বার্তা সংস্থা ইকনা: আর এই সুবাদে ও নানা সময়ে তিনি বেশ কয়েকবার ইসলামী বিপ্লবের কিংবদন্তীতুল্য রূপকার ইমাম খোমেনী (র)’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই চিন্তাবিদ বিপ্লবের পরের মাসেই গিয়েছিলেন পাকিস্তানে এবং সেখানে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মরহুম সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদুদির একমাসের মেহমান ছিলেন তাঁর বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি করার কাজে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের প্রতি মাওলানা মওদুদির অকুণ্ঠ সমর্থনের পেছনে তার সঙ্গে ডক্টর রাশিদ বেনআইসসা’র আলোচনার প্রভাব ছিল বলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই চিন্তাবিদ মনে করেন। রেডিও তেহরান, বাংলা বিভাগ ইসলামী বিপ্লবের ৩৮তম বিজয়-বার্ষিকী উপলক্ষে আলজেরীয় বংশোদ্ভূত এই ফরাসি চিন্তাবিদের অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকার সম্প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে। এখানে তাঁর ওই সাক্ষাৎকারের প্রধান কিছু অংশ তুলে ধরা হল:
রেডিও তেহরান: জনাব অধ্যাপক ডক্টর রাশিদ, আপনি হচ্ছেন সেইসব সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের অন্যতম যিনি ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনী (র)’র সঙ্গে কয়েকবার সাক্ষাৎ করেছেন। ইমাম খোমেনী সম্পর্কে আপনার অনুভূতি ও মনের কথা যদি আপনি তুলে ধরেন..
অধ্যাপক ডক্টর রাশিদ: প্রথমেই আমি ইরানের মুসলিম জাতি ও বিশ্বের মুসলমানদের অভিনন্দন জানাতে চাই বিশ্বকে এমন এক মহান ব্যক্তিত্বকে উপহার দেয়ার জন্য যাকে বলা হয় ইমাম খোমেনী। তিনি বিশ্বের জন্য মহান আল্লাহর এক বড় উপহার। তার নাম ‘রুহুল্লাহ’ তথা মহান আল্লাহর অনুপ্রেরণা যা তাঁর পক্ষ থেকে আসে বিশ্ব-জগতে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লব এর সূচনালগ্ন থেকেই বিশ্ব নেতৃবৃন্দের আলোচনার মূল ফোকাসে রয়েছে। সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, ইরানের ইসলামী বিপ্লব কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প।
কমিউনিস্ট বিপ্লব ছিল ইউরোপীয় সংস্কৃতির ভেতরে একটি কলঙ্ক। কার্ল মার্কস ছিলেন জার্মান। পশ্চিমা সংস্কৃতির ভেতরেই ঘটেছিল কমিউনিস্ট বিপ্লব। কিন্তু ইমাম খোমেনী (র) এসেছেন বাইরের অঞ্চল থেকে। তিনিই আধুনিক যুগে প্রথমবারের মত পশ্চিমা সংস্কৃতির কর্তৃত্ব ও আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। ফলে প্রথমবারের মত পশ্চিমা সংস্কৃতি নিজের ওপর সন্দিহান হয়। বড় বড় নৃতত্ববিদদের অনেকেই এ বিষয়ে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। তাদের একজন ছিলেন ফ্রান্সে। তিনি বলেছেন, ‘আমরা মুসলমানদের নিন্দা করছি ‘মৌলবাদের’ জন্য। উগ্রবাদীদের মৌলবাদের জন্য এটা করছি আমরা। কিন্তু এর বিরোধিতা করার মতো কী রয়েছে আমাদের কাছে?... মূল্যবোধের দিক থেকে আমাদের কিছুই নেই তুলে ধরার মতো। যখন ইমাম খোমেনী জাগিয়ে তুলতে এলেন আমরা তখন সমাজে ধর্মীয় পবিত্রতার বিষয়ে বিতর্ক করছি। কারণ আমরা ব্যক্তিগত জীবন ছাড়া সব কিছু থেকেই ধর্মীয় পবিত্রতাকে ধুয়ে ফেলেছি।’
সে সময় ইংল্যান্ডে আমি একটি বই পড়েছিলাম। বইটার নাম ছিল, ‘বিধাতার দাফন বা শেষকৃত্য’। ভেবে দেখুন ধর্মের কি অবস্থান ছিল তখন! (ধর্মীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে তখনও চলছিল মানুষের বিদ্রোহ)
পশ্চিমা সমাজ-ব্যবস্থায় মহান স্রস্টার কোনও ভূমিকা ছিল না সে সময়। আর এ অবস্থায় মুসলিম সংস্কৃতিতে জন্ম-নেয়া এক ব্যক্তি এগিয়ে এসে বললেন, না, সমাজে আল্লাহর ভূমিকা রয়েছে। আর তা হচ্ছে কর্তৃত্বকামী অবস্থান। এটা হচ্ছে সরকারের অবস্থানের চেয়েও উঁচু অবস্থান তথা সর্বোচ্চ অবস্থান। সরকার এই অবস্থানের অধিকারী নয়। সরকার এ প্রশ্নের উত্তর দেয় যে কিভাবে পরিচালনা ও শাসন করতে হবে। কিন্তু কোন্টি ভালো ও কোন্টি খারাপ তা বলে দেন সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। সরকার দৈনন্দিন নানা সমস্যার সমাধান দেয়।
কিন্তু ওলিয়ে ফকিহ বা সর্বোচ্চ ইসলামী আইনবিদ হচ্ছেন এমন একজন জ্ঞানী ব্যক্তি যিনি খোদায়ী কর্তৃত্ব বা সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অন্যদের বলে দেন তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যাতে সমাজের মূল্যবোধগুলো সম্পর্কে বৈধতা ও দিক-নির্দেশনা দেয়া যায়। আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের অধিকারী হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি একজন আরেফ। তিনি সেই বিরল ব্যক্তিদের একজন যিনি পুনর্গঠন করেছেন এরফান যাকে বলা হয় তাসাওউফ যাতে রয়েছে জ্ঞান, যুক্তি ও রাষ্ট্র। এমনটি আপনি খুব কম বা খুব বিরল ব্যক্তির মধ্যেই পাবেন যে আপনি যখন তার তাফসির পড়বেন তখন যেন আপনি সাক্ষাৎ পাবেন রুমি, হাফিজ ও ইবনে আরাবির। তিনি সবাইকে ইবনে আরাবির কথা বলতেন, সব ছাত্রদের বলতেন ইবনে আরাবি সম্পর্কে জানতে। ইবনে আরাবি মুসলমানদের জন্য সর্বোচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিক দিগন্ত। এইসব ব্যক্তিগত যোগ্যতার দিক ছাড়াও ইমাম খোমেনীর ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী ইচ্ছাশক্তি। ফলে তিনি ছিলেন আপোষহীন। সবাই তাকে কিছুটা নমনীয় ও কম উচ্চকিত হওয়ার পরামর্শ দিলেও তিনি কখনও আপোষ করতেন না।
হ্যাঁ, ইনিই ছিলেন ইমাম খোমেনী যিনি বদলে দিয়েছেন বিশ্বকে। আমরা দেখছি এখন সারা বিশ্বে তার প্রভাব। তার অনুসারীরা তার দেখানো ওই পথেই চলছেন এবং ইরানের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীও চলছেন সেই পথেই কিছু ঘরোয়া অনিবার্য অনিয়ম সত্ত্বেও। কারণ, সব ইরানিকেই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। বাইরের প্রচারমাধ্যমগুলোর প্রভাবে অনেকেই বিভ্রান্ত হন। এসব প্রচারমাধ্যম বিকৃত খবর পরিবেশনসহ নানাভাবে বাস্তবতাকে বিকৃতভাবে তুলে ধরে। কিন্তু এখনও ইরানের ক্ষমতা রয়ে গেছে ইমাম খোমেনী (র)’র হাতেই। আর এ জন্যই ইরানের নেতৃবৃন্দকে বজায় রাখতে হচ্ছে স্বাধীনচেতা মনোভাব ও নতজানু না হওয়ার এবং সব সময় মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার দিকে লক্ষ্য রাখার প্রবণতা।
সবাই যখন মরহুম ইমাম খোমেনীকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে ইরানের রাষ্ট্রীয় ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন না করার তখন তিনি তাদের এই উপদেশে কান দেননি। অনেক ইরানিও এ পরামর্শ দিয়েছিলেন তাকে। তাদের যুক্তি ছিল এটা যে যখন বিশ্বের বৃহত্তম অনারব সুন্নি রাষ্ট্র তুরস্ক ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে এবং এই দখলদার ও বর্ণবাদী শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে বিশ্বের বৃহত্তম আরব রাষ্ট্র মিশরও তখন আমরা কেন আমাদের দেশকে বিপদের দিকে ঠেলে দেব? কিন্তু ইমাম খোমেনী তাদের এ পরামর্শে কান না দিয়ে ইসরাইলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করলেন।
অথচ ইসলামী ইরান বিগত ৪০ বছরে (পশ্চিমা শক্তিগুলোর চাপে সৃষ্ট) বিচ্ছিন্নতার যে সমস্যায় ভুগছে তার অবসান কেবল একটি আহ্বানেই হতে পারত। ইরানি প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ যদি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে বলতেন যে আমরা তোমাদের সেই শিল্প-কারখানাগুলোকে ফিরিয়ে দেব তোমাদের কাছে যা আমরা দিয়ে দিয়েছি ফিলিস্তিনিদেরকে, তাহলে তারা ইরানের এ সমস্যার সমাধান করতো। কিন্তু ইমাম খোমেনী এ বিষয়কে একটি রেড-লাইন বা লাল-সীমানা হিসেবে ঘোষণা করে গেছেন। এই সীমার মধ্যে রয়েছে মুসলমানদের ভূমি ও ৫০ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থীর ভাগ্য, ইত্যাদি। অর্থাৎ এসব বিষয়ে কোনও আপোষ করা যাবে না।
আর এটাই হল ইসলামের ইচ্ছাশক্তি যা আপোষহীন ও অদম্য। আর এই মহান ব্যক্তিকেই উপহার দিয়েছে ইসলাম ও মুসলমানরা বিশ্বের কাছে।
রেডিও তেহরান: সাম্রাজ্যবাদী কয়েকটি শক্তি ও তাদের অনুচর সরকারগুলো ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বদনাম করার জন্য শিয়া মুসলিম মাজহাবের সঙ্গে সুন্নি মুসলিম মাজহাবের মতপার্থক্যকে অপব্যবহারের চেষ্টা করছে। এ সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই।
অধ্যাপক ডক্টর রাশিদ: বর্তমানে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা দেখছি তথাকথিত শিয়া-সুন্নি সমস্যা। এটা খুবই পরিকল্পিত বিষয়। আমার মনে আছে ১৯৭২ সালে ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এক বড় সম্মেলন। প্রায় এক হাজার সুন্নি আলেম অংশ নিয়েছিলেন এই সম্মেলনে। সম্মেলনটি হয়েছিল আট নয়'শ বছর আগের বিশিষ্ট শিয়া মুসলিম বিজ্ঞানী শেখ তুসির স্মরণে। যারা আসতে পারেননি এ সম্মেলনে তাদের অনেকেই এই সম্মেলনে প্রবন্ধ পাঠিয়েছিলেন। আর তাদেরই একজন ছিলেন আল্লামা মওদুদি। সে সময়কার বড় কোনও বইয়ে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের বিষয়ে কোনও কথা দেখা যেত না।
দশকের পর দশক ধরে ক্ষমতায়-থাকা ইরানের শাহ ছিলেন শিয়া। আর এ বিষয়টি সবাই জানত।
সেযুগে সব মুসলিম দেশেই ছিল কমিউনিস্ট পার্টি। আর এসব দল সংসদেও ছিল গ্রহণযোগ্য। তারা আল্লাহ বা ঈশ্বরে বিশ্বাস করতো না এবং কোনও নবী-রাসুলকেও বিশ্বাস করত না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদেরকে স্বীকৃতি দেয়া হতো।
১৯৭৭ সনের ২৭ আগস্টে লন্ডনের কিংস্টন হোটেলে ২৫ দিন ধরে একটি ধর্মীয় সম্মেলন হয়েছিল যার যৌথ আয়োজক ছিল মার্কিনপন্থী শিয়া ইরান সরকার ও মার্কিনপন্থী সুন্নি সৌদি সরকার। সেখানে ৯০০ জন আলেম অংশ নিয়েছিলেন। মুসলিম বিশ্বের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করলেও তাদের আলোচনায় শিয়া-সুন্নি মতভেদের প্রসঙ্গটিই কখনও এমনকি একবারের জন্যও আমি শুনিনি।
এর ঠিক এক বছর পর ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইরানে ঘটে যায় ইসলামী বিপ্লব। এ সময় সৌদি সরকার শুরু করে শিয়া ও ইরান-বিরোধী প্রচারণা। শিয়া মাজহাব যেন একটি ‘অবৈধ’ মাজহাব এবং তা রিয়াদ-তেহরান সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, আর এই বাধা দূর করতে হবে! সৌদি আরবের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার এক উল্লেখযোগ্য অংশও শিয়া মুসলমান।
এই প্রেক্ষাপটে ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইরান ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এর মাধ্যমে আরব সরকারগুলোকে তাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। আর এ জন্যই শুরু হয় সৌদি, কাতারি ও আমিরাতি এবং মিশরিয় সরকারসহ আরব মুনাফিক সরকারগুলোর ইরান-বিরোধী সম্মিলিত কোরাস ও হৈ-চৈ। খোমেনীর ইসরাইল-বিরোধী অবস্থানই তাদের বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট করে। এই সরকারগুলো ফিলিস্তিনিদের জন্য কিছুই করতে চায়নি ও এখনও তাদের জন্য কাজ করতে চায় না। বরং তাদের অধিকারকে ঠেকিয়ে রাখতে চায়।
শোনা যাচ্ছে, কিছু দিন (দুই সপ্তাহ) আগে নেতানিয়াহু গোপন সফরে সৌদি আরব গিয়েছিলেন।
তারা তথা আরব সরকারগুলো চায়নি যে খোমেনী সেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করুক যা করা উচিত ছিল আরব রাজা-বাদশাহদের। তাদের কথা: খোমেনী তো আরব নন। তিনি তো ফিলিস্তিনিদের প্রতিবেশী নন। বৃহত্তম আরব দেশ মিশরের উচিত ছিল ফিলিস্তিনিদের সহযোগিতা করা। সাত লাখ আরব-সুন্নি ও প্রতিবেশী ফিলিস্তিনি শরণার্থীর জন্যও কিছুই করেনি মিশর সরকার। তারা যদি সুন্নিদের প্রতি আন্তরিক হত তাহলে অবশ্যই তাদের সাহায্য করতো। তারা কি করেছে বসনিয়ার জন্য? বসনিয়ায় সাড়ে তিন লাখ মুসলমান নিহত হয়েছে। আর তা ঘটেছে ইউরোপের মধ্যে ইউরোপীয়দের হাতে!
আমি সেখানে অনেকবার গিয়েছি। প্রতি তিন মাস পর পর আমি বসনিয়া সফর করতাম। আমি ইজ্জতবেগোভিচের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম তিন বার। তিনি বলেছিলেন, ইরান না থাকলে বসনিয়ার অস্তিত্বই থাকতো না। ইসলামী ইরানই বসনিয়ার এক লাখ ২০ হাজার সেনাকে অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এসবই করেছে শিয়া খোমেনী ও শিয়া-ইরান। কেন সুন্নিরা তাদের সাহায্য করেনি? বার্মায় এখন কি ঘটছে?
সৌদি সরকার এখন ইয়েমেনকে ধ্বংস করছে ও সেখানকার সন্ত্রাসীসহ সন্ত্রাসী নানা গোষ্ঠীকে অর্থ দিচ্ছে। অথচ সব আরব গোত্রের উৎসস্থল ইয়েমেন। সৌদি আরবের দুই-তৃতীয়াংশ জনগণই ইয়েমেনি। কিন্তু দেখুন সৌদিরা কি করছে ইয়েমেনে? এটা কি রাসুলের সুন্নাত?
তাই এই প্রতারণার বিষয়টি সবাইকে বুঝতে হবে। জনগণ এখন এসব বিষয়ে ক্রমেই বেশি সচেতন হয়ে উঠছে।
তারা ও ইসরাইল সিরিয়াকে ভয় পাচ্ছে। কারণ, সিরিয়া ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়নি। আর এটাই হচ্ছে সিরিয়ার একমাত্র অপরাধ। ইসরাইল গাদ্দাফির সঙ্গেও একই ধরনের কাজ করেছে। গাদ্দাফি ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে শত শত কোটি ডলার অর্থ দিয়েছেন নিজেকে রক্ষার জন্য। কিন্তু তিনি কেন ফিলিস্তিনিদের এতো অর্থ দেননি?
তিন চার বছর আগে আমি ফিলিস্তিনি নেতা ইসমাইল হানিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম। তিনি জানান, ইরানে সফরের আগে তিনি কাতারে এসেছিলেন। তাকে বলা হল, ইরানে যাবেন না। হানিয়া বললেন: আমি ইরানে যাচ্ছি অর্থ ও ক্ষেপণাস্ত্র আনতে। আমাকে তাহলে অর্থ ও ক্ষেপণাস্ত্র দিন, আমি তাহলে ইরানে যাব না।
তাই সত্যকে ঢেকে রাখা আপনার পক্ষে সব সময় সম্ভব নয়। আপনি সব সময় মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারবেন না।
রেডিও তেহরান: ইরানের সঙ্গে জাতিগুলোর সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে? এ সম্পর্কে কিছু বলুন:
অধ্যাপক ডক্টর রাশিদ: ইরানের সঙ্গে জাতিগুলোর সম্পর্কের ভবিষ্যৎ বিষয়ে বলতে গেলে বলা যায়, এই ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল।
ইরান হয়ে উঠছে পরাশক্তি। অন্যদিকে ফ্রান্স সৌদির কাছে বিক্রি করেছে ১৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র। এতো অস্ত্র তার কেন দরকার তা স্পষ্ট নয়। এসব অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে নিরপরাধ ও দরিদ্র-দুর্বল ইয়েমেনের বিরুদ্ধে। ইরানও এর টার্গেট। সৌদিদের দিন শেষ হবে ইনশাআল্লাহ। তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যেই তাদের এবং দায়েশসহ সব ওয়াহাবি গোষ্ঠীর দিনও শেষ হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। ইনশাআল্লাহ আমরা ইতিহাসের দিকে ফিরে আসব। কারণ, দিনকে দিন আমরা বেশি বেশি আত্মবিশ্বাস দেখতে পাচ্ছি ও বেশি বেশি সমর্থক দেখতে পাচ্ছি আত্মপরিচিতি নিয়ে জীবন যাপনের পক্ষে।.. সত্যের বিজয় হবেই।
সৌভাগ্যক্রমে বা দুর্ভাগ্যক্রমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পাশ্চাত্যের ঐক্যকে ধ্বংস করছেন। যা মুসলিম বিশ্বের জন্য কল্যাণকর। তবে মুসলিম ও আরব বিশ্বকেও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তাদেরকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নানা বিভেদের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে ঐক্যবদ্ধ না হলে তারা বার্মার মুসলমানদের রক্ষা করতে পারবে না। পাশ্চাত্যের ওপর বা অমুসলিম দেশগুলোর ওপর আস্থা রাখা উচিত হবে না মুসলমানদের।
কথিত সালাফি বা ওয়াহাবিরা কিছুই করতে পারবে না। তারা কোনও ইতিবাচক ভূমিকাই রাখবে না মুসলমানদের জন্য। ইনশাআল্লাহ তাদের দিন শেষ হয়ে যাবে। মুসলমানদের ভেতরকার নানা দুর্বলতা ও উগ্রতাগুলো দূর করতে হবে।
রেডিও তেহরান: ইসলামী বিপ্লবের পরপরই আপনি সাক্ষাৎ করেছিলেন মরহুম মাওলানা মওদুদির সঙ্গে। তাকে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সমর্থকে পরিণত করার পেছনে কী আপনার কোনো ভূমিকা ছিল?
অধ্যাপক ডক্টর রাশিদ: ইসলামী বিপ্লবের প্রথম মাস ফেব্রুয়ারিতে আমি ইরানে ছিলাম এবং এরপর আমি পাকিস্তানে যাই। আমার পিএইচডি থিসিসের বিষয় ছিল 'মাওলানা মওদুদি'। আমি এক মাস আল্লামা মওদুদির মেহমান ছিলাম। এর দুই মাস পর মওদুদি (র) ইন্তেকাল করেন। আমি তার কাছে ইসলামী বিপ্লব সম্পর্কে প্রথম রিপোর্ট তুলে ধরেছিলাম। তার কাছে এক দল বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তারা এ ইতিহাস চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিলেন যে (শিয়া ও সুন্নি) মুসলমানরা পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। আমি তাকে বলেছিলাম যে, ইতিহাস খুব একটা নৈতিকতাপূর্ণ হয় না। আমাদেরকে সব পুরোনো সংঘাত থেকে উঠে আসতে হবে। আর এটাই হল সুযোগ। আপনি যে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রশংসা করছিলেন ও যে রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছিলেন খোমেনি তা বাস্তবায়ন করছেন। আপনি (এ বিষয়ে) সুস্পষ্টভাবে বিশেষজ্ঞদের চেয়েও বেশি দক্ষ। তখন তিনি উঠে গিয়ে আমাকে তার লেখা একটি বই দিলেন। বইটির নাম ‘খেলাফত ও রাজতন্ত্র’। আমি বইটি আরবিতে অনুবাদ করেছি। বইটির শেষ চ্যাপ্টার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে শিয়া-সুন্নি মতভেদের ঐতিহাসিক প্রসঙ্গটি এসেছে। মহানবীর (সা) সব সাহাবিকে ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে রেখে বা তাদের সব কিছুকে পবিত্র ধরে বিচার করার বিষয়টি এর সঙ্গে সম্পর্কিত।
আসলে কুরআন আর ইতিহাস এক বিষয় নয়। ইতিহাস হল বর্ণনামূলক। কী কী ঘটেছিল তা বলে দেয় ইতিহাস। আর কুরআন হল আদেশ-নির্দেশদাতা। কুরআন আমাদের বলে: কী করতে হবে এবং কী করা উচিত নয়। সাহাবারা একে-অপরকে হত্যা করেছেন। সিফফিন যুদ্ধে নিহত সাহাবিদের সংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ। মাওলানা মওদুদি ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়কে ইতিহাসের আলোকেই ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি একে কথিত পবিত্রতার গণ্ডি থেকে বের করে এনেছেন। এর সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। হাজ্জাজ প্রায় এক লাখ সাহাবাকে হত্যা করেছে। আর ইয়াজিদ কারবালার ট্র্যাজেডি ঘটানোর পর কাবা ঘর ধ্বংস করে ও সিরিয় বাহিনীকে মদিনায় পাঠিয়ে তাদেরকে সেখানে গণ-ধর্ষণের অনুমতি দিয়েছিল। ফলে মদিনায় এক হাজার কুমারী মেয়ে গর্ভবতী হয়েছিল। তারা ছিল সাহাবিদের কন্যা। তাই এসব ইতিহাসকে তো পবিত্রতার গণ্ডিতে রাখা যায় না। এসব ঘটনাকে কি ইসলামের ইতিহাস বলে পবিত্রতা দেয়া যায়?
আজ ইসলামের বিকৃত ও ওয়াহাবি ব্যাখ্যার কারণে অনেক ফিলিস্তিনি ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধ না করে সিরিয়ায় গিয়ে নিজেকে বিস্ফোরিত করছে ও আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে মুসলমান ভাইকে হত্যা করছে। ইনশাআল্লাহ মুসলমানরা সৌদি ওয়াহাবিদের এই ষড়যন্ত্রের জাল থেকে বেরিয়ে আসবে। তাদের ভবিষ্যৎ হবে খুবই উজ্জ্বল। #
পার্সটুডে