ইমাম খোমেনী (র) বলেছেন, রাসুলে খোদার রিসালাতের বার্ষিকীর চেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আর কোনও দিবস নেই। কারণ, এর চেয়ে বড় কোনও ঘটনা আর ঘটেনি। অন্যান্য নবী-রাসুলের নিযুক্তির চেয়েও এ ঘটনা অনেক বেশি বড়। এর চেয়ে বড় কোনও ঘটনা থাকার বিষয় কল্পনাও করা যায় না। এমন দিনে জনগণকে জুলুম থেকে মুক্তির উপায় বোঝাতে হবে জোরালোভাবে যাতে তারা বড় বড় জালিম শক্তিগুলোকে মোকাবেলা করতে পারে। জনগণ যে এটা করতে পারবে তা তাদেরকে বোঝাতে হবে। রাসুলে খোদার রিসালাতের লক্ষ্য হল মানুষের আচার-আচরণ, চরিত্র, তাদের আত্মা ও শরীরকে নানা ধরনের অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত করে সেখানে আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে দেয়া। রাসুলে খোদা সর্বশেষ রাসুল হিসেবে মানবজাতির কাছে এনেছেন পূর্ণ ধর্ম এবং মানব জাতির কাছে তুলে ধরেছেন তাঁর কাছে ওহি হিসেবে নাজিল-হওয়া মহাগ্রন্থ কুরআন।'
ইমাম খোমেনী (র) আরও বলেছেন, 'মহানবী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম রিসালাতের দায়িত্ব লাভের পর ধর্মের প্রচার শুরু করেন। ৮ বছরের শিশু হযরত আলী আলাইহিসসালাম ও হযরত খাদিজা আলাইহাসসালাম তাঁর প্রতি ইমান আনেন। এ দুইজন ছাড়া কেউই তাঁর সঙ্গে ছিলেন না। সবাইই জানেন যে তাঁকে কত বেশি যন্ত্রণা দেয়া হয়েছে এবং কত বেশি তাঁর বিরোধিতা করা হয়েছে ও নানা বাধা-বিপত্তির শিকার করা হয়েছে তাঁকে। কিন্তু তিনি হতাশ হননি। তিনি বলেননি যে, আমার তো কেউ নেই, বরং দৃঢ় থেকেছেন এবং দৃঢ় মনোবল ও আত্মিক শক্তি বা চেতনা নিয়ে শূন্য থেকেই রিসালাতকে এমন স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন যে আজ এই ১৯৬৯ সালে বিশ্বের ৭০ কোটি মানুষ তাঁর প্রচারিত ধর্মের ছায়াতলে রয়েছে। ইসলামের মহান নবীর এক হাতে ছিল কুরআন আর অন্য হাতে ছিল তরবারি। তরবারি ছিল বিশ্বাসঘাতকদের দমনের জন্য আর কুরআন ছিল মানুষকে সুপথ দেখানোর জন্য।'
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনী (র) বলেছেন, 'মহানবীর আগমনের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়া। তিনি মানুষের জন্য কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করতেন ও তাদের সংশোধন করতেন এবং পবিত্র করতেন। তাদের আত্মাগুলোকে পবিত্র করতেন। মানুষের সুশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য তিনি সবার চেয়ে বেশি কষ্ট করেছেন। আর তা করেছেন মজলুম মানুষকে জালিমদের হাত থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য। তাকে কত বেশি গালি দেয়া হয়েছে ও অপবাদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারে বিরত হননি।'
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে বলেছেন, 'মহানবীর খোদায়ী ও স্বাভাবিক মানবীয় প্রকৃতি সত্ত্বেও অনেক মানুষ তাঁর সামনে এসে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ত। কিন্তু তিনি মানুষের সঙ্গে কোমল ও সুন্দর আচরণ করতেন। অতি উচ্চ পর্যায়ের সফল সামরিক ও সমাজ-নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি সব কাজে অংশ নিতেন।'
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) সর্বকালের সেরা মহামানব ও আল্লাহর প্রিয়তম ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও জিকর ও ইবাদতের ব্যাপারে কখনও উদাসীন হননি। গভীর রাতে না ঘুমিয়ে কাঁদতেন এবং দোয়া ও ইস্তিগফার তথা তওবা করতেন।
তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেছেন, ‘মহানবীর স্ত্রী উম্মুল মু’মিনিন হযরত উম্মে সালমা (সালামুল্লাহি আলাইহা) এক রাতে দেখেন যে নবীজি তাঁর নিজ স্থানে নেই। খুঁজে দেখেন যে, তিনি ঘরের এক কোনে দাঁড়িয়ে দোয়া এবং কান্নাকাটি ও তওবাতে ব্যস্ত, আর বলছেন: হে আল্লাহ যে যোগ্যতা আমাকে দিয়েছেন তা কখনও আমার থেকে কেড়ে নেবেন না... হে খোদা! চোখের পলক ফেলার মত সামান্য সময়ের জন্যও আমাকে আমার নিজের ওপর ছেড়ে দেবেন না... শত্রু ও হিংসুককে আমার ব্যাপারে আনন্দিত করবেন না কখনও... যেসব মন্দ ও খারাপ বিষয় থেকে আমাকে মুক্ত রেখেছেন তা যেন আমার মধ্যে আসতে না পারে।
রাসুলের স্ত্রী কাঁদতে লাগলেন। কান্না শুনে রাসুল উঠে এসে বললেন: এখানে কি করছ? উম্মে সালমা বললেন: হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহ আপনাকে এতো ভালবাসেন ও আপনার কোনও গোনাহও নেই ( আগে ও পরের সব সময়ের জন্য আপনি নিষ্পাপ এবং ভুল-ত্রুটি মার্জনা করা আছে) তা সত্ত্বেও কেন কাঁদছেন ও বলছেন, হে আল্লাহ! আমাকে নিজের ওপর ছেড়ে দেবেন না?!!
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও রাসুল বললেন: না, আমিও নিরাপদ নই!!! আল্লাহ ইউনুস নবীকে চোখের পলক ফেলার এক মুহূর্তের জন্য তাঁর নিজের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন, দেখেছো তাতে তাঁর কি অবস্থা হয়েছে? আল্লাহর ব্যাপারে যদি গাফেল হই তাহলে কোন্ জিনিস আমাকে রক্ষা করবে?’
—ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, ‘হ্যাঁ, এর মধ্যে রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা। সম্মানের সময়, অপমানের সময়, কষ্ট বা বিপদের সময়, সুখের সময় এবং শত্রুর মাধ্যমে ঘেরাও হওয়ার সময় ও প্রবল পরাক্রান্ত শত্রুর কর্তৃত্বের সময়সহ সব অবস্থাতেই আল্লাহকে মনে রাখা ও তাঁকে ভুলে না যাওয়া এবং আল্লাহর ওপর নির্ভর করা ও আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করা- এটা এমন এক শিক্ষা যা মহান নবীজি আমাদের জন্য রেখে গেছেন।’
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামনেয়ী এ প্রসঙ্গে আরও বলেছেন, মহান আল্লাহ সব ক্ষেত্রেই মহানবীর দিকে লক্ষ্য রেখেছেন এবং আল্লাহর সর্বশেষ রাসুল সব ক্ষেত্রেই আল্লাহর সহায়তা চেয়েছেন। তিনি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেও ভয় পেতেন না। মহান আল্লাহর জন্য তাঁর দাসত্বের মূল রহস্য ঠিক এটাই। আল্লাহর মোকাবেলায় অন্য কোনও শক্তিকে বিন্দুমাত্র পরোয়া বা বিবেচনাই করতেন না। অন্যদের কথা ভেবে আল্লাহর পথ কখনও ত্যাগ করেননি বিশ্বনবী (সা)।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বিশ্বনবী (সা)’র রিসালাত লাভ প্রসঙ্গে বলেছেন, মানবজাতির ইতিহাসের এই মহান মিশনের লক্ষ্য হল মানুষকে মুক্তি দেয়া এবং তাদের আত্মা ও চরিত্রকে পরিশুদ্ধ, মার্জিত ও অলঙ্কৃত করার পাশাপাশি সব যুগের মানুষকে সব সংকট আর সমস্যা থেকে মুক্ত করা-যেসব সমস্যা ও সংকটের বেড়াজালে আজও ঘুরপাক খাচ্ছে মানুষ।
তিনি আরও বলেছেন, মহানবীর রিসালাতের লক্ষ্য ছিল মানুষের মুক্তি সাধন। ইসলাম ও মহানবীর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য রোগমুক্তির যে প্রেসক্রিপশন রয়ে গেছে তা সব যুগে মানুষকে মুক্ত করে অজ্ঞতা থেকে। এই নির্দেশিকা দিয়ে মোকাবেলা করা যায় জুলুম, বৈষম্য, দুর্বলের ওপর সবলের শোষণ এবং অন্য সব যন্ত্রণা যার শিকার মানবজাতি সৃষ্টির শুরু থেকে এ পর্যন্ত হয়েছে ও হচ্ছে। এই নির্দেশিকা যদি বাস্তবে মেনে চলা হয় তাহলেই সুফল আসবে। কিন্তু যদি ফেলে রাখা হয় বা এ থেকে ভুল অর্থ নেয়া হয়, কিংবা তা বাস্তবায়নের বা প্রয়োগের সাহস কেউ না করে তাহলে অবস্থা হবে সেই আগের মতই। সবচেয়ে ভালো ডাক্তারের শতকরা ১০০ ভাগ নির্ভুল চিকিৎসা-নির্দেশিকাও যদি আপনাকে দেয়া হয়, কিন্তু আপনি যদি তা পড়তে না পারেন, কিংবা তার ভুল পাঠ নেন, অথবা তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নেন ও তা পড়েই থাকে তাহলে রোগীর ওপর তার কী প্রভাব পড়বে! এবং ওই দক্ষ চিকিৎসককেই বা কি দোষ দেয়া যাবে? -পার্সটুডে