IQNA

মুসলিম নারীদের হিজাব সম্পর্কে পশ্চিমাদের ভীতি ও ভুল ধারণা কোথায়?

23:39 - September 03, 2018
সংবাদ: 2606620
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: গত মাসের শুরুর দিকে ডেনমার্কে বোরকার উপর নিষেধাজ্ঞাকে অনেক মুসলিম নারীই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। এর কিছুদিন পর সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন মুসলিম নারীদের বোরকা পরিধান করাকে ‘ডাক বাক্স’ এবং ‘ব্যাংক ডাকাত’ ইত্যাদির সাথে তুলনা করেন। এসব ঘটনা পশ্চিমা মুসলিম নারীদের মুখমন্ডল ঢেকে রাখে এমন পর্দা পরিধান করার সঙ্গতি সম্পর্কে দেশগুলোতে বিতর্ক উস্কে দেয়।



বার্তা সংস্থা ইকনা: এই সময়েই, মিশরের অভিনেত্রী হালা শিহা তার হিজাব খুলে ফেলে ১২ বছরের বিরতির পর আবার অভিনয়ে ফিরে গিয়ে আরেকটি বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। দেশটির বামপন্থিরা তার এমন আচরণের জন্য তাকে বাহবা দিচ্ছেন, অন্যদিকে ডানপন্থিরা তার এমন আচরণের কারণে পশ্চিমা বিশ্বে ইসলাম ভীতি আরো ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন।

এর ফলশ্রুতিতে মুসলিমদের মধ্যে বোরকা নিয়ে বিতর্ক চলমান রয়েছে এবং বাস্তবিকভাবেই মুসলিমরা হিজাব নিয়ে বিতর্কের কারণে বিভেদের সম্মুখীন হচ্ছেন।

পশ্চিমা বিশ্বে হিজাবকে দেখা হয় ইসলামিক সংস্কৃতির একটি ঐতিহ্য হিসাবে। কিন্তু মিশর এবং অন্যান্য দেশে ব্যাপক হারে হিজাব পরিধান একটি নতুন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই জটিল ধাঁধার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে সম্প্রতি বেলজিয়ামে মুসলিম নারীদের পুরো মুখমন্ডল ঢেকে রাখে এমন পোশাকের ব্যবহার নিয়ে একটি বিতর্ক, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের নারীদের হিজাব পরিধান একটি কম বিতর্কের বিষয়- তবে দুই পক্ষই এটা মেনে নেন যে হিজাব একটি শরিয়া আইন।

মিশরের নারীদের হিজাব পরিধানের দিকে ঝুঁকে পড়ার একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ কারণ রয়েছে, এবং এতে পশ্চিমা নারীরা কিছুটা হলেও উজ্জীবিত হবেন। মিশরের নারীরা হিজাব পরিধান করে সামাজিক-রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। দেশটির উচ্চ শ্রেণীর শিক্ষা নেয়ার প্রবণতার ফলে, সামাজিক চাপের ফলে এমনকি নারীদেরকে তাদের স্বামীদের আকৃষ্ট করার জন্যও তারা হিজাব পরিধান করেন। তবে এটা সত্য যে, মিশরের জনগণ পূর্বের তুলনায় বর্তমানে ধর্মের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে।

মিশরের সাবেক এক রাষ্ট্রনায়ক গামাল আবদুল নাসের তার শাসন ব্যবস্থাকে খুব দক্ষতার সাথেই রক্ষা করে চলেছিলেন। তবে মুসলিম ব্রাদারহুড তাকে ব্যর্থ হত্যা চেষ্টার পরে তিনি তাদের উপর কঠোর হন এবং এতে দলটি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে বাধ্য হয়।

পরবর্তীতে ১৯৫০ সালে তার এক বিখ্যাত ভাষণে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের দেশটিতে হিজাব বাধ্যতামূলক করার দাবীকে উপহাস করে বলেন, দলটির প্রধানের মেয়ে নিজেও হিজাব পরিধান করেন না। ‘কেন আপনারা তাকে ধরে হিজাব পরিয়ে দিচ্ছেন না? যদি আপনারা আপনার কন্যাকেই হিজাব পরিধান না করাতে পারেন তবে কিভাবে আমাকে বলছেন, ১০ মিলিয়ন নারীকে হিজাব পরাতে পারবো?’

কিন্তু মিশরের এই দৃশ্য দ্রুতই পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল কর্তৃক আরব সৈন্য বাহিনীকে পরাজিত করার পর পরেই দেশটির এবং বিভিন্ন আরব দেশের জনগণ বিকল্প হিসাবে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করেন এবং এর ফলশ্রুতিতে ইরানে বিপ্লব হয়।

তখন মিশরের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে অনেক মিশরীয়ই পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলোতে অভিবাসী হিসাবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং তারা সাথে করে সেসব দেশে বিশেষ করে সৌদি আরবে ধর্মীয় ‘মৌলবাদ’ নিয়ে যায় তার একটি হল সালাফিজম এবং সাথে করে নিয়ে যায় পুরো মুখমন্ডল ঢেকে রাখে এমন পোশাক।

কিন্তু শুধুমাত্র ধার্মিক হওয়ার ফলে নারীরা হিজাব পরিধানের দিকে ঝুঁকে পড়ে না তাদেরকে এর দিকে ঝুঁকে পড়তে যা সাহায্য করে তা হচ্ছে- বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল যা হিজাবকে একটি ফ্যাশন হিসাবে উপস্থাপন করা।

কিছু নারী আছেন এমন যারা হিজাব পরিধান করেন, কারণ এতে তাদেরকে খুব সুন্দর দেখায় এবং এতে করে তারা অন্য পুরুষদের আকৃষ্ট করতে পারে। ‘গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক ছাত্রী হিজাব পড়া শুরু করে দিয়েছে যাতে করে তারা ছাত্রদের আকৃষ্ট করতে পারে এবং বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।’

২০০১ সালে স্নাতক শেষ করা মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী এমনটি জানান। তিনি আরো জানান, ‘এটি হওয়া খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।’

২০০৪ সালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর জরিপ চালিয়ে উপরোক্ত কারণের মত একই ব্যাপার দেখা গিয়েছে এবং আরো দেখা যায় যে বর্তমান সময়ে বিভিন্ন রঙয়ের হিজাব মেয়েদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

তবে বর্তমানে মিশরের স্বৈরশাসক আবদেল ফাতাহ আল সিসির অধীনে কঠোর ধর্মীয় বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে অভিনেত্রী শিহার মত অনেকেই হিজাব খুলে ফেলছে এবং এতে করে মিশর আবার এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে শুরু করেছে।

উপরোক্ত জটিল আলোচনা থেকে পশ্চিমা নারীরা কিভাবে হিজাবকে মূল্যায়ন করেন তার একটি ধারণা পাওয়া যায়। হিজাব পরিধানের ব্যাপারে মিশরের অবস্থা বর্ণনা দেয় যে, দেশটির নারীরা বিভিন্ন কারণে হিজাব পরিধান করে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ধর্মীয় ইস্যু, রাজনৈতিক কারণ, ফ্যাশন হিসাবে, বিনোদনের জন্য এবং ধর্মীয় কারণে। তবে এ কথা সত্য যে তারা ধর্মীয়ভাবে গৌড়া শুধুমাত্র এ কারণে হিজাব পরিধান করেন।

হিজাব নিয়ে বরিস জনসনের বিরূপ মন্তব্যের পর যা বললেন মুসলিম কাউন্সিলর

যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির একজন মুসলিম নারী কাউন্সিলর দাবি করেন তাকে বলা হয়েছিল ‘আপনার মস্তক আবৃত্তকারী পোশাক পরার কারণে’ নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারবেন না এবং ‘ইসলাম ভীতি’ বৃদ্ধির কারণে তার প্রতি এমন মন্তব্য করা হয়েছে বলে জানান।

যুক্তরাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলের এই কাউন্সিলর সরিয়া সিদ্দিকী সম্প্রতি দ্যা টেলিগ্রাফ নামক খবরের কাগজে বরিস জনসনের হিজাব নিয়ে মানহানিকর একটি কলামের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন তিনি তার শহরে মুসলিম বিরোধী মনোভাবের বিষয়ে ভীতির মধ্যে রয়েছেন।

যুক্তরাজ্যের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন চলতি মাসে মুসলিম নারীদের বোরকার ওপর আক্রমণ করে বলেন, যেসব মহিলা বোরকা পরিধান করে তাদেরকে ‘ব্যাংক ডাকাত’ এবং ‘ডাক বাক্সের’ মত দেখায়।

৫৪ বছর বয়সী সাবেক এই মন্ত্রী অক্সফোর্ডশায়ারে তার বাড়িতে এক কাপ চা হাতে নিয়ে অপেক্ষারত সাংবাদিকদের তার এমন বিবেদ সৃষ্টিকারী মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে হাজির হন।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বরিস জনসনের এমন মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করার আহ্বান জানান এবং তিনি কনজারভেটিভ পার্টিকে ইসলামভীতি মূলক এমন মন্তব্যের জন্য একটি তদন্ত আরম্ভ করার জন্য আহ্বান করেন।

মিস সিদ্দিকী হচ্ছেন বরিস জনসনের মানহানিকর বক্তেব্যের প্রতিবাদকারী কর্মকর্তাদের একজন, যিনি মুসলিম নারী হিসাবে ধর্মান্ধতার মুখোমুখি হয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন বলে জানিয়েছেন।

তিনি জানান, ‘আমি খুবই হতাশ এবং রাগান্বিত এই কারণে যে একজন পুরুষ রাজনীতিবিদ মুসলিম নারীদেরকে অপমান করে কথা বলাকে বিবেচনাকর মনে করেন।’

‘নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মুসলিম নারীদের প্রতি এমন উপহাস এবং বিদ্রুপজনক মন্তব্যের ফলে জনগণের মনে এমন বার্তা যেতে পারে যে, তারা মুসলিম নারীদেরকে ঘৃণা করাটাকে সঠিক বলে মনে করবেন। একারণে প্রতিদিন ইসলামভীতি ছড়ানোটা স্বাভাবিক একটি কাজে পরিণত হবে।’

‘যখন আমি একজন নারী হিসাবে ভোটে দাঁড়াই তখন আমি লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয়েছিলাম। এবং যখন আমি একজন মুসলিম নারী হিসাবে ভোটে দাঁড়াই তখন আমি তিনগুণ লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয়েছিলাম এবং সাথে সাথে ইসলামভীতি ও বর্ণবাদেরও শিকার হয়েছিলাম।’

‘আমি এমন অনেক মন্তব্য শুনেছিলাম যে, ‘সে পুরোপুরি পশ্চিমা নারী হতে পারেনি’, ‘সে তার মস্তক আবৃত্তকারী পোশাক পরার কারণে জয় লাভ করতে পারবে না।’

মিস সিদ্দিকী একজন বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক এবং স্টার্টক্লাইড বিশ্ববিদ্যায় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করা একজন নারী।

কিন্তু তিনি জনসনের মন্তব্যের কারণে তার এলাকার মুসলিম নারীদের সমস্যা বাড়বে বলে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

তিনি জানান, ‘মহিলাদের অপমান এবং তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার কারো কোনো অধিকার নেই। রাজনীতিবিদদের উচিত বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যকার ঐক্য বজায় রাখতে কাজ করা এবং তারা যেন ইসলামভীতি মূলক ঘৃণা থেকে বিরত থাকে সে ব্যাপারে সচেতন থাকা।’

‘আমি আমার অঞ্চলের অনেক মুসলিম নারীকে হিজাব পরিধান করার কারণে অপমানের সম্মুখীন হতে শুনেছি।’ ‘একজন নারীবাদী মুসলিম হিসাবে আমি বলতে চাই, আমার যা ইচ্ছা তাই পরবো এবং আমাকে সমাজের অন্যদের মত অবশ্যই গ্রহণযোগ্য বলে মনে করতে হবে। যেটি সকল নারীরই একটি অধিকার।’

ওয়শিংটন পোস্ট ও দ্য স্কটিস সান অবলম্বনে

captcha