IQNA

রবীন্দ্রনাথ কি মূর্তিপূজক ছিলেন?

16:22 - November 01, 2021
সংবাদ: 3470903
তেহরান (ইকনা): রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী; এটা এমন এক তথ্য যে ব্যাপারে বিতর্ক নেই। সুতরাং তাঁকে কালী বা অন্য কোনো দেব-দেবীর উপাসক মনে করে নেয়া অন্যায় হবে।

আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلا تَعْدِلُوا اعْدِلُوا هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়াও এবং কোনো জনগোষ্ঠীর দুশমনী যেন তোমাদেরকে ভারসাম্য (সুবিচার/ ইনছাফ্) বজায় না রাখার গুনাহে প্ররোচিত না করে। তোমরা ভারসাম্য (সুবিচার/ ইনছাফ্) বজায় রাখ, (কারণ,) এটাই তাক্বওয়ার সর্বাধিক নিকটবর্তী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; নিঃসন্দেহে তোমরা যা কিছুই কর আল্লাহ্ সে সম্পর্কে অবগত। ” (সূরাহ্ আল্-মাএদাহ্ : ৮)

ভালোভাবে না জেনে কোনো বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করা আমাদের অনেকেরই অভ্যাস।

১৯৭০ সালের একটি ছোট্ট ঘটনা। একবার আমাদের সিনিয়র এক ভদ্রলোক - ঐ সময় যিনি ছিলেন কামেল পাশ ও যদ্দূর মনে পড়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র এবং তিনি ব্যক্তিগতভাবে ইসলাম সম্পর্কে প্রচুর পড়াশুনা করেছিলেন। তিনি এক মফস্বল শহরের এক মসজিদে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় হিন্দুরা কীভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতা করছে তার দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে বলেন যে, নজরুল ইসলামের কাছে বিবাহ দেয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথের মেয়েকে।

সময়টা যেহেতু ছিলো ১৯৭০ সাল এবং তখন দেশে শিক্ষার হার ছিলো কম; মসজিদের মুছুল্লীদের মধ্যে প্রকৃত বিষয়টি সম্ভবতঃ আর কারোই জানা ছিলো না, তাই কোনো ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় নি। পরে আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেই যে, তিনি ভুল কথা বলেছেন, কারণ, নজরুল ইসলামের স্ত্রী আশালতা সেনগুপ্তা (নজরুল যাকে প্রমীলা নাম দেন) সেনগুপ্ত পরিবারের মেয়ে, আর রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক উপাধি ঠাকুর।

ঘটনাটি হঠাৎ মনে পড়ার কারণ, কয়েক দিন আগে ইন্টারনেটে প্রচারিত জনৈক আলেমের কথা কানে ভেসে এলো; তিনি বেশ রসিয়ে রসিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাঁর ব্যঙ্গ করার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের “ও মা, তোমার কোলে ঠেকাই মাথা” কথাটিকে ব্যঙ্গ করে বলছিলেন : “ও কালী মা, তোমার কোলে ঠেকাই মাথা”।

প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁর এ ব্যঙ্গ কি যথার্থ? বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে এবং দেশকে ‘মা’ বলা জায়েয কিনা সে প্রশ্নও অনেকে তুলে থাকেন; আমি এখানে সে বিষয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী নই। প্রশ্ন হচ্ছে, উক্ত আলেম যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ব্যঙ্গ করলেন, এটা কি যথার্থ? রবীন্দ্রনাথ কি কালীর পূজা করতেন?

সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কিন্তু তা কী অর্থে?

গীতা, বেদ, পুরাণ ইত্যাদি হিন্দু ধর্মের প্রাচীন গ্রন্থাবলীতে “হিন্দু” শব্দটি আছে বলে আমার জানা নেই। “হেন্দ্”, “হিন্দী” ও “হিন্দু” ফার্সী শব্দ। সুপ্রাচীন কাল থেকে পাহ্লাভী ভাষায় (ফার্সী-র পূর্বনাম) ভারত উপমহাদেশকে “হেন্দ্” বলা হতো; এ কারণে “ভারতীয়” অর্থে “হিন্দী” ও “ভারতবাসী” অর্থে “হিন্দু” বলা হতো। (শব্দগুলো যে ফার্সী তা যে কোনো অভিধানে দেখা যেতে পারে। ) এমনকি বেদ-পুরাণের অনুসারী ভারতীয় আর্যদের মধ্যে পরে বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব হলেও ফার্সীভাষীদের কাছে সমস্ত ভারতীয়ের পরিচয় “হিন্দু”ই থেকে যায়। শুধু তা-ই নয়, ভারত উপমহাদেশে ইসলামের প্রবেশের পরেও এ ব্যবহার কম-বেশী অব্যাহত থাকে, যদিও পাশাপাশি ‘ভারতের পৌত্তলিক ধর্মাবলম্বী’ অর্থেও এর ব্যবহার প্রচলিত হয়।

বাস্তব ব্যাপার হলো এই যে, ফার্সীভাষীরা “হিন্দু” শব্দটি তৈরী ও ব্যবহার করে এবং পরে তা ভারত উপমহাদেশে প্রচলিত হয়। সাধারণভাবে ভারতে ও বাংলাভাষীদের মধ্যে “হিন্দু” বলতে আর্য বংশোদ্ভূত যে ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে বুঝায় তার সিংহভাগই দেব-দেবীতে বিশ্বাসী ও মূর্তিপূজারী হলেও তাদের ধর্মগ্রন্থে এ নামটি নেই এবং তাদের সকলে দেব-দেবীতে বিশ্বাসী ও মূর্তিপূজারী নয়। সামাজিকভাবে তারা সকলেই ‘হিন্দু” পরিচয় গ্রহণ করে নিলেও তাদের মধ্যে মূলতঃ তিন ধর্মাবলম্বী লোক শামিল : শাক্ত, বৈষ্ণব ও ব্রাহ্ম। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ শাক্ত সম্প্রদায় দেব-দেবীর, বিশেষতঃ শক্তির তথা কালীর পূজারী। বৈষ্ণবরা বিষ্ণুর উপাসনাকারী; এরা শ্রীচৈতন্যের অনুসারী - যারা তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী শ্রীকৃষ্ণ রূপ ভগবান বিষ্ণুর প্রেমে মশগুল এবং সংসারত্যাগী বৈষ্ণব সন্ন্যাসীরা এ সম্প্রদায়েরই লোক। আর ব্রাহ্ম মানে পরমেশ্বর ‘ব্রহ্ম’র উপাসনাকারী। ‘ব্রাহ্মধর্ম’-এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে : “রামমোহন রায়ের ভাবধারানুসারী একেশ্বরবাদী ধর্মবিশেষ। ” (সংসদ বাংলা অভিধান)  [লক্ষণীয়, হিন্দু ধর্মাবলম্বী কর্তৃক সংকলিত ও সম্পাদিত এ অভিধানে সুস্পষ্ট ভাষায় ‘ধর্মবিশেষ’ উল্লেখ করা হয়েছে। ] এ ধর্মের ভিত্তি হচ্ছে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থের (কোন্ গ্রন্থের স্মরণ নেই) একটি বিখ্যাত উক্তি : “একহি ব্রহ্ম দ্বিতীয় নাস্তি। ” (একই ব্রহ্ম, দ্বিতীয় কেউ নেই। )

অবশ্য সামাজিকভাবে ব্রাহ্ম ও বৈষ্ণবরা বৃহত্তর হিন্দু সমাজের সাথে মিলেমিশে থাকে, কিন্তু তা সত্ত্বেও এটাই সত্য যে, ব্রাহ্মরা তাওহীদবাদী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এই ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী; এটা এমন এক তথ্য যে ব্যাপারে বিতর্ক নেই। সুতরাং তাঁকে কালী বা অন্য কোনো দেব-দেবীর উপাসক মনে করে নেয়া অন্যায় হবে।

কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে আহলে নাজাত্ হওয়ার ন্যূনতম শর্ত হচ্ছে ইন্দ্রিয়াতীত সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে ও মরণোত্তর জীবনে ঈমান পোষণ এবং তার আলোকে যথাযথ কর্ম (আমলে ছালেহ্) আঞ্জাম দেয়া (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ২-৩ ও ৬২)। বলা বাহুল্য যে, এ ধরনের যে কোনো তাওহীদবাদী ব্যক্তি তার নিজস্ব পদ্ধতিতে ইন্দ্রিয়াতীত সৃষ্টিকর্তার (আল্লাহ্ তা‘আলার) উপাসনা করে থাকে। অবশ্য এ ধরনের ব্যক্তির কাছে যদি রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) নবুওয়াতের বা অন্য কোনো নবী-রাসূলের (‘আঃ) নবুওয়তের তথ্য ইতমামে হুজ্জাত্ পর্যায়ে পৌঁছে তাহলে অবশ্যই সে তা গ্রহণ করবে, নচেৎ তা হবে ইখলাছের বরখেলাফ ও নিফাক্বের পর্যায়ভুক্ত। অন্যথায় নবুওয়াতে ঈমান না থাকার কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে পাকড়াও করবেন না।

আমাদের জন্মসূত্রে মুসলমানদের কিছু ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সকলেরই নবুওয়াত্ ও কোরআন মজীদে ঈমান যেখানে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত অন্ধ বিশ্বাস ভিত্তিক, বিশেষতঃ কোরআন মজীদে কী আছে তা না জেনেই তাতে ঈমানের দাবী করা হয়, এমতাবস্থায় আমরা বলতে পারি না যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে বা ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী অন্য কোনো লোকের কাছে কেউ রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) নবুওয়াতের ও কোরআন মজীদের ঐশিতার পরিচয় এমনভাবে পৌঁছিয়েছিলেন কিনা যাতে তাঁর জন্য ইতমামে হুজ্জাত্ হয়। নচেৎ এ ধরনের লোক আমলে ছালেহর অধিকারী হলে নাজাত্ লাভ করবে। [বলা বাহুল্য যে, কোনো না কোনো ধরনের মরণোত্তর জীবনের ওপর ইয়াক্বীন্ না থাকলে কেবল ইন্দ্রিয়াতীত সত্তার অস্তিত্বে ঈমান কাউকে তাঁর উপাসনায় ও আমলে ছালেহ্ সম্পাদনে অনুপ্রাণিত করতে পারে না। ]

অবশ্য ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে আপত্তির অনেক বিষয় থাকতে পারে। যেমন : তিনি মুসলিম বিদ্বেষী ছিলেন, তাই শিবাজীর প্রশংসা করে কবিতা লিখেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন এবং জমিদার হিসেবে মুসলিম প্রজাদের শোষণ করেছিলেন ইত্যাদি। এগুলোকে তাঁর অবস্থান থেকে দেখলে অন্য রকম মনে হবে। বহিরাগত মোগলদের শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় শিবাজী যা করেছিলেন তিনি তাকে সঠিক মনে করবেন এটাই কি স্বাভাবিক ছিলো না? বাংলাদেশের জনগণ তো অভিন্ন ধর্মাবলম্বী পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলো, তাহলে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বহিরাগত মোগলদের বিরুদ্ধে শিবাজীর যুদ্ধকে অন্যায় বলা যাবে কীভাবে? তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে যে ধরনের সঙ্কীর্ণ মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তার চেয়েও বেশী সঙ্কীর্ণ মানসিকতার পরিচয় অনেক সময় মুসলমানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে দিয়ে থাকে। আর জমিদারদের শোষণ? জমিদার তো জমিদারই; সে ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান কী? সংখ্যায় কম হলেও মুসলমান জমিদাররাও শোষণ ও অন্যায়ের ক্ষেত্রে হিন্দু জমিদারদের থেকে পিছিয়ে ছিলো না। আমার নিজের এলাকার এক প্রভাবশালী মুসলমান জমিদার পরিবার সম্পর্কে মশহূর্ ছিলো এই যে, এমনকি জমিদারী প্রথা বাত্বিল হওয়ার পরেও তাদের বাড়ীর সামনে দিয়ে কোনো সাবেক প্রজা পরিবারের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী ব্যক্তিও জুতা পায়ে অতিক্রম করতে পারতেন না; লাঞ্ছিত হতে হতো।

আমরা যারা জন্মসূত্রে মুসলমান কিছু ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সকলেই ভালো-মন্দ মিশ্রিত আমলের অধিকারী। আমাদের ব্যাপারে যা হবে ব্রাহ্ম সহ তাওহীদ ও পরকালীন জীবনে ঈমান পোষণকারী অন্যান্য জনগোষ্ঠীর লোকদের ক্ষেত্রেও মিশ্রিত আমলের বেলায় তা-ই হবে।

সুবহানাল্লাহ্ - আল্লাহ্ পরম প্রমুক্ত; তিনি সব রকম সঙ্কীর্ণতার উর্ধে; তাঁর নিকট কোনোরূপ পক্ষপাতিত্ব নেই।

অতএব, صِبْغَةَ اللَّهِ - “আল্লাহর রং (গুণাবলী) (ধারণ কর)। ” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ১৩৮)

আসুন, আমরা সঙ্কীর্ণতার উর্ধে উঠে সর্বাবস্থায় আল্লাহর খাতিরে সত্য-ন্যায়ের সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়াই।

রবীন্দ্রনাথের মতো জ্ঞানী পণ্ডিত ব্যক্তির কাছে কি ইসলাম সংক্রান্ত ইতমাম - ই হুজ্জত হয় নি । তাহলে তার জ্ঞান , মেধা ও পাণ্ডিত্য তাকে সত্য অনুসন্ধানে ও কোন্ ধর্ম সত্য সঠিক উত্তম ও শ্রেষ্ঠ তা গবেষণা করে বের করতে উদ্বুদ্ধ করল না কেন ? তাহলে তার জ্ঞান মেধা ও পাণ্ডিত্য তার কী উপকারে আসল ? রবীন্দ্রনাথ সকল ধর্ম মতের নাম শুনেছেন ও পরিচিত ছিলেন । আর যে ভারতবর্ষ মুসলমানরা শতশত বছর শাসন করেছে তারা তো তার প্রতিবেশী ও দেশের ই অধিবাসী । সুতরাং তাদের ধর্ম গ্রন্থ , আকীদা বিশ্বাস ও ধর্মীয় বিধিবিধানের বই পত্র রবীন্দ্রনাথের মতো সাংস্কৃতিক সাহিত্যিক পণ্ডিত বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিত্বের কাছে অজানা ও অজ্ঞাত হতে পারে না । আর রবীন্দ্রনাথ ও ঠাকুর পরিবার ফার্সী ভাষাও সাহিত্যের সাথে পরিচিত ছিলেন । তাই রবীন্দ্রনাথের কাছে মুবাল্লিগদের গিয়ে ইসলাম প্রচার ও উপস্থাপনের প্রয়োজন নেই । আর তাঁর সময় কোলকাতা ও হিন্দুস্তানের সর্বত্র  ইসলামের সকল মাযহাবের বই পুস্তক পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান ছিল । আর রবীন্দ্রনাথের সাথে বেশ কিছু মুসলমানের পরিচিতি ও উঠাবসা ও ছিল । তাই তাঁর যদি সদিচ্ছা থাকত তাহলে তিনি অনায়াসে কমপেরাটিভ রিলিজিয়াস স্ট্যাডি করে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতেন । কিন্তু তা তার সম্পর্কে জানা যায় না । আর তিনি এ ধরণের স্ট্যাডির প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেন নি । আর রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেই যদি ইতমাম -ই হুজ্জাত না হয় তাহলে সাধারণ হিন্দু জনগণ যাদের বিরাট অংশ আসলেই অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত , মুস্তাদাফ ও ইস্তিদ্আফ -ই ফিকরীর ( চিন্তাগত দীনতা ও দুর্বলতা ) শিকার তাদের অবস্থা কী হবে ? আসলে সাধারণ কমন হিন্দু বা বিধর্মী জনতাই অনুসন্ধান ও যাচাই-বাছাই করে নিজ ধর্ম গ্রহণ করার বুদ্ধিবৃত্তিক দায়িত্ব ও কর্তব্য ( তাকলীফ ) প্রাপ্ত তাহলে রবি ঠাকুরের মতো পণ্ডিত , জ্ঞানী গুণী ও সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা তো বেতারিকে আওলা ( অধিক অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ) সত্য ধর্ম অনুসন্ধানের দায়িত্ব প্রাপ্ত ( মুকাল্লাফ ) হবেন নিশ্চিতভাবেই । তাই তারা তাদের এ দায়িত্ব এড়াতে পারেন না বিশেষ তথ্য প্রবাহ ও যোগাযোগের যুগে ( আসরে ইরতিবাতাত ) ।আর রবি ঠাকুরের যুগটা সেই তথ্য প্রবাহ ও যোগাযোগের যুগের সূচনা ছিল । সুতরাং  রবীন্দ্রনাথ ও তাদের মতো ব্যক্তিরা জেনেশুনে সজ্ঞানে ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষ থেকে মুক্ত ছিলেন না । খুনী ডাকাত শিবাজীর উদ্দেশ্যে তার প্রশস্তিমূলক কবিতা তার মুসলিম বিদ্বেষের প্রমাণ । আর খুনী শিবাজির বর্গী বাহিনী কেবল পশ্চিম বাংলায় ৫০০০০০ লোক হত্যা করেছিলো যাদের অধিকাংশই ছিল তার স্বজাতি হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত । অথচ মুসলিম বিদ্বেষ রবি ঠাকুরকে অন্ধ করেছিল বিধায় শিবাজির মতো খুনী তস্করের প্রশংসায় মেতেছিলেন । আর এই একই কারণে রবি ঠাকুর ইংরেজদেরও প্রশংসায় মজেছিলেন ।

কোনো কওমের দুশমনী যেন ন্যায়বিচার করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে না দাঁড়ায় । শত্রুতা থাকার কারণে আমরা যেন সীমালংঘন না করি তার ন্যায্য বৈধ অধিকার হরণ না করি যতটুকু সে শাস্তি ও তিরস্কার পাওয়ার যোগ্য ততটুকু শাস্তি দেয়া না তার বেশি । শত্রুতা যেন আমাদেরকে অন্ধ না করে ফেলে ন্যায় ও ইনসাফ থেকে আমাদেরকে বিচ্যুত না করে । সবসময় গঠনমূলক ন্যায্য সমালোচনা কাম্য । রবি ঠাকুরের ভুল ত্রুটিও অন্যায় গুলো যেমন : তার জমিদারীর মুসলমান প্রজাদের সাথে তার রূঢ় আচরণ ইত্যাদি তো বলতে হবে । মুসলিম স্বার্থবিরোধী বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনে তার ভূমিকা ও অবস্থান  যেমন বলা ও সমালোচনা করা উচিত ঠিক তেমনি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তার ব্রিটিশ রাজ কর্তৃক প্রদত্ত শাহী উপাধি বর্জনেরও প্রশংসা করা উচিত । অর্থাৎ শত্রুর সাথে ন্যায্য ভারসাম্যপূর্ণ আচার আচরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এ আয়াতে অর্থাৎ সর্বাবস্থায় ন্যায়বিচার ও ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন । অপরাধীকে অপরাধের অধিক শাস্তি আসলেই জুলুম ( অন্যায় ) । শাস্তি অবশ্যই শরিয়ত মোতাবেক হতে হবে । এর বাইরে নয় । আর এ ধরণের বিষয় ইসলামী আদালত ও কাযীর সাথে একান্ত জড়িত ও সংশ্লিষ্ট । তবে আমাদের সবার নযর রাখতে হবে যে শত্রুর প্রতি আমাদের আচরণ ইনসাফ ও ন্যায় পরায়ণতার সীমা ও চৌহদ্দি অতিক্রম না করে । আমাদের আলোচনা সমালোচনা যেন ন্যায়পরায়ণতা ও ইনসাফ দ্বারা যেন অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত হয় সর্বাবস্থায় ।

 ইসলাম গ্রহণের সুযোগ থাকার পর ইসলাম গ্রহণ না করলে মুওয়াহহিদ থাকায়ও ফায়দা হবে না । অতএব এ বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ ।

রবি ঠাকুরের অবস্থা দুনিয়া জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন অজ পাড়া গাঁয়ের হিন্দু বামুন পুরোহিতের মতো নয় যে ইসলাম ও মহানবীর দাওয়াত তার কাছে পৌঁছায় নি । আর ভারতবর্ষে ৭/৮ শতাব্দী ধরে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকার পর হিন্দুস্তানের হিন্দু তথা অমুসলিমদের কাছে ইসলামের পরিচিতি পৌঁছায় নি বললে ভুলই হবে । তবে তা শান্তিপূর্ণ ভাবে পৌঁছেছে কিনা তা বিচারের বিষয় । তবে ভারতবর্ষে সূফী দরবেশদের মাধ্যমে ইসলাম প্রচারিত

হওয়া এবং ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলোর চাইতে বাংলার জনগণ যাদের অধিকাংশই ছিল নিম্নবর্ণ হিন্দু বা বৌদ্ধ্য তাদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ প্রমাণ করে যে ভারতে ইসলামের প্রসারে মুসলমানদের রাজ শক্তি বা তরবারি প্রধানত ব্যবহৃত হয় নি । সুতরাং শান্তিপূর্ণ ভাবেই ইসলামের দাওয়াত ভারতবাসীদের কাছে উপস্থাপিত হয়েছিল । তবে গুটিকতক বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করণের কাহিনী আন অ্যাভয়ডেবল । মধ্যযুগে হিন্দুত্ববাদের উত্থানের সময় ভারতে হিন্দুরা বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদেরকে বলপূর্বক হিন্দু করেছিল ।

হিন্দুস্তানে ৭-৮ শতাব্দী ব্যাপী মুসলিম শাসনের পর ভারতবর্ষে মুসলমানদের সংখ্যা লঘু হওয়া প্রমাণ করে যে সমগ্র ভারত বর্ষে ইসলাম মুসলিম রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় ও তরবারির জোরে প্রচারিত হয় নি । অথচ উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় বহিরাগত দখলদার ইউরোপীয়রা শুধু অস্ত্রের জোরে খ্রীষ্টান ধর্ম প্রচার করেই ক্ষান্ত হয় নি বরং সে মহাদেশগুলোর আদিবাসীদেরকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে মেরে কেটে হত্যা করে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে । কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারের সময় অর্থাৎ ৫০০ বছর আগে যে রেড ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা ছিল ৮০-১০০ মিলিয়ন আজ তাদের সংখ্যা মাত্র কয়েক মিলিয়ন মাত্র । এই ৮০ - ১০০ মিলিয়ন ৫০০ বছর পরে কমপক্ষে ৮০০- ১০০০ মিলিয়ন

হওয়া উচিত ছিল কিন্তু তাদের সংখ্যা ৫০০ বছর আগের সংখ্যা থাকা তো দূরের কথা বর্তমানে তাদের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েক মিলিয়ন মাত্র । তাহলে বোঝাই যাচ্ছে যে কি ব্যাপক গণহত্যা ও প্রজন্ম হত্যা চালিয়েছে এ সব খুনী ডাকাত জবর দখলকারী ইউরোপীয় অভিবাসীরা উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা , অস্ট্রেলিয়ায় !! আর এরাই লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলে ও দাবি করে যে ইসলাম নাকি তরবারির জোরে প্রচারিত হয়েছে । আসলে কোন্ ধর্ম তরবারির জোরে প্রচারিত হয়েছে তা ইতিহাস পাঠ করলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে । গত  তিন চার শতাব্দী ধরে ইউরোপীয়রা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ও অঞ্চলে অস্ত্রের জোরে সাম্রাজ্য ও আধিপত্য স্থাপন করে প্রথমে খ্রীষ্টন ধর্ম প্রচার করেছে এবং এরপর গত দুশো বছর ধরে সেক্যুলারিজম , গণতন্ত্র , ধনতন্ত্র , নাস্তিক্যবাদ , বস্তুবাদ , ভোগবাদ , বেলেল্লাপনা , লিবারেলিজম , কমিউনিজম , সমাজতন্ত্র ইত্যাদি হাবিজাবি রাবিশ মতবাদ জোর করে অধীনস্থ জাতি সমূহের উপর চাপিয়ে দিয়েছে এবং বিশ্ব জুড়ে কোটি কোটি মানুষ কে হত্যা করেছে এবং সে গণহত্যা আজও অব্যাহত আছে যার প্রমাণ গত ২১ বছরে আফগানিস্তান , ইরাক , সিরিয়া ও লিবিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সরাসরি আক্রমণ বা পরোক্ষভাবে গোলোযোগ পাকিয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন হতভাগ্য মানুষ হত্যা ।

ইসলামী চিন্তাবিদ এবং গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম ওলায় মুসলেমিন মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান

 

captcha