার প্রতীক। জনসম্মুখে হিজাব নিষিদ্ধ করলে এ ক্ষেত্রে ফ্রান্স হবে বিশ্বের প্রথম দেশ। এটা কোনো ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে না বলেও জানান তিনি। '

 

পাশ্চাত্য আসলেই পুরোদস্তুর ইসলাম বিরোধী ও মুসলিম বিদ্বেষী। ফরাসী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে ম্যাক্রোনের প্রধান ও একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী মেরিন লো পেনের হিজাব ও ইসলাম বিরোধী এ বক্তব্য সেটারই প্রমাণ । আর গণতন্ত্র , উদারতা , মুক্তবুদ্ধির চর্চা ,বাকস্বাধীনতা ,ব্যক্তিস্বাধীনতা , মানবাধিকার ইত্যাদি হচ্ছে পাশ্চাত্যের মুখরোচক অন্তঃসারশূন্য ফাঁকা বুলি যেগুলোয় পশ্চিমারা নিজেরাই বিশ্বাস করে না । বরং আসলে পাশ্চাত্যে লোক ভুলানো গণতন্ত্রের আদলে ডিক্টেটর শিপ ( স্বৈরাচার ও কঠোর  ব্যবস্থাভিত্তিক অর্থাৎ সিস্টেমেটিক একনায়কতন্ত্র )ই প্রতিষ্ঠিত ও বহাল আছে । পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র তো মুষ্টিমেয় পুঁজিবাদী কর্পোরেটদের দান ( ডোনেশন ) চাঁদা ও দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভরশীল এবং তা তাদের কাছে ঋণী ও বন্দী। আসলে জনগণ প্রেসিডেন্ট , প্রধান মন্ত্রী ও সাংসদদের নির্বাচিত করে না বরং তাদেরকে নির্বাচিত করে এ সব মুষ্ঠিমেয় ডোনার পুঁজিপতি কর্পোরেট ব্যক্তি। বর্ণিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল নির্বাচনী প্রচারণার মাধ্যমে তারা ( এ সব ডোনার পুঁজিপতি কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব) তাদের মনো:পুত প্রার্থীকে নির্বাচন করার দিকেই জনগণকে পরিচালিত করে । আর এভাবেই সেখানে ( পাশ্চাত্য) নির্বাচন খেলা সুসম্পন্ন হয় !!!

পাশ্চাত্যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কিভাবে গণতন্ত্রের দোসর হয় ? আসলে প্রকৃত গণতন্ত্রের সাথে পুঁজিবাদের কী সম্পর্ক ? গণতন্ত্রের ঠিক বিপরীতেই পুঁজিবাদের অবস্থান । পুঁজিবাদ চরম ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য , ব্যক্তি প্রাধান্য , ব্যক্তি স্বার্থ ও ব্যক্তি কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উৎসারিত যা গণতন্ত্রের সাথে সম্পূর্ণ বেমানান। তাই আমরা দেখতে পাই যে পাশ্চাত্যে আসলে অর্থনৈতিক শক্তি ও ক্ষমতা কতিপয় মুষ্ঠিমেয় পুঁজিপতি কর্পোরেট ব্যক্তিত্বের হাতেই পুঞ্জীভূত হয়ে আছে

যারা প্রকৃত পক্ষে নির্বাচনকে সরাসরি প্রভাবিত করে এবং সরকার গঠন ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে প্রত্যক্ষ প্রভাব ও ভূমিকা রাখে । আর এভাবেই দশকের পর দশক ধরে পাশ্চাত্যে রাষ্ট্র , সরকার , সংসদ ও রাজনীতিও এসব মুষ্টিমেয় পুঁজিবাদী কর্পোরেটের হাতে বন্দী হয়ে গেছে ও আছে। আর পাশ্চাত্যের প্রধান প্রধান সংবাদ মাধ্যমও এসব মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি ও কর্পোরেট ব্যক্তিত্বের মালিকাধীন বা তাদের দান ও দয়াদাক্ষিণ্যের ওপরই নির্ভরশীল। অর্থাৎ স্বাধীন সাংবাদিকতা

যা গণতন্ত্রের প্রতীক ও দোসর বলে গণ্য তাও পাশ্চাত্যে বিদ্যমান নেই। কারণ , সাংবাদিকরাও সেখানে পুঁজিপতি কর্পোরেট ব্যক্তিত্বদের বেতনভুক কর্মচারী মাত্র । তাহলে কোথায় থাকছে গণতন্ত্র ও মুক্তবুদ্ধির

 

চর্চা ? আসলে সব কিছুই সেখানে পরিচালিত হয় মুষ্টিমেয় চরম সংখ্যালঘু পুঁজিপতি কর্পোরেট ব্যক্তিত্বের ইচ্ছা ও ইশারা ইঙ্গিতে ঠিক যেন ১৯৪৭ - ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের পুঁজি পতি ২২ পরিবারের মতো । তবে পার্থক্য শুধু এতটুকু যে পাশ্চাত্যে মুষ্ঠিমেয় চরম সংখ্যালঘু পুঁজিপতি কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব ও পরিবার খুব স্মার্ট ( চৌকস ) গণধোকা দানকারী কায়েমি স্বার্থবাদী আর্থ রাজনৈতিক প্রশাসনিক সাংস্কৃতিক

ব্যবস্থা দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে এবং নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে চাকর বা পোষ্য কুত্তা তুল্য ও সদৃশ প্রেসিডেন্ট, প্রধান মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদেরকে প্রহসনমূলক নির্বাচন খেলার মাধ্যমে নিয়মিত পাল্টাতে পারে যা ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বা তার পরে আজ পর্যন্ত পাকিস্তান বা অপশ্চিমা দেশগুলোয় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় নি। বিশ্বের সকল দেশেই গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলে যা প্রচলিত আছে তা আসলে টাকার হোলি খেলা ছাড়া আর কিছুই নয় । আর টাকার খেলা মানেই মুষ্ঠিমেয় চরম সংখ্যালঘু পুঁজিপতি কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব ও ধনাঢ্য পরিবারের প্রাধান্য ও দৌরাত্ম। তাহলে গণতন্ত্রের আর কিছু বাকি রইল কি ?!!

হিজাব ইসলাম ও মুসলমানিত্বের মুর্ত প্রতীক এবং সতীত্ব ও চারিত্রিক শালীনতারও রক্ষক । আসলে মুসলিম সমাজের সাথে অমুসলিম সমাজের পার্থক্য সূচিত হয় এই হিজাবের মাধ্যমে । এ ছাড়া হিজাব পবিত্র কুরআন , হাদীস , ইসলামী শরিয়ত ও ফিকহ শাস্ত্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী বিধানসমূহের অন্তর্গত । হিজাব ইসলাম ধর্মের অপরিহার্য মৌলিক জরুরী বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত যা অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে মহানবী হযরত মুহাম্মদের (সা) নুবুওয়ত ও রিসালত অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করারই নামান্তর । আর মহানবীর (সা) নুবুওয়ত ও রিসালত এবং পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াত ও বিধান অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান আসলে মহান আল্লাহকেই অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করা যা হচ্ছে কুফর ও ইর্তিদাদ ( ধর্ম ও ইসলামের চৌহদ্দি থেকে বের হয়ে কুফরের দিকে ফিরে যাওয়া ও পুন:প্রত্যাবর্তন ) । স্মর্তব্য যে , কোনো মুসলমান নামধারী ব্যক্তি কর্তৃক হিজাবের বিধান অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যানের অর্থ হচ্ছে পবিত্র কুরআনের কিছু কিছু আয়াত ও অংশ প্রত্যাখ্যান এবং তা অবিশ্বাস ও অস্বীকার করা এবং এ গ্রন্থের কিছু কিছু অংশ বিশ্বাস ও গ্রহণের নামান্তর । আর পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে আসলে এ গ্রন্থের (পবিত্র কুরআন) অংশবিশেষ অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান সম্পূর্ণ এ গ্রন্থ (কুরআন ) ও দ্বীন অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যানেরই নামান্তর ।

তোমরা ( বনী ইসরাইল ) কি (আসমানী) কিতাবের ( তাওরাত ) কিছু অংশ বিশ্বাস কর এবং কিছু অংশ অস্বীকার কর ; অত:পর তোমাদের মধ্যে যারা এটা করে তাদের প্রতিদান এ দুনিয়াবী ( ইহলৌকিক ও পার্থিব ) জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া আর কিছুই নয় ; আর কিয়ামত দিবসে তাদেরকে সবচেয়ে কঠিন আযাবের দিকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে এবং তোমরা যা কর সে ব্যাপারে আল্লাহ উদাসীন ( গাফেল ) নন ( সূরা -ই বাকারা : ৮৫ ) । অতএব যেমন তাওরাতের কিছু অংশ বিশ্বাস ও কিছু অংশ অস্বীকার সম্পূর্ণ তাওরাত অস্বীকার , লাঞ্ছনা ও কঠিনতম পারলৌকিক আযাবের কারণ ঠিক তেমনি পবিত্র কুরআনের কিছু অংশ বিশ্বাস ও কিছু অংশ অস্বীকার আসলে সম্পূর্ণ কুরআন

অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যানের শামিল এবং তা নি: সন্দেহে পার্থিব দুনিয়াবী জীবনে লাঞ্ছনা এবং আখেরাতে কঠিনতম আযাবের কারণ হবে ।

আর হিজাব অস্বীকার না করে কেবল তা পালন না করা হচ্ছে ফিসক ( অবাধ্যতা ও পাপ ) এবং এ অর্থে যে হিজাব পালন করে না সে ফাসেক ( অবাধ্য ও পাপী ) বলে গণ্য ।

তাই ইসলামে হিজাব বিধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, জরুরী ও অপরিহার্য । আর হিজাবের বিরোধিতা আসলে ইসলামের বিরোধিতা এবং এ ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল । সুতরাং মেরিন লো পেনের বক্তব্য : " হিজাব সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয় ।" সম্পূর্ণ বাজে কথা । তার এ বক্তব্য আসলে ইসলাম বিরোধী বক্তব্য । সে আরও বলেছে :" হিজাব নাকি মুসলমানদের চাপিয়ে দেওয়া বিধান । " তাহলে তাকে জিজ্ঞেস করতে হয় যে মুসলমানরা এ বিধান কাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে? ফরাসী খ্রিষ্টান নারীদের উপর ? এ কথা তো নির্জলা মিথ্যা কথা। মুসলমানরা কখন ফরাসী অমুসলিম নারীদের উপর হিজাব চাপাল ? এমনকি ফ্রান্সে মুসলমানরা নিজেদের উপরও হিজাব চাপায় নি । তার প্রমাণ : ফ্রান্সে বহু মুসলিম মহিলা হিজাব করে না এবং তাদের চালচলন ও  বেশভুষা বেপর্দা বেহিজাব অমুসলিম নারীদের মতোই। তবে এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফরাসী মুসলিম নারী ধর্মপ্রাণ ও ধার্মিক

হওয়ার জন্য নিজ থেকে স্বেচ্ছায় হিজাব করে মাত্র ! ইরান , আফগানিস্তান ও অন্যান্য মুসলিম দেশের মতো যেমন রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক ভাবে ঐ সব দেশের নারীদের উপর হিজাব বাধ্যতামূলক  ঠিক সেরকম ভাবে ফ্রান্সে মুসলিম নারীদের উপর রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক ভাবে হিজাব  বাধ্যতামূলক করা সম্পূর্ণ অসম্ভব ! সুতরাং ফ্রান্সে যে সব মুসলিম মহিলা হিজাব করেন তারা স্বেচ্ছায় একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও স্বাধীন স্বতন্ত্র ভাবেই হিজাব করেন । তাহলে মেরিন লো পেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে সে যে ফ্রান্সে নারীদের প্রকাশ্যে হিজাব সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করবে তা ব্যক্তি স্বাধীনতায় অযাচিত অবৈধ হস্তক্ষেপ , ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও স্বাধীন নির্বাচনের ক্ষমতা হরণ , চরম স্বেচ্ছাচারিতা ও একনায়কতন্ত্র বলে অভিহিত ও গণ্য হবে না ? অথচ ফরাসী বিপ্লবের মূলমন্ত্রে ছিল ফ্রাটারনিটি ( ভ্রাতৃত্ব) , লিবার্টি ( স্বাধীনতা) ও গণতন্ত্র । লো পেনের এ বক্তব্য সেই লিবার্টির বিরোধী নয় কি ? তাহলে কোথায় থাকল স্বাধীনতা ( লিবার্টি ) ?

আর বাহিরে ,  পাবলিক প্লেসে এবং নামাহরামের সামনেই তো মুসলিম মহিলাদের হিজাব করতে হয় । এটা কেমন ব্যক্তি স্বাধীনতা যে উলঙ্গ বা সংক্ষিপ্ত অশালীন পোশাক পড়ে নারীরা প্রকাশ্যে বাইরে আসতে পারবে অথচ শালীন হিজাব করে তারা বাইরে আসতে পারবে না ! আকল ( বুদ্ধিবৃত্তি ) ও যুক্তিবুদ্ধি কি এটা সমর্থন করে ?

এটা কি আসলেই স্বাধীনতা না বাধ্যবাধকতা ও কড়াকড়ি আরোপ ? লো পেনের এ দৃষ্টিভঙ্গি বাড়াবাড়ি ও চরমপন্থা নয় কি ? এতে করে কি ফ্রান্সে শান্তি আসবে ? এটা বাস্তবায়ন করলে ফ্রান্সে যে নিশ্চিতভাবে গৃহযুদ্ধ লেগে যেতে পারে তা ম্যাক্রোনও বলেছে । মেরিন লো পেন কতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন এবং বিচার বুদ্ধি ও বিবেকহীন হলে এ ধরণের উস্কানি মূলক অশান্তি ও গোলযোগ সৃষ্টি কারী কথা বলতে পারল ?

ফ্রান্সে খ্রিষ্টান ধর্মযাজিকারাও  হিজাব পালনকারী মুসলিম নারীদের মতো বা তাদের কাছাকাছি হিজাব পালন করে । তাহলে লো পেনের এ নীতি কি তাদেরকেও শামিল করবে ? 

কুফরী শয়তানী অপসংস্কৃতির প্রধান অন্তরায় হচ্ছে শালীনতা ও শালীন পোশাক - পরিচ্ছদ তথা হিজাব।

আর অশালীনতা ও অশ্লীল পোশাক আশাক হচ্ছে এই কুফরী শয়তানী অপসংস্কৃতির মুর্ত প্রতীক । আর মেরিন লো পেনের মতো ব্যক্তিরা হচ্ছে এই কুফরী শয়তানী অপসংস্কৃতির ধারক ও বাহক । তাই তারা সবসময় হিজাবের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয় । অতএব এদের শয়তানী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই ।

ইসলামী চিন্তাবিদ এবং গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান

২২-৪-২০২২

২০ রমযান, ১৪৪৩ হি.

captcha