IQNA

ইরানে ইসলামী বিপ্লবের গৌরবময় অগ্রযাত্রার ৪১ বছর (পর্ব -তিন)

0:27 - February 04, 2020
সংবাদ: 2610168
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ইরানের ইসলামী বিপ্লব ছিল একটি ঐশী বা খোদায়ী আলোর বিস্ফোরণ। এ বিপ্লবকে বলা হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বিপ্লব।

বার্তা সংস্থা ইকনা'র রিপোর্ট: গত এক হাজার বছরে বিশ্বের বহু দেশে বহু বিপ্লব হয়েছে। যেমন, ইউরোপিয় জাগরণ, ফরাসি বিপ্লব, রুশ কমিউনিস্ট বিপ্লব, চীনা বিপ্লব ইত্যাদি। কিন্তু এসব বিপ্লব তাদের ঘোষিত মূল লক্ষ্য বা আদর্শের ওপর অবিচল থাকতে পারেনি। অথচ ৪১ বছর আগে ইরানে সংঘটিত ইসলামী বিপ্লব আজো তার মূল লক্ষ্য ও আদর্শের ওপর অবিচল রয়েছে। ফলে দিনকে দিন ইরানের ইসলামী বিপ্লবের প্রভাব ও সুফলগুলোকে বিস্ময়কর মাত্রায় ক্রমবর্ধমান দেখা যাচ্ছে।

ইরানের ইসলামী বিপ্লব কয়েক মাসের বেশি টিকবে না বলে পশ্চিমা ও সাম্রাজ্যবাদী বস্তুবাদী শক্তিগুলো ধরে নিয়েছিল। কিন্তু এসব শক্তি ইসলামী বিপ্লবের আধ্যাত্মিক শক্তি ও ঐশি বা খোদায়ি ভিত্তির অপরাজেয় হবার দিকটি লক্ষ্য করেনি। ইরানের ইসলামী বিপ্লবীদের হাতে আটক কূটনীতিকদের বেশধারী মার্কিন গুপ্তচরদের উদ্ধার করার জন্য বিশ্বের কথিত প্রধান পরাশক্তি মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর বড় ধরনের বিমান-অভিযান অলৌকিক ধুলি-ঝড়ে রাতের আঁধারে বানচাল হয়েছিল। এতে ধ্বংস হয়েছিল মার্কিন যুদ্ধ বিমান ও হেলিকপ্টার এবং বেশ কিছু দক্ষ মার্কিন কমান্ডো সেনা!

ঈমান ও ইসলামের শক্তির বলেই ইসলামী ইরান আজ বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের সামরিক শক্তি। সম্প্রতি ইরানের কুদস্ ফোর্সের প্রধান কাসেম সোলাইমানি মার্কিন সন্ত্রাসী হামলায় বাগদাদে শহীদ হওয়ার পর ইরানের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও শোকার্ত কোটি কোটি ইরানি কঠোর প্রতিশোধ নেয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। ফলে ওই সন্ত্রাসী হামলার কয়েক দিন পরই ইরান ইরাকে অবস্থিত মধ্রপ্রাচ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম মার্কিন সামরিক ঘাঁটি এক ডজনেরও বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ধ্বংস করে দেয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ইরান যদি সোলাইমানি হত্যার বদলা নিতে গিয়ে মার্কিন অবস্থানে হামলা চালায় তাহলে ইরানের নানা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাসহ ৫২টি লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলা করব। কিন্তু ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানি হামলার ধ্বংসাত্মক ও নিখুঁত ক্ষমতা দেখে ট্রাম্পসহ গোটা মার্কিন সরকার ইরানের সঙ্গে সংঘাতে নামার সাহস হারিয়ে ফেলে। মার্কিন সরকার ইরানি ওই হামলায় কেবল ৬৪ জন মার্কিন সেনা আহত হওয়ার কথা স্বীকার করলেও বাস্তুবে অন্তত ৮০ জন মার্কিন সেনা নিহত ও ২০০'রও বেশি আহত হয়।

সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সোলাইমানি হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরান যে উচ্চমানের প্রযুক্তিগত-কৌশল-নির্ভর প্রবল হামলা চালিয়েছে সেরকম প্রকাশ্য ও পূর্ব-ঘোষিত হামলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর গত প্রায় ৭০-৮০ বছরের ইতিহাসে আর ঘটেনি। এ হামলা বাস্তবে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন সরকারের দম্ভ চূর্ণ করে দিয়েছে। স্তম্ভিত হয়ে গেছে গোটা পাশ্চাত্য ও তাদের সেবাদাস শক্তিগুলো। অন্যদিকে ইসলামী ইরান হয়ে উঠেছে মুসলিম বিশ্বের গর্ব এবং মজলুম জাতিগুলোর জাগরণ ও মুক্তির কাঙ্ক্ষিত মঞ্জিলে পৌঁছার অদ্যম উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার এক বিরামহীন অনন্য মাধ্যম।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্র, শিক্ষা, সামাজিক-উন্নয়ন, কৃষি, শিল্প, পরমাণু শক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং বিশেষভাবে ন্যানো প্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা ও মৌলিক-কোষ গবেষণাসহ চিকিৎসা ক্ষেত্রে ইরান দর্শনীয় উচ্চ অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। অন্য কথায় ইরানের ইসলামী বিপ্লব দীর্ঘ ৪১ বছর পর মোটেও দুর্বল হয়নি, বরং সামরিক ক্ষেত্রসহ নানা দিকে এ বিপ্লবের কর্মসূচিগুলো দুনিয়াকে তাক লাগানোর মত সাফল্য অর্জন করেছে।

উত্তরাধুনিক চিন্তাবিদ মিশেল ফুকো পাশ্চাত্যের 'বৈশ্বিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে প্রথম বড় ধরনের অভ্যুত্থান' বলে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকের এ সম্পর্কিত এক নিবন্ধে ইতিহাস গবেষক আলতাফ পারভেজ লিখেছেন, রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব ও গণচীনের বিপ্লবের পর ইরানের রাজনৈতিক পরিবর্তন ছিল গত শতাব্দীর বড় এক তাৎপর্যবহ ঘটনা। মস্কোতে কমিউনিস্টরা ২৮ বছর আগে ক্ষমতা থেকে অপসারিত। চীনে কমিউনিস্ট পার্টি থাকলেও সমাজতন্ত্র আর নেই। কিন্তু ইরানে আয়াতুল্লাহরা টিকে আছেন।.... ইরানে আয়াতুল্লাহরা ব্যাপক রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েও সাধারণভাবে এখন পর্যন্ত দুর্নীতি কিংবা ভোগবিলাসে মত্ত হননি। বিচ্ছিন্ন কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁরা নিজেদের জন্য সুযোগ-সুবিধার আলাদা জগৎ তৈরি করেননি।

গবেষক আলতাফ পারভেজ আরও লিখেছেন, ইরান-বিপ্লব নিয়ে ফরাসি চিন্তাবিদ মিশেল ফুকোর উচ্ছ্বাস তখনকার বামপন্থী জগতে বিশাল বিস্ময় ছিল। ফুকো ‘মৌলবাদ’ বা ‘ইসলামি’ তকমায় না ফেলে ‘অন্তহীন ইতিহাসের এক বর্তমান প্রকাশ’ হিসেবে ইরানকে বুঝতে চাইছিলেন। খোমেনির ‘আধ্যাত্মিকতার রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে ফুকো আশাবাদী ছিলেন। নতুন রাজনীতি ও সংস্কৃতির এই ‘নবতরঙ্গ’ মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক দিগন্ত পাল্টে দেবে বলে তিনি মনে করতেন। ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন ও লেবাননের পরিস্থিতি হয়তো তাঁর অনুমানের সাক্ষ্য এখন।

আলতাফ পারভেজ আরও লিখেছেন, ইরানের এই বিপ্লব পশ্চিমা উদারতন্ত্রের বিপক্ষে মোল্লাতন্ত্রের অভ্যুত্থানের চেয়েও অনেক বেশি কিছু। রাজনীতি, দল ও ধর্ম—এই তিন প্রত্যয় পশ্চিমে পৃথক হলেও ইরানের মতাদর্শে তা ঠিক উল্টো বলে এই লেখক মন্তব্য করেন। আর এ কারণেই নেতা হিসেবে রুহুল্লাহ খোমেনির উত্থান ও মৃত্যুর ৩০ বছর পরও তাঁর বিপ্লব টিকে যাওয়ার অনেক কার্যকারণই বাকি দুনিয়া আজও বুঝতে অক্ষম বলে আলতাফ পারভেজ মত প্রকাশ করেন।
সূত্র: parstoday

captcha