
হার্জেল, যিনি “ইহুদি রাষ্ট্র” ধারণার প্রচারক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতেন, প্রকৃতপক্ষে তিনি এমন এক পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন যা শুধু লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনির বাস্তুচ্যুতি ও দুর্ভোগের কারণই হয়নি বরং ইহুদিদের নামে ফিলিস্তিন দখলের এক কৌশলগত রোডম্যাপ হিসেবেও কাজ করেছে। এখানে পার্সটুডের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তার জীবন ও কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো।
জন্ম ও পরিবার
থিওডর হার্জেল ১৮৬০ সালের ২২ মে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে এক ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার তিনটি নাম ছিল — থিওডর (জার্মান নাম), বেনিয়ামিন জেও (হিব্রু নাম) এবং তিভাদার (হাঙ্গেরীয় নাম)।
ছয় বছর বয়সে তিনি একটি ইহুদি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং চার বছর সেখানে পড়াশোনা করেন। তবে পরে ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয় এবং তিনি হিব্রু ভাষা বা লিপি কখনও শিখতে পারেননি।
এরপর তিনি একটি টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে এবং আরও পরে ১৫ বছর বয়সে একটি প্রোটেস্টান্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৮৭৮ সালে তিনি স্নাতক সম্পন্ন করেন। যদিও তার পরিবার হাঙ্গেরীয় ছিল, কিন্তু এরপরও তারা জার্মান পরিচয় ও সংস্কৃতি বজায় রাখে। ১৮৮৮ সালে পরিবারটি ভিয়েনায় চলে আসে। সে সময় ভিয়েনায় ইহুদির সংখ্যা ছিল এক হাজারেরও কম, কিন্তু মাত্র দশ বছরের মধ্যে তা এক লক্ষ ছাড়িয়ে যায়।
লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় প্রবেশ
১৮৮৪ সালে হার্জেল আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন, কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত নেন পুরোপুরি লেখালেখিতে সময় দেবেন। ১৮৮৫ সাল থেকে তিনি সাংবাদিকতা ও লেখালেখি শুরু করেন। এ সময় তিনি কয়েকটি নাটক রচনা করেন, যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাটক ছিল “নতুন গেটো”, যা ১৮৯৪ সালে রচিত হয়।
তার লেখাগুলো মূলত পশ্চিমা সমাজে ইহুদিদের কিভাবে মিশে যাওয়া যায় বা তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ধরে রেখে কিভাবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন সম্ভব সেই প্রশ্নগুলো ঘিরে আবর্তিত ছিল।
কিন্তু হার্জেল ও তার সমমনোভাবাপন্ন চিন্তাবিদরা যেমন ম্যাক্স নর্ডাউ ও জর্জ লুকাচ শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসে পৌঁছান যে, পশ্চিমা সমাজে ইহুদিরা কখনও পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হবে না; কারণ সমাজে ইহুদিবিদ্বেষ রয়েছে।
বিবাহ ও ব্যক্তিগত জীবন
১৮৮৯ সালে হার্জেল বিয়ে করেন জুলি নাচাওয়ার-কে, তিনি ছিলেন এক ধনী পরিবারের কন্যা। হার্জেল ভেবেছিলেন এই বিয়ে তার আর্থিক সংকট দূর করবে, কিন্তু তা হয়নি। মায়ের প্রতি গভীর নির্ভরশীলতা ও ব্যক্তিগত অস্থিরতার কারণে দাম্পত্য জীবন তিক্ত হয়ে ওঠে।
পরে তিনি অস্ট্রিয়ার কয়েকটি সংবাদপত্রে সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং ১৮৯১ সালে চার বছরের জন্য প্যারিসে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো হয়। সেখানে কাজ শেষে তিনি ভিয়েনায় ফিরে এসে সংবাদপত্রের সাহিত্য বিভাগীয় সম্পাদক হন।
ইহুদি প্রসঙ্গ
প্যারিসে অবস্থানকালে ১৮৯৪ সালে “আলফ্রেড ড্রেফুস” নামে এক ফরাসি ইহুদি সেনা কর্মকর্তা জার্মানির পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত হন। এই ঘটনায় ফ্রান্সে ইহুদিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বেড়ে যায়।
এর পর তিনি উপলব্ধি করেন, ইহুদিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র থাকতে হবে। এই ভাবনা থেকেই তিনি ১৮৯৬ সালে বই লেখেন — “দ্য জিউইশ স্টেট”, যেখানে তিনি ইউরোপের বাইরে — যেমন ফিলিস্তিন বা আফ্রিকা — কোথাও একটি “ইহুদি রাষ্ট্র” প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন।
জায়নবাদী আন্দোলন ও ১৮৯৭ সালের বিশ্ব কংগ্রেস
হার্জেল এরপর “বিশ্ব জায়নবাদী সংস্থা” গঠনের উদ্যোগ নেন, যাতে এই আন্দোলনকে সংগঠিতভাবে পরিচালনা করা যায়। ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডে প্রথম বিশ্ব জায়নবাদী কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে জায়নবাদী বা ইহুদিবাদীদের আনুষ্ঠানিক লক্ষ্য নির্ধারিত হয় এবং হার্জেলকে এর প্রধান নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনা
এই কংগ্রেস বা সম্মেলনের পর হার্জেল জার্মানি ও ব্রিটেনসহ বিভিন্ন ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন।
তিনি সিনাই, সাইপ্রাস, পূর্ব আফ্রিকা ইত্যাদি স্থানে ইহুদি উপনিবেশ গঠনের প্রস্তাব দেন, কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই ব্যর্থ হয়।
১৯০১ সালে তিনি ওসমানীয় সম্রাট দ্বিতীয় আবদুল হামিদ-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ফিলিস্তিনে “ইহুদি রাষ্ট্র” প্রতিষ্ঠার জন্য তার সমর্থন চান, কিন্তু সম্রাট সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
মৃত্যু
১৯০৪ সালের ৩ জুলাই মাত্র ৪৪ বছর বয়সে হার্জেল মারা যান। যদিও তার জীবন ছিল সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তার চিন্তা ও প্রচেষ্টা এমন এক ঘৃণ্য রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তি স্থাপন করেছে, যা পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল নামে একটি অবৈধ অস্তিত্বের প্রতিষ্ঠা ঘটায়।
১৯৪৯ সালে, ইসরায়েল গঠনের এক বছর পর, থিওডর হার্জেলের দেহাবশেষ ফিলিস্তিনের দখলকৃত ভূখণ্ডে অর্থাৎ বর্তমান ইসরায়েলে স্থানান্তর করা হয়।#পার্সটুডে