IQNA

সুদিনের স্বপ্ন দেখে নেপালের মুসলিমরা

10:13 - August 25, 2022
সংবাদ: 3472350
তেহরান (ইকনা): কাঠমাণ্ডুর সাবেক রাজপ্রাসাদ ও বর্তমান জাদুঘরের সামান্য দূরেই অবস্থিত জামে মসজিদ। মসজিদের প্রাঙ্গণে শুয়ে আছেন বেগম হজরত মহল। তাঁর সমাধি একই সঙ্গে নিঃস্বতা ও অতীত মহিমার প্রতিচ্ছবি। বেগম হজরত মহল ছিলেন ভারতের অযোধ্যার রানি এবং তিনি ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক।
বিপ্লব ব্যর্থ হলে তিনি লখনউ থেকে নেপালে আশ্রয় নেন। নেপালের তৎকালীন শাসক রাজা জং বাহাদুর রানা তাকে আশ্রয় দেন। ব্রিটিশ সরকারের পোষ্য হিসেবে পরিচিত নেপালের রাজপরিবারের এই সিদ্ধান্ত ছিল অভাবনীয়।
বেগম মহলের বহু অনুসারী মুসলিম তখন নেপালে পাড়ি জমান। তবে তার বহু আগ থেকেই নেপালে মুসলমানের অস্তিত্ব ছিল। ধারণা করা হয়, তিব্বতগামী কাশ্মীরি মুসলিম ব্যবসায়ীরা ১৫ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম নেপালে ইসলামের দাওয়াত দেন। রাজা রত্ন মাল্লার যুগে তাদের অনেকেই কান্তিপুর (কাঠমাণ্ডুর পূর্বনাম), বাখতাপুর ও লালিতপুরে স্থায়ী হন। রাজপ্রাসাদ থেকে কয়েক শ গজ দূরে অবস্থিত কাশ্মীরি তাকিয়া মসজিদ পাঁচ শ বছরের অতীত সেই ইতিহাসেরই যেন সাক্ষী।
 
শত শত বছর ধরে নেপালি মুসলিমরা নীরব সংখ্যালঘু হিসেবে বসবাস করে আসছে। কিন্তু ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মাওবাদীদের তৎপরতা মুসলিমদের সরব করে তোলে। মুসলিমরা তাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের পক্ষে কথা বলতে শুরু করে। ২০০৮ সালে নেপালে রাজতন্ত্র বিলোপ এবং মাওবাদিদের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুসলমানের ধর্মীয় দিবসগুলোতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। এখন নেপালের মুসলিমরা প্রকাশ্যে ধর্মীয় উৎসব পালন করছে। যেমন কাঠমাণ্ডু থেকে পাঁচ শ কিলোমিটার দূরে ভারতের সীমান্তবর্তী বাঁকে জেলায় মুসলিমরা মহানবী (সা.)-এর জন্মদিনে (১২ রবিউল আউয়াল) কোরআনের আয়াত লেখা পতাকা উত্তোলন করে। এমন প্রকাশ্য তৎপরতা সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকারের স্বীকৃতি। নেপালের মধ্যাঞ্চলীয় বাঁকে জেলায় নেপালের ৯৫ শতাংশ মুসলমান বসবাস করে। কাঠমাণ্ডু উপত্যকায়ও বহুসংখ্যক মুসলিম বসবাস করে। তবে তারা অন্যান্য ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর তুলনায় দরিদ্র ও ভূমিহীন। তাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও চাকরির বাজারে উপস্থিতিও সামান্য।
 
নেপালের মুসলিমরা পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়গুলোর অন্যতম। বিশেষত শিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলিম নারীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। যেখানে নেপালের নারীদের গড় সাক্ষরতার হার ৫৫ শতাংশ, সেখানে মুসলিম নারীদের গড় সাক্ষরতার হার মাত্র ২৬ শতাংশ। মাত্র ১২ শতাংশ মুসলিম মেয়েরা উচ্চ মাধ্যমিক সমাপ্ত করে। স্থানীয় মুসলিমরা এ জন্য ইসলামী মূল্যবোধ ও সরকারি স্কুলের পরিচালনার নীতিকে কিছুটা দায়ি করে। যেমন—কোনো মুসলিম মেয়ে হিজাব বা বোরকা পরে স্কুলে গেলে তাদের দিকে এমনভাবে তাকানো হয়, যেন তারা ভিনগ্রহ থেকে এসেছে। তাদের দৃষ্টিতে এটা এক ধরনের মানসিক অত্যাচার। নেপালি মুসলিমরা প্রত্যাশা করে হয়তো সরকার তাদের বিশেষ শিক্ষাবৃত্তি ও সুবিধা দেবে অথবা মুসলিমদের স্বাধীনভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেবে।
 
আশার কথা হলো, গণতান্ত্রিক নেপালের সরকারগুলো মুসলিমদের সমস্যাগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং মাদরাসাগুলো মুসলিম শিশুদের শিক্ষাপ্রবেশিকায় উন্নীত করার অঙ্গীকার করেছে। ২০০৭ সালে নেপালে প্রথম মাদরাসা বোর্ড গঠিত হয়। শিক্ষাবোর্ড উর্দু ভাষায় পাঠদানের উদ্যোগ নেয়। কেননা নেপালি মুসলিমদের বৃহৎ একটি অংশ উর্দু ভাষায় কথা বলে। নেপালি সরকার তালিকাভুক্ত মাদরাসাগুলোকে আর্থিক সহযোগিতা করারও অঙ্গীকার করেছে। তবে শর্ত হলো : তাদের গণিত, বিজ্ঞান এবং ইংরেজি ও নেপালি ভাষা শেখাতে হবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় দুই হাজার মাদরাসা তালিকাভুক্ত হয়েছে। কিন্তু তারা যথাযথ সরকারি সহযোগিতা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে।
 
নেপালের তিন কোটি নাগরিকের মাত্র পাঁচ শতাংশ মুসলিম। তবু নেপালি মুসলিমরা ভবিষ্যতের ব্যাপারে প্রচণ্ড আশাবাদী। কেননা নেপালের রাষ্ট্র ও সংবিধান দিনদিন তাদের অধিকারগুলোর স্বীকৃতি দিচ্ছে। ২০১৫ সালে গৃহীত সংবিধান প্রথমবারের মতো মুসলিমদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সংখ্যালঘু হিসেবে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের কোটা অধিকার দিয়েছে। যদিও এখনো নেপালের সরকারি চাকরিতে মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব এক শতাংশের চেয়েও কম।
 
তথ্যসূত্র : আল-জাজিরা
captcha