IQNA

বিদায় লুটেরা রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ

9:05 - September 13, 2022
সংবাদ: 3472448
তেহরান (ইকনা): ১৭৫৭ সালে অপরিনামদর্শী সিরাজউদ্দৌলার পতনের আগ পর্যন্ত সুবা বাংলা ছিল গোটা দুনিয়ার মধ্যে ঐশ্বর্যশালী সুখী মানুষের একটি দেশ। তখনকার আমলের অনেক ইউরোপিয়রাই বলেছেন, বাংলার মানুষের খাবার থালায় কম করেও তিন ধরনের পদ থাকতোই। ঘি, মাখন খাওয়ার বিষয়টা তাদের জন্য ছিলো সাধারণ। তাদের গায়ে যে পোষাক ছিল তা ইউরোপিয়ানদের কাছে ভাবনারও অতীত, ঈর্ষণীয়। তখনকার আমলে বাংলার পন্য নিয়ে বাংলার বণিকরা পূর্বদেশ মানে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত পৌছে যেতো। পরবর্তীতে 
নবাবের পতনের হলে তিন দফা নতুন নবাব প্রতিস্থাপনের পর মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও ওড়িশার খাজনা উঠানোর বিষয়টি মাত্র লাখ দেড়েক রূপিতে কিনে নেন  রবার্ট ক্লাইভ। এরপর  রবার্ট ক্লাইভ হিসাব করে দেখান, দেড় লাখ রূপি দেবার পরও  কোম্পানির প্রায় ১৬ লাখ রূপি। বাস্তবে সেটি কোটি রূপিতে ছাড়িয়ে যায়।
 
এরপর থেকেই ফসলে, পন্যে উদ্বৃত্ত একটি জনপদ হয়ে যায় স্রেফ শশ্মান ঘাট। সব থেকে বেশি সংকটে পড়ে ঢাকা। ব্রিটিশদের অত্যাচার আর লুন্ঠনে একটা বাণিজ্যিক শহর পরিনত হয়ে যায় গোরস্তানে। কোম্পানির হাতে রাজস্ব উত্তোলনের দায়িত্ব থাকায় কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাত্রাতিরিক্ত রাজস্ব উত্তোলন শুরু হয়। 
 
বাংলা ১১৭৬ সাল আর ১৭৭০ ইংরেজি। সিরাজের পতনের মাত্র ১৩ বছরের মাথায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। সোনার বাংলা একটি কবরস্থানে পরিণত হয়। এই দুর্ভিক্ষে প্রায় ১ কোটি লোক মারা যায়। সেটা ছিলো এটা দুনিয়ার নিকৃষ্টতম দুর্ভিক্ষের মধ্যে অন্যতম। সে দুর্ভিক্ষের কারণ ছিলো না যে ফসল উৎপাদন কম হয়, দুর্ভিক্ষের কারণ ছিলো সে বছরের মাত্রাতিরিক্ত খাজনা আদায়। যে বছর দুর্ভিক্ষ হলো তার আগের বছর আদায়কৃত রাজস্ব ছিল দেড় কোটি রূপি। আর যে বছর দুর্ভিক্ষ হলো সে বছর আগের বছরের তুলনায় ৫ লাখ ২২ হাজার রূপি বেশি আদায় হয়েছিল।
 
তত্কালীন সময়ে ঢাকার মসলিনের কদর ছিল আকাশ ছোঁয়া। আর ব্রিটেন থেকে কোম্পানি কলের তৈরি কাপড় আনলেও সেটা এখানে চলত না। তারপর তারা আমাদের মসলিন উৎপাদনকারী তাঁতীতের হাতের আঙ্গুল পর্যন্ত কেটে দেয়া শুরু করে যাতে তারা মসলিন বুনতে না পারে। 
 
গোটা মুঘল আমলে সুবা বাংলা ১৯টি, পরে ৩৪টি ছোট ছোট নবাব ও রাজাদের অধীনে শাসন হয়েছে। সেই শাসনের বেশিরভাগ সময় মুঘল শাসনের বিষয়টি অনেক আলগা ছিল। বাংলা মুঘল শাসনের অধীনে ছিল ২৩০ বছর। এই ২৩০ বছরে বাংলায় দুর্ভিক্ষ হয়নি। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে মীর কাশিম হেরে যাবার পর দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানী কিনে নেয় কোম্পানি। এরপর মাত্র ৬ বছরের মাথায় ১৭৭০ সালে বা বাংলা ১১৭৬ সনে দুর্ভিক্ষ হয় যাতে মারা যায় প্রায় ১ কোটি মানুষ। এই ইতিহাস নির্মম, ভয়াবহ উপনিবেশিক শোষনের ফলাফল।
 
কোম্পানির শাসন ও ব্রিটেনের শাসনের মধ্যে তারা কত লোককে জোরপূর্ব দাস বানিয়েছে সেই হিসাবটা নতুন করে নেয়া আমাদের খুব দরকার, আজ না পারি, একদিন আমাদের প্রজন্ম নিবে আশা করি। 
 
১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময়ের দিকে যে দুর্ভিক্ষ হয় তাতে বাংলার প্রায় ৩০ লক্ষ লোক না খেয়ে মারা যায়। এই দুর্ভিক্ষ‌ও কিন্তু ফসল উৎপাদন কম হয়েছিল সে কারণে হয়নি, বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলা থেকে সব খাদ্য শস্য ব্রিটেনে নিয়ে মজুদ করা হচ্ছিলো বলেই হয়েছিলো। যুদ্ধে যেখানে মাত্র ৪০ হাজার ব্রিটিশ সৈন্য লড়ছিলো সেখানে ভারতীয় সৈন্য ছিল প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার। ভারতীয়রা অকাতরে মরেছেও সে যুদ্ধের ময়দানে। 
দুর্ভিক্ষের অশনি সংকেত বেজে উঠার আগে বিষয়টি তৎকালীন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে জানানো হয়েছিল, তখন রাজা ছিলেন ষষ্ট জর্জ, মানে দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাবা। চার্চিল নিকৃষ্ট উত্তর দিয়েছিল। 
একটা সোনার দেশকে মৃতপুরি বানালো যে ব্রিটেন, ব্রিটেন উপনিবেশবাদ, তারই প্রতীকী চিহ্ন বহন করতেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। 
 
দ্বিতীয় এলিজাবেথ মারা গেছেন। পরিণত বয়সেই মারা গেছেন। আমরা মানি, যে কোনো মৃত্যুই বেদনাদায়ক কিন্তু রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে পূর্ববঙ্গের মানুষের শোকটা ভিন্ন রকম, যা রক্তের সাথে বেঈমানি মিশ্রিত। 
 
ইতিহাস মরে না। বাহাদুর শাহ পার্ক নামে ঢাকায় যে পার্কটা আছে ওখানে ১৮৫৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতাকার্মী বিপ্লবীদের লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। আর সিরাজউদ্দৌলার লাশ শহরে টেনে হিঁচড়ে নেয়া হয়েছিল।  ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ডকুমেন্ট নাড়াচাড়া করলে অপ্রকৃস্থ হয়ে যেতে হয়! মানুষ কি করে এতো পিচাশ প্রকৃতির হয়! তখনকার আমলে ব্রিটিশ শোষণ থেকে মুক্তি পাবার লক্ষ্যে অকাতরে জীবন দিয়েছেন তরুন যুব শ্রমিক কৃষকের দল। সেই বিপ্লবীদের বৃহত্তম অংশটি ছিলো বাংলাদেশের। আমাদের পূর্বপুরুষ তাদের জীবন বাজি রেখে, ভয়াবহ ইন্টারোগেশনের সামনে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। আর আমরা আজ সেই ঔপনিবেশিক শোষনের পদ চিহ্নের মৃত্যুর কথা জেনে কাঁদতে পারি নি বলে দুঃখিত! আমাদের সেই মহান লড়াকু পুর্বপুরুষদের আত্মদানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা সম্ভব নয় তাই। 
আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের জেলগুলোতে থাকা আমাদের বিপ্লবীদের দীর্ঘশ্বাস বাংলার আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। যে রক্তের গন্ধ পায় প্রকৃতি কেতাদুরস্ত ফ্যাশনাবেল প্রজন্ম সে রক্ত দিয়ে পান করুক স্কচ হুইস্কি, জনি ওয়াকার রেডলেভেল! 
 
বলি, কোহিনূর চুরি আর হাজার বছরের মুসলিম আবাস ফিলিস্তিনের দূর্দশার নেপথ্যে কারা? কারা শত শত বছর এই পৃথিবীর মানুষের রক্ত শুষে নিতে পানপাত্র ভরেছে? 
তাই বিদায়, বিদায় রাক্ষুসী লুটেরা রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, বিদায়....

 

captcha