IQNA

মহান সংস্কারক সাইয়্যেদ জামাল শহীদ হন তুর্কি সুলতানের ষড়যন্ত্রে

17:56 - July 24, 2016
সংবাদ: 2601256
আজ হতে ১২৩ চন্দ্র-বছর আগে ১৩১৪ হিজরির এই দিনে ইস্তাম্বুলে শহীদ হয়েছিলেন বিশ্ব-ইসলামী ঐক্য ও পুনঃজাগরণ আন্দোলনের সংগ্রামী নকিব, দূরদর্শী আলেম, সাংবাদিক এবং সংস্কারক সাইয়্যেদ জামাল উদ্দিন আসাদাবাদী।

আত্মবিশ্বাস, ঐক্য ও ইসলামের অনুসরণের মাধ্যমে মুসলমানরা এবং মুসলিম দেশগুলো যে আবারও স্বাধীন ও শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হতে পারে- তার এই সুদৃঢ় বিশ্বাসকেই তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন উপনিবেশবাদ-কবলিত ও হতাশাগ্রস্ত মুসলমানদের মধ্যে।

মুসলিম বিশ্বে উপনিবেশবাদ-বিরোধী সংগ্রামের প্রবাদপুরুষ ও অক্লান্ত সংগঠক এই মহান নেতা সাইয়্যেদ জামাল উদ্দিন আফগানি নামেও বেশ পরিচিত। বিশ্বনবীর (সা) আহলেবাইতপন্থী এই আলেম সব মাজহাবের অনুসারী মুসলমানদের মধ্যে প্রভাব ফেলার জন্য আফগানি উপাধি ধারণ করেন।

তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের ষড়যন্ত্রে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে তাঁকে শহীদ করা হয়েছিল। এ সময় সাইয়্যেদ জামালের বয়স হয়েছিল ৫৯।

ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় হামেদান শহরের অদূরে আসাদাবাদে তাঁর জন্ম হয়েছিল। দর্শন, ধর্ম, মহাকাশ-বিদ্যা ও ইতিহাসে অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল তাঁর। আরবী, ফার্সি, তুর্কি, ইংরেজি, ফরাসি ও রাশিয়ার কয়েকটি ভাষায়ও পারদর্শী ছিলেন সাইয়্যেদ জামাল।

খুব কাছ থেকে মুসলমানদের অবস্থা দেখা ও মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে প্রত্যক্ষ এবং বাস্তব জ্ঞান অর্জনের জন্য ১৮ বছর বয়সেই সফর শুরু করেন সাইয়্যেদ জামাল। প্রথমে তিনি ইরাকে যান পড়াশুনার জন্য। এরপর তিনি যান ভারতে। ভারতে কয়েক বছর থাকার সময় তিনি ব্রিটিশপন্থী বুদ্ধিজীবী ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সার সাইয়্যেদ আহমদ খানের ইসলাম বিরোধী বিধ্বংসী চিন্তাধারার মোকাবেলা করার জন্য কলম ধরেছিলেন এবং রচনা করেছিলেন নানা প্রবন্ধ ও প্রচারপত্র।  তিনি কোলকাতায় এসে মুসলিম সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের চাপের মুখে ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য হন সাইয়্যেদ জামাল।

এরপর পবিত্র হজব্রত পালন করে তিনি সফর করেন ইস্তাম্বুল। সেখানে কয়েক বছর থাকার পর ফিরে আসেন ইরানে। তারপর কয়েক বছর কাবুলের আমির দোস্ত মুহাম্মাদ খানের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী আফগান শাসক শের আলি খান তাঁকে বহিষ্কার করলে এবার তিনি ইসলামী জাগরণের মিশন নিয়ে যান মিশরে। সেখানে তিনি বেশ সমাদৃত হন এবং প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও নেতা শেখ মুহাম্মাদ আবদুহ ছিলেন তাঁর ছাত্র। এক পর্যায়ে মিশরও ত্যাগ করতে বাধ্য হন প্যান-ইসলামিক আন্দোলনের এই মহান নেতা। এরপর সাইয়্যেদ জামাল সফর করেন প্যারিস, লন্ডন, মিউনিখ, মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গসহ প্রায় পুরো ইউরোপ।

মুসলমানদেরকে জাগিয়ে তোলার জন্য তিনি ফ্রান্স ও ব্রিটেন থেকে প্রকাশ করেছিলেন দুটি পত্রিকা। এ পত্রিকা দুটির নাম ছিল যথাক্রমে "উরওয়াতাল উসকা” এবং " জিয়া আল খাফেলিন”।

ইরানের কাজার সম্রাট নাসির উদ্দিন শাহ তাঁকে স্বদেশে ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানান এবং নিজের রাজনৈতিক উপদেষ্টার পদে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বনিবনা না হওয়ায় রাজা তাকে ইরাকে নির্বাসন দেন। ইরাক থেকে তিনি যান তুরস্কের ইস্তাম্বুলে। ডারউইনের বস্তুবাদী বিবর্তনবাদের বিপক্ষেও তিনি জোরালো যুক্তি-সমৃদ্ধ একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন।

ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে মুসলমানদের জিহাদে উজ্জীবিত করার জন্য সাইয়্যেদ জামাল কোনো কোনো মুসলিম দেশের সশস্ত্র বাহিনীতেও যোগ দিয়েছিলেন।

সাইয়্যেদ জামাল মুসলমানদের মুক্তি ও সংস্কারের জন্য নীচের যেসব কর্মসূচি বা কৌশল নিয়েছিলেন তা ছিল খুবই জোরালো ও যৌক্তিক:

এক. ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে সুসমন্বয় এবং এর যে কোনো একটির নামে অন্যটির অপব্যবহার রোধ করা।

দুই. আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সুসজ্জিত হওয়া, কিন্তু পশ্চিমা সংস্কৃতি ও আদর্শ পরিত্যাগ করা এবং ইসলামী বিশ্বাসের ভিত্তিতেই উন্নত মুসলিম সভ্যতা গড়ে তোলা।

তিন. কুসংস্কার ও অস্পষ্টতামুক্ত খাঁটি ইসলামের ধারায় ফিরে যাওয়া। কুরআনের পাশাপাশি নবী (সা.)’র সুন্নাতকেও প্রাধান্য দেয়া। সৎ কাজের নির্দেশ ও অসৎ কাজের প্রতিরোধসহ ইসলামের আবশ্যকীয় কর্মসূচিগুলোর ওপর জোর দেয়া এবং দর্শন ও যুক্তি-ভিত্তিক তৌহিদি চেতনার বিস্তার। ইত্যাদি।

চার. মুসলমানদেরকে ইসলামী আদর্শের খাঁটি অনুসারী হিসেবে গড়ে তুলে মুসলিম বিশ্বের স্বৈরশাসক এবং বিজাতীয় উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।

পাঁচ. অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রসহ উপনিবেশবাদের সব দিকের বিরুদ্ধে লড়াই। বিশেষ করে ব্রিটেন যে ক্রুসেডের চেতনা নিয়ে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে শত্রুতা অব্যাহত রেখেছে তা তিনি নিজ লেখনীতে তুলে ধরেছেন। (বায়তুল মোকাদ্দাস দখলে ইসরাইলকে সহায়তার মাধ্যমে ব্রিটেন তা পরবর্তীকালে প্রমাণ করেছে।) ব্রিটিশরা মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ, গোত্রবাদ, ভৌগলিক বা ভাষাগত ভেদাভেদ ও মাজহাবি দ্বন্দ্ব উস্কে দিয়ে মুসলিম দেশগুলোকে টুকরো টুকরো করার ষড়যন্ত্র যে অব্যাহত রেখেছে তাও তিনি উল্লেখ করেছিলেন তাঁর দূরদর্শী বক্তব্য ও লেখায়।

ছয়. মুসলমানদের মুক্তির জন্য বৃহত্তর ঐক্য ও জিহাদের অপরিহার্যতা তুলে ধরা। ব্রিটেনকে অপরাজেয় না ভাবা, বরং হতাশা ভুলে গিয়ে মুসলমানরা যে আবারো সব কিছুতে শ্রেষ্ঠ হতে পারবে সে আত্ম-বিশ্বাস পোষণ করা।

সাইয়্যেদ জামাল ইরানের জাতীয় স্বার্থ বিধ্বংসী ব্রিটেনের তামাক চুক্তির কথা ফাঁস করায় ততকালীন শীর্ষস্থানীয় ইরানি আলেম আয়াতুল্লাহ মির্জা শিরাজি তামাক বর্জনের ফতোয়া দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। এই ফতোয়ার ফলে তামাক খাতে ইরানের ওপর ব্রিটেনের শোষণের পথ বন্ধ হয়েছিল। অনেকেই মনে করেন পরবর্তীকালে (১৯০৫-৭) ইরানে সংঘটিত সংসদীয় বিপ্লবেও প্রভাব ফেলেছিল সাইয়্যেদ জামালের চিন্তাধারা।

তার চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও কবি আল্লামা ইকবাল লাহোরি, মুহাম্মাদ আলি জিন্নাহ, ভারতের শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মিশরের প্রখ্যাত ইসলামপন্থী নেতা মুহাম্মাদ আবদুহ, রাশিদ রেজা, আলী আবদুর রাজেক, কাসিম আমিন, লুতফি আসসাইয়্যিদ ও ওসমান আমিন এবং তুরস্কের নামিক কামাল, সাইদ নুরসি ও মুহাম্মাদ একেফ এরসোয় প্রমুখ।

সাইয়্যেদ জামালের কার্যক্রমের প্রশংসা করে ইরানি সমাজ বিজ্ঞানী ডক্টর আলী শরিয়তি লিখেছেন: "কি করে তিনি এতটা শক্তি ও প্রভাবের অধিকারী হলেন? হৃদয়ের অতল থেকে আর সীমান্তের ভূমি থেকে সোচ্চার কণ্ঠ জাগরণের পেছনে কোন্ কোন্ উপাদান সক্রিয় ছিল? এটা কি শুধু এ কারণে হয়নি যে, মুসলিম জাতিগুলো অনুধাবন করছিল যে সাইয়্যেদের আহ্বান এক পরিচিত ব্যক্তির আহ্বান? এটা ছিল ওই অনুভূতি যে এই কণ্ঠস্বর গৌরবময়, উদ্দীপনাময় এবং ঐতিহাসিক তাহজীব তমদ্দুনের গভীর থেকে উত্থিত। তারা প্রত্যক্ষ করল যে এটা আগন্তুকের কণ্ঠস্বর নয় কিম্বা সর্বাধুনিক কোনো বৈদেশিক চিন্তাধারারও সংস্করণ নয়। এ ছিল হেরা, মক্কা, মদীনা, উহুদ, কাদেসিয়া, জেরুসালেম (বায়তুল মোকাদ্দাস), জিব্রাল্টার প্রণালী ও ক্রুসেডে উত্থিত এবং পুনরায় ধ্বনিত কণ্ঠস্বরেরই প্রতিধ্বনি। এটা ছিল ইসলামের গৌরবময় ইতিহাসের পাতায় দীর্ঘদিন ধরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত সেই একই আহ্বান-মুসলমানদের জিহাদে জীবন উৎসর্গ করার”। .... #

captcha