
তাঁদের একজন হলেন নবী শু‘আইব আলাইহিস সালাম। যিনি শুধু তাওহীদের আহ্বান দিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং সমাজের অর্থনৈতিক অনিয়ম, মাপকাঠিতে প্রতারণা এবং ব্যবসায়িক দুর্নীতির বিরুদ্ধেও বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদ করেছিলেন।
পরিচয়
ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী শু‘আইব (আ.) ছিলেন ইব্রাহিম (আ.)-এর বংশধর, যদিও কোরআনে তাঁর পূর্বপুরুষদের বিস্তারিত বর্ণনা নেই।
তিনি ছিলেন মাদইয়ান অঞ্চলের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং তাঁর জাতি তাঁকে “আমাদের ভাই শু‘আইব” বলেই সম্বোধন করত।
"وَإِلَىٰ مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا"
‘আর মাদইয়ান জাতির দিকে তাদের ভাই শু‘আইবকে পাঠালাম।’
(সুরা: হুদ, আয়াত: ৮৪)
তাঁর দাঈ জীবনের প্রধান দুটি লক্ষ্য ছিল—
১) তাওহীদের দাওয়াত দেওয়া
২) সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
দাওয়াতের মৌল বার্তা
নবী শু‘আইব (আ.) কেবল ‘ধর্ম’ বলেই সীমাবদ্ধ থাকেননি; বরং তিনি সমাজে চলমান বাণিজ্যিক অসততা, মাপে ও ওজনে কম দেওয়া, মানুষের হক হরণ করা, এবং পথেঘাটে জুলুম চালানো— এসব অপরাধের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়েছেন। কোরআনে তাঁর কথার বিবরণ এভাবে এসেছে:
"أَوْفُوا الْكَيْلَ وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُخْسِرِينَ، وَزِنُوا بِالْقِسْطَاسِ الْمُسْتَقِيمِ"
মাপে পরিপূর্ণ দাও এবং ক্ষতিসাধনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।
সঠিক পাল্লায় ওজন করো।’
সুরা: আশ-শু‘আরা, আয়াত : ১৮১–১৮২)
এছাড়া তিনি আরও বলেন:
"وَلَا تَبْخَسُوا النَّاسَ أَشْيَاءهُمْ وَلَا تَعْثَوْا فِي الْأَرْضِ مُفْسِدِينَ"
“মানুষের প্রাপ্য অধিকার হরণ করো না এবং পৃথিবীতে ফিতনা সৃষ্টি করে বেড়িও না।”
(সুরা: হুদ, আয়াত: ৮৫)
কওমের প্রতিক্রিয়া ও ব্যঙ্গ
যেখানে একজন নবী এমন মিষ্টভাষী, হৃদয়স্পর্শী সতর্কতা দিচ্ছিলেন, সেখানে তার জাতি তাচ্ছিল্য করল। তারা বলল:
"يَا شُعَيْبُ مَا نَفْقَهُ كَثِيرًا مِمَّا تَقُولُ وَإِنَّا لَنَرَاكَ فِينَا ضَعِيفًا"
‘হে শু‘আইব! তুমি যা বলো, তার অনেক কিছুই আমরা বুঝি না।
আর আমরা তো তোমাকে আমাদের মাঝে দুর্বলই দেখি।’
(সুরা: হুদ, আয়াত : ৯১)
তারা আরও বলেছিল— ‘তোমার গোত্র না থাকলে আমরা তোমাকে পাথর মেরে হত্যা করে দিতাম।’
এ থেকে বোঝা যায়, তারা দাওয়াতের যুক্তি বুঝে উঠতে পারেনি কিংবা বুঝেও মানতে চায়নি, বরং তারা ক্ষমতার রাজনীতি ও সামাজিক পুঁজির ঘূর্ণিপাকে দাওয়াতকে ম্লান করতে চেয়েছিল।
আল্লাহ যখন দেখলেন, এই জাতি অবাধ্যতায় সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে, তখন তাদের ওপর নামিয়ে দিলেন কঠিন গ্রীষ্মের দাবদাহ। পানিও, ছায়াও তাদের প্রশান্তি দিতে ব্যর্থ হলো।
এ অবস্থায় তারা আকাশে একটি মেঘমালা দেখতে পেল— ভাবল, এটি নিশ্চয়ই বৃষ্টি আনবে। তারা ছুটে গিয়ে মেঘের নিচে আশ্রয় নিল। তখনই আল্লাহর পক্ষ থেকে নেমে এলো ভয়াবহ আগুনের ঝড়, বজ্রগর্জন, এবং শেষ পর্যন্ত আসলো “আস-সাইহা” এক ভয়ানক চিৎকার, যা পুরো জাতিকে ধ্বংস করে দিল। কোরআনের ভাষায়-
"فَأَخَذَهُمْ عَذَابُ يَوْمِ الظُّلَّةِ"
‘অতঃপর তাদের পাকড়াও করল ছায়াদানকারী দিবসের শাস্তি।’
(সুরা: আশ-শু‘আরা, আয়াত : ১৮৯)
শিক্ষা ও প্রাসঙ্গিকতা
নবী শু‘আইব (আ.)-এর জীবন আমাদের শেখায়:
১. দাওয়াত শুধু তাওহীদে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সমাজের অন্যায়, দুর্নীতি ও আর্থিক অপরাধের বিরুদ্ধেও সচেতনতা তৈরি করা দাঈর কাজ।
২. একটি জাতি যখন তাদের নৈতিক বাণিজ্যনীতি বিসর্জন দেয়, তখন তাদের পতন অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।
৩. আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো সতর্কবার্তা অবহেলা করলে পরিণতি হয় ভয়াবহ।
আজকের সমাজে যেখানে দুর্নীতি, প্রতারণা, মাপে কম দেওয়া এবং অন্ধ লোভ বেড়েই চলেছে, সেখানে নবী শু‘আইব (আ.)-এর শিক্ষা আমাদের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
নবী শু‘আইব (আ.) ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে যেন আমাদের এই বার্তাটিই দিচ্ছেন—
“হে মানুষ! শুধু নামাজ, রোজা নয়— ব্যবসায়, বেচাকেনা, লেনদেনেও খাঁটি হও। অন্যথায় তুমি আমার জাতির মতো ধ্বংস হয়ে যাবে।”
আল্লাহ তায়ালা আমাদের শু‘আইব (আ.)-এর সততার আদর্শে অনুপ্রাণিত জীবন গঠনের তাওফিক দিন।
লেখক: মুফতি সাইফুল ইসলাম