IQNA

আলোকবিজ্ঞানে ইবনে হায়সামের অবদান

15:41 - August 23, 2021
সংবাদ: 3470546
তেহরান (ইকনা): খলিফা দ্বিতীয় হাকাম আল-মুন্তাসির বিল্লাহর শাসনকাল (৯৬১-৭৬ সাল) ছিল মুসলিম বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও তাহজিব-তমদ্দুনে উৎকর্ষ সাধনের স্বর্ণযুগ। স্বয়ং খলিফা হাকামই ছিলেন একজন বইপ্রেমিক মানুষ।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা এবং বিকাশে তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ। তাঁর বিখ্যাত রাজকীয় কুতুবখানায় চার লাখের বেশি বই ছিল। স্পেনের এই স্বর্ণযুগে আর্ভিভূত হন বিখ্যাত মুসলিম দৃষ্টিবিজ্ঞানী হাসান ইবনে আল-হায়সাম। অসামান্য প্রতিভা ও যোগ্যতা বলে আল-হায়সাম বিজ্ঞানজগতের উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হন। আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীরা তাঁকে Alhazen নামে স্মরণ করেন।

হাসান ইবনে আল-হায়সাম ৯৬৫ সালে কর্ডোভার এক সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের সময় কর্ডোভায় বিজ্ঞানের প্রায় সব শাখায় ব্যাপক চর্চা হতো। আল-হায়সাম কর্ডোভার বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। এক চিকিৎসক পরিবারে জন্ম হওয়ায় তিনি চিকিৎসা ও পদার্থবিদ্যায় বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং অল্প বয়সেই চিকিৎসক হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তাঁর সুনাম সুদূর মিসর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

মিসরের ফাতেমি খলিফা আল-হাকিম (৯৯৬-১১২০ খ্রি.) অত্যন্ত বিদ্যোৎসাহী শাসক ছিলেন। তিনি ১০০৫ সালে কায়রোতে দার-আল-হিকমাহ বা বিজ্ঞানাগার স্থাপন করেন। তিনি আল-মুকাওয়ামে একটি মানমন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি আল-হায়সামকে তার অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। এখানে আল-হায়সাম আবহাওয়া ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে গভীর গবেষণা করেন। এই সময় নীলনদের বার্ষিক প্লাবন নিয়ন্ত্রিত করতে খলিফা আল-হায়সামকে আদেশ দেন। আল-হায়সাম খলিফাকে কাজটি সমাধা করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন। ফলে খলিফা আল-হাকিম তাঁর ওপর ক্ষিপ্ত হন। খলিফার আক্রোশ থেকে বাঁচতে তিনি পাগলামির ভান করে থাকেন। এ সময় তিনি অতি গোপনে গ্রিক ও ল্যাটিন থেকে প্রাচীন অঙ্কশাস্ত্র ও পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থগুলো তর্জমা করেন। এ ছাড়া তিনি নিজেও কয়েকটি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। জীবনের শেষদিকে তিনি আলোকবিজ্ঞানে গভীর গবেষণা করেন। ১০৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি কায়রোতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

ইবনে আল-হায়সাম গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে প্রায় শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু দৃষ্টিবিজ্ঞান বিষয়ক তাঁর মৌলিক গ্রন্থ ‘কিতাব আল-মানাজির’ রচনা করে তিনি বিজ্ঞানজগতে অমর হয়ে আছেন। বর্তমানে বইটির ল্যাটিন অনুবাদ পাওয়া যায়, যা ১৫৭২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। ‘কিতাব-আল-মানাজির’ পুরো মধ্যযুগে আলোকবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার একমাত্র অবলম্বন ছিল। ফলে রোজার বেকন, কেপলার, লিউনার্ডো প্রমুখ শ্রেষ্ঠ আলোকবিজ্ঞান বিশারদরা তার দ্বারা উপকৃত হয়েছিলেন। রোজার বেকন তাঁর রচনাবলির ওপর ভিত্তি করেই দৃষ্টিবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা চালিয়েছিলেন। কিন্তু আল-হায়সামের চিন্তাধারার সূত্র ধরে তাঁর যোগ্য উত্তরাধিকারী কুতুবউদ্দীন সিরাজি ও আল-ফারাসি আরো গবেষণা করেন। আকাশের গায়ে রংধনুর প্রতিফলিত বর্ণবৈচিত্র্যের বিষয়ে গভীর গবেষণা করেই মুসলিম পদার্থ-বিজ্ঞানীরা ‘ইলমে-কাউস-কুজাই’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানশাখার সৃষ্টি করেছিলেন।

ইবনে আল-হায়সামই সর্বপ্রথম দৃষ্টিশক্তি এবং তার প্রতিফলন ও প্রতিসরণ বিষয়ে গ্রিকদের ভুল ধারণার নিরসন করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে আমাদের চোখে আলোকরশ্মি বাহ্য পদার্থ থেকেই প্রতিফলিত হয়, চক্ষু থেকে আলো বের হয়ে বাহ্য বস্তুকে দৃষ্টিগোচর করায় না। আমাদের অক্ষিপটের অর্থাৎ চক্ষুগোলকের পেছনে যে ঝিল্লি আছে, তার অবস্থান দৃষ্টিস্থানের ঠিক কোন জায়গায় তিনি সঠিকভাবে তা নির্ধারণ করেন এবং প্রমাণ করেন যে এখানে যে বাহ্য বস্তুর প্রতিফলন হয় তাই আমাদের দৃষ্টিশিরার ভেতর দিয়ে মগজে পৌঁছায়। আল-হায়সাম বায়ু ও পানির মতো স্বচ্ছ ও তরল পদার্থের ভেতর দিয়ে দৃষ্টিশক্তি ও প্রতিফলিত আলোকের বিষয় নিয়ে গভীর গবেষণা করেন। কাচের গ্লাসে পানি রেখে গবেষণার দ্বারা তিনি ম্যাগনিফাইং গ্লাস আবিষ্কার করেন।

আল-হায়সাম ইউক্লিড ও টলেমির আলোকবিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থগুলোর এবং অ্যারিস্টটলের ‘ফিজিকস’ বা পদার্থবিদ্যা ও ‘প্রোবলোমিটার’-এর বিশদ ভাষ্য রচনা করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁর কোনো আসল রচনার অস্তিত্ব আজ আর নেই। অনুবাদের ভেতর দিয়ে আমরা তাঁর মনীষার পরিচয় পাই। তবু এ কথা অনস্বীকার্য যে তাঁর প্রতিভা জগেক সমৃদ্ধ করেছে, আমাদের জ্ঞান-সম্পদকে বহুগুণে বর্ধিত ও প্রসারিত করেছে।

captcha