IQNA

আইন মেনেই ৪০,০০০ রোহিঙ্গা মুসলিমকে ভারত থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে!

19:09 - September 09, 2017
সংবাদ: 2603790
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ‘আমরা ফুটবলের মত বাঁচছি। একবার এ কুল থেকে লাথি মারলে ও কুলে যাই। ও কুল থেকে লাথি মারলে এ কুলে আসি’ বলছিলেন আহমেদ হোসেন নামে এক রোহিঙ্গা। পাশ থেকে জোহরা বেগম বলছেন, ‘আমাদের কোনও দেশ নাই। কোনও আত্মপরিচয়ই নাই।’

বার্তা সংস্থা ইকনা: বিদেশি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আহমেদ বা জোহরা যা বলছেন, তা আসলে মিয়ানমারের লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা মুসলমানদেরই কথা। ওরা বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে বসে রয়েছেন। জানে না ভবিষ্যৎ কী?

এদিকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া ৪০,০০০ রোহিঙ্গা রিফিউজিকে এ দেশ থেকে বের করে দেওয়ার সরকারি ফতোয়া জারি করে দিয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার।

‘আইন অনুযায়ী, ওদেরকে (রোহিঙ্গা শরনার্থীদের) ফিরিয়ে দিতে হবে। কারণ তারা অবৈধ অভিবাসী। আমরা মহৎ গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের দেশ। ভারত সবচেয়ে বেশি উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিয়েছে। কাজেই ভারত কী ভাবে উদ্বাস্তুদের বিষয়টি দেখবে তা নিয়ে কাউকে শিক্ষা দিতে হবে না।’ বলেছেন ভারতের মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু।

কিরেণ রিজিজু বলেন, আইন অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী কোনও ভুল কাজ করছেন না। কারণ এই ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান রিফিউজি আসলে অবৈধ ভাবে ভারতে ঘাঁটি গেড়ে বসে রয়েছে। কেউ দিল্লিতে, কেউ জম্মুতে আবার কেউ বা হায়দরাবাদে।

তিনি বলেন, কারণ ভারতে কোনও রিফিউজি আইনই নেই। নেহরু সরকার থেকে শুরু করে মোদি সরকার, কেউই জাতিসংঘের ১৯৫১ সালের রিফিউজি কনভেনশনের ঘোষণাপত্রে সই করেনি। আলাদা করে কোনও আইনও এদেশে তৈরি হয়নি।

ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজি (ইউএনএইচসিআর)-এর অফিস দিল্লিতে থাকলেও, তারা আলাদা করে প্রায় ১৪ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান শরণার্থীদের নাম পরিচয় পরীক্ষা করে নথিভুক্ত করলেও, ভারতে তার আইনত কোনও স্বীকৃতি নেই।

বছরের পর বছর ধরে মিয়ানমার সরকারের অত্যাচারে ঘর ছাড়া হয়েছেন এই রোহিঙ্গা মুসলমানরা। সম্প্রতি ২৫ আগস্ট সে দেশের সেনা চৌকিতে হামলার ফলে পাল্টা হিসেবে মিয়ানমানের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ কট্টরপন্থীদের অত্যাচার আরও বেড়েছে। চলছে প্রতি আক্রমণও।

ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, নির্বিচারে গুলি চলছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হয়ে পাহাড়-জঙ্গল পেরিয়ে বাংলাদেশে ঠাঁই নিচ্ছেন। কোনও মিডিয়া রোহিঙ্গাদের বাস যেখানে, সেই রাখাইন প্রদেশে ঢুকতে পারছে না। চুপচাপ সেই গণহত্যার মদত দেওয়াতে অভিযুক্ত হয়েছেন সে দেশের শান্তি-নোবেলজয়ী নেত্রী আন সান সু চি।

ঠিক সেই সময়ে সারা বিশ্ব জুড়ে যখন রোহিঙ্গা মুসলমানদের গণহ্ত্যা নিয়ে প্রতিবাদ চলছে, তখনই ভারতের মোদি সরকারের এই ঘোষণা। ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেণ রিজিজুর মাধ্যমে, আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গা মুসলমানদের এ দেশ থেকে বের করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করে এক ঢিলে দু’পাখি মারতে চেয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।

একদিকে তিনি বর্তমান মিয়নমার সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। সে দেশে চীনের প্রভাব যাতে বেশি না পড়ে, তার জন্য মায়ানমার সফরে গিয়ে সে দেশে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকারের লড়াইকে সমর্থন জানিয়ে এসেছেন।

আন সান সুচিকে যৌথ বিবৃতিতে নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, আমরা আশা করি সবপক্ষ এক সঙ্গে কোনও পথ বের করবে যাতে মিয়ানমারের সীমানার অখণ্ডতা ও ঐক্য বজায় থাকে।

অন্যদিকে তার নিজের দক্ষিণপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মায়ানমারের বৌদ্ধ কট্টরপন্থার আদর্শগত লাইন একদম মিলে গেছে। ঘরে বাইরে তিনি কট্টরপন্থীদের কাছে হিরো হয়ে গেছেন।

এর ফলে মোদি সরকারের দ্বিচারিতাও সামনে এসে গেছে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশিদের সম্বন্ধে বলেছিলেন, ওখানকার হিন্দু সংখ্যালঘুরা এদেশে স্বাগত। কিন্তু সংখ্যাগুরু মুসলমানরা অনুপ্রবেশকারী হিসেবেই চিহ্নিত হবেন।

বিজেপিও ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইস্তেহারে লিখেছিল, অত্যাচারিত হিন্দুদের কাছে ভারত স্বাভাবিক ঘর হয়ে থাকবে। তারা এখানে স্বাগত। দেশভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা দেশের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তান থেকে রিফিউজিরা এ দেশে এসেছে।

তিব্বতিরাও ভারতে এসে আশ্রয় পেয়েছেন। তামিলরাও। এমনকী আফগানিস্তান থেকেও শরণার্থীরা এসেছেন ভারতে। সবটাই হয়েছে মানবিকতার খাতিরে।

‘১৯৪৬ সালের বিদেশি আইন’ এর মাধ্যমেই শরণার্থীরা আশ্রয় পেয়েছেন বা অবৈধ ঘোষিত হয়েছেন ভারতে। দীর্ঘমেয়াদি ভিসার মাধ্যমে রয়ে গেছেন এই দেশে। সেই যুক্তিতে মিয়ানমানের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানাতে আপত্তি কোথায়?

বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী দাবি করেছেন, রোহিঙ্গা মুসলমানদের এ দেশে ঠাঁই দিলে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যেই জেহাদিরা রোহিঙ্গাদের উস্কে দিতে শুরু করেছে।

কারণ মিয়ানমার সরকারেরও বক্তব্য রাখাইন প্রদেশে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির ব্যানারে জঙ্গি কার্যকলাপ চলছে। তারই ফলশ্রুতি সেনা চৌকিতে আক্রমণ। পরবর্তীতে সেনা অভিযান।

রিফিউজি কনভেনশনে সই করলে যে কোনও শরণার্থীকেই ঠাঁই দিতে বাধ্য থাকবে ভারত। বর্তমান অর্থনৈতিক ও ছিদ্রযুক্ত সীমানার কথা ভেবেই ভারত সরকার কখনও সেই ঘোষণাপত্রে সই করেনি। কিন্তু নিজেদের রিফিউজি আইন করতে তো বাধা ছিল না।

তাহলেই আর এখন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের এ ভাবে খুঁজতে হত না। নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে যার দরকার তাকে আশ্রয় দেওয়া যেত, যার দরকার নেই, তাকে সে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা যেত। পূর্ববর্তী সরকার ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির খাতিরে সে পথে হাঁটেনি।

রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। মোদি এদের ভারত থেকে বের করে দিয়ে পাঠাবেন কোথায় সেটাই বড় প্রশ্ন। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিজেদের নাগরিক বলেই স্বীকৃতি দেয় না। সেদেশে এরা যেতেও পারবেন না।

তবে কি মোদি সরকার, তাইল্যান্ডের শাসকদের মতো ছোট ছোট ডিঙিতে করে ভারত মহাসাগরে ভাসিয়ে দেবেন এই রোহিঙ্গাদের? নাকি বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা করেই নিজের ‘ভোটব্যাঙ্ক’কে সতেজ রাখবেন। উগ্র জাতীয়তাবাদের আরও একটি নিশানা তৈরি করে দেবেন শুধু। এমটিনিউজ
captcha