
তাঁর পিতা বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ ছিলেন বালখের একজন ধর্মতাত্ত্বিক ও আইনজ্ঞ, যিনি একটি নিবিড় আধ্যাত্মিক দিনপঞ্জি ‘মাআরিফ’-এর রচয়িতা। তরুণ বয়সেই রুমি সপরিবারে বলখ থেকে দামেস্ক এবং সেখান থেকে নিশাপুরে যান। পরে তাঁর পরিবার কেনিয়ায় বসতি স্থাপন করে। সেখানে শামস তাবরিজির সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁর আধ্যাত্মিক যাত্রাকে শীর্ষে পৌঁছে দেয়।
জীবন ও জগতের রহস্য উন্মোচনকারী রুমির কাব্য মূলত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়—চতুষ্পদী শ্লোক ও গজল। সেই সঙ্গে গদ্যসমূহকে ভাগ করা হয় প্রবন্ধ, পত্র ও ‘ধরমাপদেশ’-এ। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে মসনবী, দেওয়ানে শামসে তাবরিজ, ফিহি মা ফিহি অন্যতম।
সভ্যতার প্রবহমান ধারায় বহুল আলোচিত শব্দ হলো প্রেম।
খোদা ও বান্দার মধ্যেও এই প্রেমেরই বিচরণ, যা কেবল আধ্যাত্মিক চেতনার মাধ্যমেই সংঘটিত হয়। বিশ্বময় বিরাজিত মহান স্রষ্টার সঙ্গে মিলিত হওয়ার পাথেয় প্রেমের বর্ণনাকালে মওলানা রুমি বলেন,
এ হলো ভালোবাসা যা স্বর্গপানে ধাবিত,
প্রতিক্ষণে শত শত আবরণ ছিন্নকারী।
প্রথম মুহূর্ত হলো, জীবনকে অস্বীকার করা;
শেষ কাজ হচ্ছে, পা ছাড়াই যাত্রা করা।
এ বিশ্বকে অদৃশ্য বলে জ্ঞান করা,
নিজের নিকট যা মনে হয়, তা না দেখা।
প্রেম অপার্থিব এবং স্বার্থের সীমার ঊর্ধ্বে।
প্রেম কোনো প্রতিবন্ধকতা মানে না। সম্মুখে যত বাধাই আসুক না কেন, একজন প্রেমিক তা থেকে স্বতন্ত্র হয়ে কল্যাণের দিকে ধাবিত হয়। সে এই জগতের সব মায়ার বন্ধনকে অস্বীকৃতি জানায়। কেবল খোদার প্রেমের সুধা পান করে মত্ত থাকতে চায় সে। এই খোদাপ্রেমই তাঁকে মুক্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। রুমির কবিতা যেন এটিকেই বর্ণনা করে। কবি বলেন—
আকণ্ঠ ভালোবাসা পান করো, কারণ
একমাত্র ভালোবাসারই অস্তিত্ব আছে;
ভালোবাসার ব্যবহার না হলে প্রেমাস্পদের কাছে যাওয়া যায় না।
ওরা বলে, ‘ভালোবাসা কী?’ বলে, ‘ইচ্ছাকে বর্জন করা।’
যে ইচ্ছা হতে পলায়ন করতে পারেনি, তার কোনো আশা নেই।
খোদার সান্নিধ্য প্রত্যাশী আত্মা প্রতিনিয়ত তার সাথে মিলনের অপেক্ষায় থাকে। ফলে স্রষ্টাকে পাওয়ার ব্যাকুলতা প্রতিটি মুহূর্তে তার হৃদয়পটে অনুরণিত হয়। মূলত যেখান থেকে আগমন, সেখানে পৌঁছাবার জন্যই সে তার হৃদয়ের কথা ব্যক্ত করে। কবির ভাষায়—
বাঁশরির কাছে শোনো, সে কিসের বর্ণনা দেয়
বিরহ-ব্যথার করুণ কাহিনির সে অনুযোগ করে।
যেদিন আমাকে বাঁশবন থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে
আমার আর্তনাদে নারী-পুরুষ সবাই কেঁদেছে।
বক্ষ চাই এমন, যা বিচ্ছেদের আর্তনাদে ক্ষত-বিক্ষত
প্রেমের কী বেদনা তা শোনাতে পারি।
রুমি ইসলামের মাধমেই ব্যক্তি-আত্মার বিকাশের কথা বলেছেন। তাই তাঁর দর্শন ইসলামের মূল থেকেই উদ্ভূত। তাঁর আধ্যাত্মিক বার্তাগুলো কোরআন ও সুন্নাহর আলোকচ্ছটায় পরিপূর্ণ। রুমি বলেন—
যখন তোমরা আল্লাহর কোরআনের কাছে যাবে,
তখন তোমরা নবীদের আত্মার সাথে মিশে যাবে।
কোরআন হচ্ছে বর্ণিত নবীদের অবস্থা,
যারা মহামান্যের পবিত্র সাগরের মাছ।
কলুষ তথা কুপ্রবৃত্তি হতে মুক্ত হয়ে আত্মিক উন্নতির জন্য কোরআন অনুসরণ সম্পর্কে রুমি উল্লেখ করেছেন—
সমগ্র কোরআন আত্মার নিষ্ঠুরতার বর্ণনা করে
পবিত্র কিতাবটি দেখো! তোমার চোখ কোথায়?
পার্থিব সুখ-সমৃদ্ধি যেমন দৈহিক ও মানসিক সক্রিয়তার ওপর নির্ভর করে, ঠিক তেমন আত্মার পবিত্রতার জন্য প্রয়োজন নফসের পরিশোধন। কেবল নফসকে পরিশুদ্ধ করতে সক্ষম হলেই মোহমুক্ত হয়ে কল্যাণের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। রুমি ইহজগতের সাময়িক তৃপ্তি ভোগ না করে ভাবের নগরে যাত্রার আহ্বান জানিয়ে বলেন—
হে হৃদয়, যে বিশ্ব অপসৃয়মাণ সেখানে তুমি কেন এক বন্দি?
এ অবরোধ থেকে পলায়ন করো, কারণ
তুমি আধ্যাত্মিক জগতের এক পাখি।
মওলানা রুমির রচনা মূলত ইসলামের প্রেমময় ও রহস্যময় দিকগুলোই উপস্থাপন করে। তাঁর কাব্যিক অভিব্যক্তি সময়, ভাষা এবং সংস্কৃতিকে অতিক্রম করে পাঠকদের অন্তরকে স্পর্শ করে। তাঁর বার্তা সবাইকে মনে করিয়ে দেয় যে—ইসলাম নিছক আচার-অনুষ্ঠানের সমষ্টি নয়, বরং এটি শান্তি, আত্ম-উপলব্ধি এবং খোদা ও বান্দার বিশেষ সম্পর্কের দিকে যাত্রা।