IQNA

ইকনার প্রতিবেদনে:

দুই বছর পর গাজায় নেই গম্বুজ ও মিনার

0:06 - October 11, 2025
সংবাদ: 3478231
ইকনা- গত দুই বছরে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর গণহত্যামূলক যুদ্ধে শুধু বেসামরিক এলাকা, বাড়িঘর ও অবকাঠামোই লক্ষ্যবস্তু হয়নি— বরং ধ্বংসের এই যন্ত্র নেমে এসেছে গাজার ধর্মীয় ঐতিহ্যের ওপরও। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে মসজিদ ও ধর্মীয় স্থানগুলো গাজার সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক পরিচয়ের প্রতীক ছিল, সেগুলোও আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

ইকনা সূত্রে পাওয়া সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দখলদার ইসরায়েলি সেনারা গাজা উপত্যকার ১,২৪৪টি মসজিদের মধ্যে ৮৩৫টি সম্পূর্ণভাবে এবং ১৮০টিরও বেশি আংশিকভাবে ধ্বংস করেছে।

দুই বছর ধরে চলা এই গণহত্যামূলক যুদ্ধ শুধু মানুষ ও ঘরবাড়িকেই গ্রাস করেনি, বরং গাজার প্রাচীন ইতিহাস ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতীক গম্বুজ ও মিনারগুলোও নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।

হাজারো বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহানি ও ধ্বংসপ্রাপ্ত গৃহের পাশাপাশি, গাজার ঐতিহাসিক মসজিদগুলোর অনেকগুলোই আজ ধ্বংসস্তূপে পড়ে আছে। এদের অনেকের ইতিহাস মামলুক ও উসমানি যুগ পর্যন্ত প্রসারিত এখন সেগুলোর অস্তিত্ব কেবল স্মৃতির পাতায়।

 

ভয়াবহ বোমাবর্ষণের শিকার মসজিদগুলো

গাজার সরকারি গণমাধ্যম দপ্তরের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুসারে, ,২৪৪টি মসজিদের মধ্যে ইসরায়েলি সেনারা ৮৩৫টি মসজিদ পুরোপুরি এবং ১৮০টির বেশি আংশিকভাবে ধ্বংস করেছে।

সবচেয়ে ঐতিহাসিক ও পরিচিত যে মসজিদগুলো এই ধ্বংসযজ্ঞে লক্ষ্যবস্তু হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

غزه مناره ندارد

১. আল-উমারি জামে মসজিদ

গাজার প্রাচীনতম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মসজিদগুলোর একটি। এটি পুরনো শহরের কেন্দ্রস্থলে, ঐতিহ্যবাহী বাজারের পাশে অবস্থিত। ৪,১০০ বর্গমিটার আয়তনের এই মসজিদে রয়েছে ৩৮টি মার্বেলের স্তম্ভ, যা এর স্থাপত্যে অনন্য সৌন্দর্য এনে দিয়েছে।

ইতিহাসে এটি প্রথমে এক প্রাচীন ফিলিস্তিনি মন্দির ছিল, পরে বাইজেন্টাইন যুগে গির্জা এবং ইসলামী বিজয়ের পর মসজিদে রূপান্তরিত হয়। ভূমিকম্প ও ক্রুসেড যুদ্ধের সময় বহুবার ধ্বংস হয় এবং মামলুক ও উসমানি যুগে পুনর্নির্মিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ১৯২৫ সালে পুনরায় সংস্কার করা হয়যতক্ষণ না বর্তমান যুদ্ধের সময় ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে আবার ধ্বংস হয়ে যায়।

 

২. সাইয়্যেদ হাশিম মসজিদ

গাজার পূর্বাঞ্চলীয় দারাজ এলাকায় অবস্থিত এই মসজিদটি নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর দাদা হাশিম বিন আবদে মানাফ-এর সমাধিস্থল বলে বিশ্বাস করা হয়। শহরটি গাজা হাশিমনামেও পরিচিত। এই ঐতিহাসিক মসজিদটিও ইসরায়েলি বিমান হামলায় গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

 

৩. কাটিব ওয়ালায়া জামে মসজিদ

এই মসজিদটির পাশে রয়েছে প্রাচীন খ্রিস্টান গির্জা পোরফিরিয়ুস। এটি গাজার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মসজিদ, যার আয়তন প্রায় ৩৭৭ বর্গমিটার। ১৩০৯১৩৪১ খ্রিস্টাব্দে মামলুক সুলতান নাসের মুহাম্মদ বিন কালাউন-এর আমলে এটি নির্মিত হয়। চলমান যুদ্ধে ইসরায়েলি গোলাবর্ষণে মারাত্মক ক্ষতি হয়।

غزه گنبد و مناره ندارد

৪. ইবনে উসমান মসজিদ

উমারি মসজিদের পর গাজার দ্বিতীয় বৃহত্তম ঐতিহাসিক মসজিদ, যার আয়তন প্রায় ২,০০০ বর্গমিটার। এটি শুজাইয়া এলাকায় অবস্থিত এবং মামলুক স্থাপত্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। নির্মাতা আহমদ বিন উসমান, যিনি নাবলুসে জন্মগ্রহণ করে গাজায় এসে স্থায়ী হন। ১৪০২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর মসজিদটি তাঁর নামেই পরিচিত হয়। বর্তমান যুদ্ধে এটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।

غزه گنبد و مناره ندارد

৫. আলী বিন মারওয়ান মসজিদ

গাজার তুফাহ এলাকায় অবস্থিত এই মসজিদের আয়তন প্রায় ৩২০ বর্গমিটার। মামলুক আমলে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় (১৩৭১ খ্রিস্টাব্দে)। শায়খ আলী বিন মারওয়ানের নামে নামকরণ করা হয়, যার সমাধি মসজিদের সংলগ্ন গম্বুজের নিচে অবস্থিত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি গাজার ধর্মীয় স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে টিকে ছিল, কিন্তু ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে।

غزه گنبد و مناره ندارد

৬. আল-জাফর দামরি মসজিদ

পুরনো শহরের পূর্বপ্রান্তে শুজাইয়া এলাকায় অবস্থিত এই মসজিদটির আয়তন ৬০০ বর্গমিটার। ঘোড়ার খুর আকৃতির প্রবেশদ্বারটি ছিল স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। মামলুক আমলের এই মসজিদটি ১৩৬১ সালে শিহাবউদ্দিন আল-জাফর দামরির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসরায়েলি বিমান হামলায় এটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়।

غزه گنبد و مناره ندارد

৭. আল-মাহকামা জামে মসজিদ (দরুল-কাযা মসজিদ)

৫৪৬ বর্গমিটার আয়তনের এই ভবনটি ১৪৫৫ খ্রিস্টাব্দে মামলুক যুগে নির্মিত হয় এবং পরে উসমানি যুগে শরিয়ত আদালত হিসেবে ব্যবহৃত হতোতাই একে মসজিদে মাহকামাবলা হয়। চলমান যুদ্ধে এটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।

غزه گنبد و مناره ندارد

৮. সাইয়্যেদা রুকাইয়া মসজিদ

শুজাইয়া এলাকার পূর্বাংশে অবস্থিত ১৭৪ বর্গমিটার আয়তনের এই ছোট মসজিদটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছে। এটি এক নারী রুকাইয়ার নামে নামকরণ, যিনি হয় এক উসমানি শাসকের স্ত্রী ছিলেন বা আলী বিন মারওয়ানের সংলগ্ন এলাকায় সমাধিস্থ ছিলেন।

غزه گنبد و مناره ندارد

৯. শায়খ উসমান কাশকার মসজিদ

গাজার প্রাচীনতম মসজিদগুলোর একটি, যা ১২২৩ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত। আয়তন মাত্র ৭০ বর্গমিটার। একটি মার্বেল ফলকে এর নির্মাণ সাল খোদাই করা আছে। ঐতিহাসিক মূল্য থাকা সত্ত্বেও এটি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়নি।

غزه گنبد و مناره ندارد

১০. খান ইউনুস জামে মসজিদ

দক্ষিণ গাজার বৃহত্তম মসজিদ, ১৯২৮ সালে নির্মিত এবং ১৯৫৪ সালে সম্প্রসারিত হয়। আয়তন প্রায় ৩,৩০০ বর্গমিটার। ইসরায়েলি বিমান হামলায় এটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়।

غزه گنبد و مناره ندارد

ধ্বংসের ভয়াবহতা ও পরিসংখ্যান

৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে মার্কিন সমর্থনে ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় যে গণহত্যা চালিয়েছে, তাতে ৬৭,১৭৩ জন শহিদ ১৬,৯৭,৭৮০ জন আহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। এছাড়া অনাহারে ৪৬০ জন, যার মধ্যে ১৫৪টি শিশু, প্রাণ হারিয়েছে।

ইসরায়েলি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গেভির প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে, “মসজিদগুলো সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে।এই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট, মসজিদ ধ্বংস তাদের ঘোষিত কৌশলের অংশ।

এছাড়া ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজার ধর্ম ও ওয়াকফ মন্ত্রণালয়ের প্রধান কার্যালয় এবং কুরআন রেডিওর অফিসও সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়েছে।

ইসরায়েলি বিমানগুলো সচরাচর খালি মসজিদে হামলা চালায় না; বরং নামাজের সময় বোমাবর্ষণ করেফলে শত শত নামাজি মসজিদের ধ্বংসাবশেষের নিচে শহিদ হয়েছেন।

غزه گنبد و مناره ندارد

ধ্বংসের উদ্দেশ্য ও ধর্মীয় তাৎপর্য

ইসরায়েল জানে মসজিদ শুধু ইবাদতের স্থান নয়; এটি ফিলিস্তিনি জনগণের ঐক্য, প্রতিরোধ ও ঈমানের কেন্দ্র। এখানেই কুরআনের হাফেজ তৈরি হয়, এখানেই ন্যায়বিচার ও ধৈর্যের শিক্ষা দেওয়া হয়। তাই দখলদাররা এই কেন্দ্রগুলো ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন:

আর কে অধিক জালিম সেই লোকদের চেয়ে, যারা আল্লাহর মসজিদে তাঁর নাম উচ্চারণে বাধা দেয় ও সেগুলো ধ্বংস করার চেষ্টা করে? তাদের উচিত নয় তাতে প্রবেশ করা, কিন্তু ভয়ভীত অবস্থায়। তাদের জন্য দুনিয়ায় লাঞ্ছনা এবং আখিরাতে রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি।
(
সূরা আল-বাকারা, আয়াত ১১৪)

এবং আরও বলেছেন:

যারা অন্যায়ভাবে তাদের ঘর থেকে উৎখাত হয়েছেকেবল এই কারণে যে, তারা বলেছিল আমাদের প্রভু আল্লাহ। যদি আল্লাহ এক দল মানুষকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যেতো গির্জা, মঠ, উপাসনালয় ও সেই সব মসজিদ যেখানে আল্লাহর নাম অধিক পরিমাণে স্মরণ করা হয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁকে সাহায্য করেন, যে তাঁকে সাহায্য করে; নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, শক্তিমান।
(
সূরা আল-হাজ, আয়াত ৪০) 4309516#

 

captcha