সংযুক্ত আরব আমিরাত দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশী দেশগুলোর ধনী মানুষকে আকর্ষণ করে এসেছে। ধনীদের পুনর্বাসনে সহায়তাকারী সংস্থাগুলো বলছে, এখন ক্রমশ বেশিসংখ্যক পশ্চিমারা এ দলে যোগ দিচ্ছেন।
হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স নামের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালে ৯ হাজার ৮০০ ধনকুবের সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলে যাবেন—যা বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি।
কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত এই দেশটি ধনীদের জন্য এক আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, অতি-নিম্ন অপরাধ হার, সহজ ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ ও বিলাসী জীবনের অফুরন্ত সুযোগ—সব মিলিয়ে দুবাই এখন ধনীদের স্বর্গ।
এ ছাড়া ধনীদের আকৃষ্ট করতে দেশটি চালু করেছে ‘গোল্ডেন ভিসা’ প্রকল্প, যার মাধ্যমে ধনী বা দক্ষ বিদেশিরা ১০ বছরের আবাসিক অনুমতি পান।
ধনকুবেরদের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্কাইবাউন্ড ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের প্রধান মাইক কোডি জানান, তার অনেক ক্লায়েন্ট মনে করেন, নিজ দেশে তাদের সাফল্য এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, ‘তাদের ওপর কর বাড়ছে, নজরদারি বাড়ছে, আর সুযোগ-সুবিধা কমছে। কিন্তু দুবাইয়ে সম্পদ লুকিয়ে রাখতে হয় না, বরং সেটা স্বাভাবিক। লন্ডনে আমার ক্লায়েন্টরা সম্পদ নিয়ে ফিসফিস করে কথা বলেন।
দুবাইয়ে তারা মুক্তভাবে থাকতে পারেন।’
চকচকে বিলাসী জীবনের প্রতীক হিসেবে দুবাই সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদেরও প্রিয় স্থান। এখানে রয়েছে বিশাল মল, যার ভেতরেই স্কি করার জায়গা, বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন, আর বিখ্যাত পাম দ্বীপ, যা পাঁচতারা হোটেলে ভরা।
ধনীদের জন্য বিশ্বমানের বিলাসকেন্দ্র হিসেবে দুবাইয়ের দ্রুত উত্থান সমালোচনার মুখে পড়েছে। কারণ অতি স্বল্পমজুরির অভিবাসী শ্রমিকদের শ্রমই এ অর্থনীতির মূল ভরসা।
খুব কম আমলাতান্ত্রিক জটিলতা
কোডির মতে, দুবাইমুখী নতুন ধনীদের বড় অংশই ৩০-৪০ বছরের পেশাজীবী—যাদের মধ্যে আছেন টেক কোম্পানি প্রতিষ্ঠাতা, ব্যবসায়ী পরিবারের উত্তরসূরি, কনসালট্যান্ট ও ফান্ড ম্যানেজাররা।
এর মধ্যে একজন ৪২ বছর বয়সী ব্রিটিশ ক্লাউড সফটওয়্যার কম্পানি মালিক, যিনি পুঁজিগত লাভের ওপর করের ভয়ে ইউএইতে চলে গেছেন। কঠোর কর নীতি ও উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদের ওপর আসন্ন করের পরিবর্তনের আশঙ্কা—সব মিলিয়ে ব্রিটেন এ বছর রেকর্ড ১৬ হাজার ৫০০ ধনকুবের হারাতে পারে বলে হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স জানিয়েছে।
এ বছরের সবচেয়ে আলোচিত ধনী প্রবাসী, নরওয়েজিয়ান ধনকুবের জন ফ্রেডরিকসেন সরাসরি বলেছেন, ‘ব্রিটেন শেষ হয়ে গেছে, তাই আমি ইউএইতে যাচ্ছি।’
প্যাডকো রিয়েল এস্টেটের প্রধান ম্যাক্স ম্যাক্সওয়েল এক পডকাস্টে বলেন, ‘আমরা সবাই এক ধরনের লাইফস্টাইলের খোঁজে আছি—যার সংজ্ঞা সবার কাছে আলাদা।” তাঁর ভাষায়, যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে ইউএইতে আসার পর একই অর্থে তার পরিবার আরও ভালো জীবনমান পাচ্ছে।’
হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের দুবাই শাখার ফিলিপ আমারান্তে বলেন, ধনীরা চান কম ঝামেলায় ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া ও সম্পদ বজায় রাখতে। ইউএই সেই বার্তাই দিচ্ছে, ‘আমরা ব্যবসার জন্য উন্মুক্ত।’
‘চাইলেই কেনা যায় পুরো ভবন’
তবে এত বিপুল ধনীর আগমন নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। ২০২২ সালে আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতার ঘাটতির কারণে ও ইউক্রেন যুদ্ধের পর ধনী রাশিয়ানদের ঢল নামায় সংযুক্ত আরব আমিরাতকে বৈশ্বিক ধূসর তালিকায় রাখা হয়। পরে মানি লন্ডারিংবিরোধী পদক্ষেপ ও কিছু অপরাধীকে প্রত্যর্পণ করে দেশটি সেই তালিকা থেকে বেরিয়ে আসে।
এখন বিশ্বের নানা প্রান্তের ধনী পরিবার, ব্যবসা ও ব্যক্তিগত অফিস নিয়ে দুবাই আসছেন—যা নতুন প্রবণতা বলে জানিয়েছেন রিয়েল এস্টেট গবেষক ফয়সাল দুররানি।
হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের হিসাব অনুযায়ী, দুবাই এখন বিশ্বের শীর্ষ ২০ শহরের একটি যেখানে ধনকুবেরদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এখানে আছেন ৮১ হাজার ২০০ মিলিয়নিয়ার ও ২০ বিলিয়নিয়ার।
দুররানি জানান, নিউ ইয়র্ক ও লন্ডন মিলিয়ে যত ১০ মিলিয়ন ডলারের বেশি দামের বাড়ি বিক্রি হয়, গত বছর একাই দুবাইয়ে তার চেয়েও বেশি—৪৩৫টি বিক্রি হয়েছে। আপেক্ষিকভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিলাসবহুল সম্পত্তি পশ্চিমাদের তুলনায় সস্তা।
তিনি বলেন, ‘মোনাকো বা সুইজারল্যান্ড থেকে আসা ক্রেতারা প্রায়ই ১০০ মিলিয়ন ডলারের অ্যাপার্টমেন্ট চান। কিন্তু দুবাইয়ে সেই দামে চাইলে পুরো একটি ভবন কিনে ফেলা যায়।’