২০১২ সালে মিয়ানমারে গত ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে ২ শতাধিক মানুষ নিহত, ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ দেশটি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায় যাদের সিংহভাগ রোহিঙ্গা মুসলিম।তখন এক জঘন্য প্রচারণা শুরু হয়ে যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের কারণেই মিয়ানমারে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়ছে। এটা ঠিক যে মিয়ানমারে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধরা মুসলমানদের ঘৃণা করেন এবং এ ঘৃণা শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে পরিণত হয়, ক্ষোভের সঞ্চার করে এবং পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে পড়ে।
এরপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন অঞ্চলে রোহ্ঙ্গিা মুসলমানদের হত্যাযজ্ঞ শুরু করে, বাড়ি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়, রোহিঙ্গা নারীরা ধর্ষণের শিকার হতে থাকেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এধরনের নির্যাতনের অভিযোগ করে। অন্তত ৩০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান তাদের ঘর বাড়ি ছেড়ে সরে যায়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ স্যাটেলাইট ছবির ব্যবহার করে দেখতে পায় রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে শত শত বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মিয়ানমার সরকার এধরনের নির্যাতনের কথা অস্বীকার করে বলে, রাখাইন অঞ্চলে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে।
এমন প্রেক্ষাপটে অং সাং সুচি যিনি তার দেশে গণতন্ত্রী হিসেবে সুপরিচিত, মিয়ানমারের স্টেট অব দি কাউন্সিল, তার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের রক্ষায় ব্যর্থতার অভিযোগ ওঠে। মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধান হিসেবে তার সুপ্রভাবের ক্ষমতা বিশ্ববাসীর অজানা নয়। কিন্তু জাতিসংঘের আহবান সত্ত্বেও এখনো রাখাইন অঞ্চলে যাননি, তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন মাত্র। শান্তিতে এই নোবেল জয়ী মনে করেন, রোহিঙ্গাদের বাঙ্গালী বলা উচিত, তাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা মাত্র। সুচি মনে করেন, তার দেশে রাখাইন অঞ্চলে যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে তা অতিরঞ্জিত। অথচ রাখাইন অঞ্চলে আন্তর্জাতিক মিডিয়া, ত্রাণকর্মীরা যেতে পারছে না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নির্যাতিত রোহিঙ্গারা অনাহারে ও প্রাণ বাঁচানোর দায়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিচ্ছে, তাদের কেউ কেউ নৌকায় নাফ নদীতে ভাসছে, তাদের গুলি করে হত্যার মত ঘটনাও ঘটছে।
এর আগে রাখাইন অঞ্চলে ত্রাণ তৎপরতা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি চরম অবস্থায় পৌঁছেছে। রোহিঙ্গা গ্রামগুলো জনমানবহীন। ঘরবাড়িগুলো আগুনে পুড়ে গেছে। ক্ষেতের পাকা ফসল কাটার কেউ নেই। ইউনিসেফ সাবধান করে দিয়ে বলেছে, হাজার হাজার রোহিঙ্গা শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে, কোনো স্বাস্থ্য সুবিধা এমনকি চিকিৎসা পর্যন্ত পাচ্ছে না। মিয়ানমার সরকারের উচিত সেখানে ত্রাণ ও চিকিৎসা সুবিধা পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে রাখাইন অঞ্চলে নিরপেক্ষ তদন্তের আহবান জানিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মিয়ামমার সরকারের কাছে জাতিসংঘের সহায়তা নেয়ার কথা বলেছে।
মানবাধিকার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে অং সাং সুচির প্রয়োজন তার ভাবমূর্তি রক্ষা করা। সুচির রাজনৈতিক দল দশকের পর দশক ধরে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ে ক্ষমতায় এসেছে এবং সে ক্ষমতার শীর্ষে রয়েছেন সুচি। একজন মানবাধিকার যোদ্ধা হিসেবে সুচি রোহিঙ্গা মুসলিমদের দুর্দশা লাঘবে কেন তবে ব্যর্থ হবেন?
মিয়ানমারে ঔপনিবেশিক আমলে যখন ভারতীয়রা আসতে শুরু করে যাদের অধিকাংশ ছিল মুসলিম, তাদের অনেকে সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়ে এবং সৈন্য হিসেবে দেশটিতে আসতে শুরু করে। এ বিষয়টি মিয়ামারের বৌদ্ধ সম্প্রদায় ভালভাবে নেয়নি। বছরে পর বছর ধরে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মনেও এ নিয়ে ক্ষোভ জমা হতে থাকে। এর পাশাপাশি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের তুলনায় মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃ্িদ্ধ পাওয়ার ফলে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মাঝে এ বিষয়টিও নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি পায়। তারা আশঙ্কা করেন যে এভাবে মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে গেলে তা মিয়ানমারের নৃতাত্ত্বিক চরিত্রকে পরিবর্তন করে দিতে পারে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত থাকায় তাদের অনেকেই মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর চলে গেছেন। বৌদ্ধ গ্রাহকদের অসহযোগিতার কারণে মিয়ানমারে মুসলিম ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা হারিয়েছেন। নাইন সিক্স নাইন নামে বৌদ্ধ আন্দোলন বেশ কিছু দেশের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয় যে আন্দোলনের লক্ষ্যই ছিল মুসলমানদের তৈরি পণ্য ও ব্যবসা এড়িয়ে চলা ও মুসলিমদের সঙ্গে বিয়ের সম্পর্ক না রাখা। এ আন্দোলনকারীরা দাবি করেন তারা কোনো সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত নয়, কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, এধরনের ঘৃণা, সামাজিক সম্পর্ক এড়িয়ে চলা, মুসলমানদের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন না করার মনোভাব ক্রমান্বয়ে রোহিঙ্গাদের হত্যাযজ্ঞ, নারীদের ধর্ষণ, তাদের বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেয়ার মত সহিংসতায় রুপ নেয়।
এধরনের পরিস্থিতির পেছনে উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ‘মা বা থা’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন যার উদ্দেশ্য হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মকে সুরক্ষা করা। ২০১৪ সালে ‘মা বা থা’ আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে, যা এখন দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। গত বছর এ সংগঠনের প্রভাবেই মিয়ানমারে ‘প্রটেকশন অব রেস এন্ড রিলিজিয়ন ল’স নামে যে আইনটি প্রণয়ন হয় এবং তারই প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার হারাতে থাকেন। এর আগে ১৯৮২ সালেই তাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করা হয়। ‘মা বা থা’ সংগঠনটি ধারাবাহিকভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে মিয়ানমারে এক ঘরে করার জন্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। অব্যাহতভাবে প্রচারণা চলতে থাকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে। মিয়ানমারের পুরো সমাজ এভাবেই মুসলিম বিরোধী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে পড়ে। পদেপদে রোহিঙ্গা মুসলিমরা বৈষম্যের শিকার এমনকি মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম মাত্রই ঘৃণার ব¯‘।
এই ধরনের মারমুখি অপপ্রচার সত্ত্বেও রোহিঙ্গা মুসলমানরা শান্ত ও সুস্থির থাকে। সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতা বা বৌদ্ধ সন্ত্রাস তাদের ওপর যাতে আরো চেপে না বসে এজন্যেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা পারতপক্ষে নিজেদের বেঁচে থাকার ওপরই কেবল মনোযোগ রাখার চেষ্টা করে। এখন পর্যন্ত রাখাইন অঞ্চল সিরিয়্,াআফগানিস্তান, চেচনিয়া অথবা কাশ্মীর হয়ে ওঠেনি, কোনো বিদেশি তরুণ তরুণী রাখাইনে সন্ত্রাসী তৎপরতা শুরু করেনি, আইএস জঙ্গিদের সঙ্গে ইরাক ও সিরিয়ায় এসে যোগ দেয়ার মত রাখাইনে আসেনি কারণ জঙ্গিদের পথভ্রষ্ট করে খিলাফত কায়েমে বিভ্রান্ত করার সুযোগ রাখাইন অঞ্চলের শান্তিপ্রিয় কৃষি নির্ভর, জেলে ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মুসলিমরা দেয়নি। যাদের অধিকাংশ গরিব ও দিন আনে দিন খায়।
দ্বিতীয়ত মিয়ামারের সীমান্ত প্রহরা শক্তিশালী ও এর প্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীরা বেশ কড়া নজর রাখে। বিদেশি জিহাদীদের পক্ষে এ অঞ্চলে ঘাঁটি গড়ে তোলা সহজ ব্যাপার নয়। তৃতীয়ত নরওয়ের ইসলাম বিশেষজ্ঞ থমাস হেগাঘামার বলেন, জঙ্গিরা কখনো মুসলিমদের দুর্দশায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে না, তারা সেখানেই যায় যেখানে মুসলিমরা যুদ্ধে লিপ্ত। তাই রাখাইন এখন যুদ্ধের ময়দানের চেয়ে অনেক বেশি হত্যাযজ্ঞের প্রান্তর। কিন্তু ঝুঁকি ও মতভেদ দুই পাল্টে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে।
দশকের পর দশক শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রেখেও মিয়ানমারে এখন রোহিঙ্গা মুসলিমরা আতঙ্গে থাকে কখন তারা পুনরায় আঘাতের শিকার হবে। গত কয়েক বছরে শান্তির অনুসারী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হাতে রোহিঙ্গা মুসলমানরা ক্রমাগত হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে। এধরনের আক্রমণ মুসলমানদের এই শিক্ষাই দিয়েছে যদি সহিংসতা তাদের ওপর হামলা করে তাহলে তা তাদের প্রতিবেশি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেই আসে। রোহিঙ্গাদের বিকল্প তাহলে নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু যতক্ষণ না রাখাইন অঞ্চলে পরিস্থিতির উন্নতি না হচ্ছে, সেখানে বেঁচে থাকা তাদের জন্যে অসম্ভব, সেই কারণে হাজার হাজার রোহিঙ্গা খোলা আকাশের নীচে, জঙ্গলে, নাফ নদী কিংবা সাগরে ক্ষুদ্র নৌকায় বেঁচে থাকার জন্যে সামান্য আশ্রয় খুঁজছে।
সূত্র: আমাদের সময়