বার্তা সংস্থা ইকনা: এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে: ইসলাম প্রচার ও সম্প্রসারণ বিষয়ক ইতিহাস ভিত্তিক গ্রন্থসমূহ গবেষণা করে আমরা দেখতে পায়, প্রত্যেক ব্যক্তির চিন্তাভাবনার সাধারণ প্রবণতার সাথে ধর্মে পার্থক্য রয়েছে।
এই বিষয়টি বিশ্বের উল্লেখযোগ্য নেতা ও চিন্তাবিদদের উপরও প্রভাব বিস্তার ও অনুপ্রাণিত করেছে।
এর প্রভাব এতটাই অধিক যে মহাত্মা গান্ধীর মত ব্যক্তিও বলেছেন: "আমি ভারতের জনগণের জন্যে নতুন কোনো জিনিস নিয়ে আসি নি। কেবল কারবালার কালবিজয়ী বীরের জীবনেতিহাস নিয়ে গবেষণা করে যে ফলাফল পেয়েছি তা-ই আমি ভারতকে দেখিয়েছি। যদি আমরা ভারতকে মুক্তি দিতে চাই,তাহলে সেই পথটিই আমাদেরকে অতিক্রম করতে হবে যে পথ হোসাইন ইবনে আলী অতিক্রম করেছেন।"
তিনি আরও বলেন: আমি হুসাইন (আ.)এর নিকট থেকে শিখেছি, মজলুম থাকা অবস্থায়ও কিভাবে বিজয়ী হওয়া সম্ভব।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ এবং ব্রিটিশ সংসদ সদস্য "এডওয়ার্ড গিবন" (জন্ম: ১৭৩৭/ মৃত্যু: ১৭৯৪) বলেছেন: দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও হুসাইন (আ.)এর হৃদয় বিদারক মৃত্যুর ঘটনাটি মানুষের হৃদয়কে উজ্জীবিত করে তোলে।
ইংরেজি লেখক চার্লস ডিকেন্স ইমাম হুসাইন (আ.)এর বিপ্লবের সম্পর্কে বলেন: যদি হুসাইন (আ.) পার্থিব ইচ্ছাগুলোর জন্য যুদ্ধ করতেন, তাহলে আমি বুঝতে পারতাম না, কেন তিনি তাঁর বোন ও সন্তানদের নিয়ে কারবালায় উপস্থিত হয়েছেন। অতএব এটি স্পষ্ট যে, তিনি ইসলামের জন্য আন্তরিকভাবে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন।
স্কটিশ চিন্তাবিদ ও ইতিহাসবিদ টমাস কার্লাইল বলেন: কারবালার ট্র্যাজেডি থেকে সবথেকে উত্তম শিক্ষা অর্জন করেছি। সেটি হচ্ছে, মহান আল্লাহর প্রতি ইমাম হুসাইন (আ.) এবং তাঁর সাঙ্গীদের পরিপূর্ণ ঈমান ছিল। তাঁরা দেখিয়ে দিয়েছেন, যখন হক ও বাতিলের প্রসঙ্গ আসে, তখন সংখ্যাসূচক শ্রেষ্ঠত্বকেও প্রাধান্য দেওয়া উচিত নয়। স্বপ্ন সংখ্যক সঙ্গী নিয়ে ইমাম হুসাইন (আ.)এর বিজয় আমাকে বিস্মিত করেছে!
ইমাম হুসাইন (আ.)এর জারিঘরের ছবি
এই প্রতিবেদনের লেখক আরও লিখেছেন: ইমাম হুসাইন (আ.)এর ব্যাপারে এই শক্তিশালী শব্দটি পড়ার পর একটি প্রশ্ন থেকে যায়। সেটি হচ্ছে: কে এই ইমাম হুসাইন (আ.)?
অতঃপর ইমাম অর্থাৎ নেতা উল্লেখ করে বর্ণনা করেন: ইমাম হুসাইন (আ) হচ্ছেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)এর প্রাণপ্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.)এর দ্বিতীয় সন্তান। তিনি মদিনায় ৬২৬ খ্রিষ্টাব্দের দশম জানুয়ারিতে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হন।
কিছু দিনের মধ্যেই পৃথিবীর কোটি কোটি জনগণের মুখে তাঁর নাম উচ্চারিত হচ্ছে এবং এই শব্দ চিরকালের জন্য অব্যাহত থাকবে। অবশ্য ইমাম হুসাইন (আ.)কে যে মূল্য দিতে হয়েছে তার অংশও কম নয়। নিজের এবং তাঁর পরিবার ও বন্ধুদের জীবন উৎসর্গ করে তিনি ইসলামকে উজ্জীবিত করেছেন।
হযরত মুহাম্মাদ (সা.)এর ওফাতের পর ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ অন্যান্য সাহাবিদের তুলনায় হযরত মুহাম্মাদ (স.)এর পরিবারবর্গকে অধিক প্রাধান্য দেয়। কেউবা এর বিপরীত।
হযরত মুহাম্মাদ (সা.)এর ওফাতের পর তাঁর প্রতিনিধি নির্বাচনের বিষয়টি একটি রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয় এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা.)এর প্রতিনিধিত্ব রাজার সিস্টেমে পরিচালিত হয়।
ইমাম হুসাইন (আ.)এর পবিত্র মাযার
হযরত মুহাম্মাদ (সা.)এর ওফাতের ৫০ বছরের মধ্যেই উমাইয়ারা ক্ষমতায় আসে এবং পরিপূর্ণভাবে মুসলমানদের ওপর হুকুমত করে। উমাইয়ার দ্বিতীয় খলিফা ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত গ্রহণে অস্বীকার করেন মহানবী (সা.)এর প্রিয় নাতি ইমাম হুসাইন (আ.)। আর ইমামের এই পদক্ষেপ সমগ্র উমাইয়া রাজবংশের জন্য হুমকি হয়ে দাড়ায়।
মুসলমানদের বিরুদ্ধে এমনকি অমুসলিমদের বিরুদ্ধেও ইয়াজিদের অপরাধকর্ম ও দুর্নীতি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পায়। একারণেই ইমাম হুসাইন (আ.) বাইয়াত গ্রহণ করেননি। হযরত মুহাম্মাদ (সা.)এর পরিবার এবং তাঁর প্রতিনিধির জন্য মাত্র দুটি পথ খোলা ছিল। সেদুটির একটি হচ্ছে, ইয়াজিদের সাথে বাইয়াত করা এবং অপরটি হচ্ছে মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়া।
ইয়াজিদের প্রস্তাব মেনে নিলে ইমামকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ও ধন-সম্পদ দেয়া হতো এবং এর বিপরীতে গেলে নিশ্চিত মৃত্যু। এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, ইমাম উত্তম পথটি নির্বাচন করেছেন।
চিত্র: কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ.)এর তাবুকে ঘিরে রেখেছে ইয়াজিদের সৈন্যবহর
মারওয়ানের কাছে ইয়াজিদ চিঠি লেখে এবং সেই চিঠিতে উল্লেখ করে: হুসাইন ও তাঁর সাথীদের আমার সাথে বাইয়াত গ্রহণ করতে বলো এবং তাদের সাথে এমন আচরণ করো, যাতে তারা বুঝতে পারে বাইয়াত ব্যতীত তাদের অন্য কোন পথ খোলা নেই।
ইয়াজিদের সাথে বাইয়াত গ্রহণে অস্বীকার জানিয়ে ইমাম বলেন: আমি কখনোই এমন হীন ব্যক্তিকে সমর্থন করবো না এবং ক্রীতদাসের মতো পলায়ন করবো না। আমি মন্দ কাজকে প্রসারিত করার জন্য আসিনি। আমি ভালো কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ করার জন্য এসেছি। ইমাম হুসাইন (আ.)এর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এটা ছিলো যে, হীনতার জীবনের থেকে মর্যাদার মৃত্যু অনেক উত্তম।
ইমাম হুসাইন (আ.)এর এই সিদ্ধান্তের ফলে ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ম অক্টোবর কারবালার ময়দানে ইমাম হুসাইন (আ.)এর তাঁর সাথীদের নির্মমভাবে হত্যা করে তাদের মস্তক মোবারক কর্তন করা হয়।
অসম এই যুদ্ধে ইয়াজিদের হাজার হাজার যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর ৭২ জন সাঙ্গি শহীদ হন। কারবালার যুদ্ধের পর ইমাম হুসাইনের (আ.)এর অসুস্থ ছেলে এবং তাঁর বোন হযরত জয়নাব (সা.)কে বন্দি করা হয়। ইমাম হুসাইন (আ.)এর মস্তক মোবারকের সাথে তাদেরকে ইরাক থেকে সিরিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।
হাফিংটন পোস্ট আরও লিখেছে: বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২
কোটি মুসলমান এমন কি খৃষ্টানরাও ইমাম হুসাইন (আ.)এর আরবাইনে প্রায় ৯০ কিলোমিটার (নাজাফে
ইমাম আলী (আ.)এর মাযার থেকে কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ.)এর মাযার পর্যন্ত) পায়ে হেটে
কারবালায় ইমাম ও তাঁর সাঙ্গিদের মাযার জিয়ারত করেন। বাৎসরিক এই পদযাত্রা বিশ্বের বৃহত্তম
ধর্মীয় সমাবেশ হিসেবে প্রসিদ্ধ।
ইমাম হুসাইন (আ.)এর পবিত্র মাযার জিয়ারত করতে এসেছেন খৃষ্টান এক পাদ্রী
"মানবতার জন্য ইমাম হোসেনের অনন্য বলিদান" গ্রন্থের লেখক ডা. মাঞ্জুর রাজাভী বলেন: যদি ইমাম হুসাইন (আ.)এর বীরত্বপূর্ণ প্রতিবাদ না থাকত, তাহলে ইসলামের মূল শিক্ষার কিছুই অবশিষ্ট থাকত না। হুসাইন (আ.) ইসলামকে জীবিত করেছেন। নিজের জীবনের বিনিময়ে ইসলামের মূল শিক্ষাকে জীবিত রেখেছেন। ফাতিমা যাহরা (সা. আ.)এর এই সাহসী সন্তানের কাছে ইসলামী বিশ্ব চির ঋণী।
এই প্রতিবেদনে শেষে ইমাম হুসাইন (আ.) এবং তাঁর সাথীদের মস্তক মোবারক কর্তনের বিষয়টিকে দায়েশের কার্যক্রমের সাথে তুলনা করে উল্লেখ করেছে: প্রকৃতপক্ষে, রক্তের বিনিময়ে তলোয়ারের বিরুদ্ধে বিজয়ী হওয়া সম্ভব। ইসলামের নামে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশ তথা আইএস তাদের কার্যক্রমকে অব্যাহত রেখেছে। মুসলিম নেতাদের এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সমর্থন করা উচিত নয়। যদি আমরা ইমাম হুসাইন (আ.)এর নিকট থেকে জীবন, সততা এবং স্বাধীনতার শিক্ষা অর্জন করতে পারি, তাহলে সেটা বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য উত্তমরূপে পরিণত হবে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে কারবালার যুদ্ধে ইমাম হুসাইন (আ.) পরাজিত হয়েছেন; কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তিনি বিজয়ী হয়েছেন। বর্তমানে চরমপন্থি এবং সন্ত্রাসবাদের প্রতিরোধ করার জন্য ইমাম হুসাইন (আ.)এর শিক্ষাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।