IQNA

১ জুলাই ২০২১ শতবর্ষ পূর্তি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযাত্রায় ইসলামী শিক্ষা

16:38 - July 01, 2021
সংবাদ: 3470228
তেহরান (ইকনা): প্রায় দুই শতাব্দীকালের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ ও বৈষম্যমূলক আচরণে নিঃস্ব প্রায় বাঙালি মুসলমানকে শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-গবেষণায় সম্পৃক্ত করতে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ শাসনামলে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।

প্রতিষ্ঠাকালেই ইসলামী জ্ঞানের চর্চা ও গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত ভারতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনালগ্নে আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অন্তর্ভুক্তি ছিল এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমি : ১৭৫৭ সালে যখন পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটে, তখনো এ দেশের প্রতিটি গ্রামে বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসিতে অসংখ্য শিক্ষিত মানুষ ছিল। কিন্তু উনিশ শতকের তিরিশের দশকে রাজভাষা ফারসির পরিবর্তে সরকারি ভাষা হয় ইংরেজি। তাতে ফারসি শিক্ষিতদের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে, বিশেষ করে মুসলমানদের। এরপর এ দেশে ইউরোপীয় মডেলে আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ শিক্ষার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় ১৮৫৭ সালে। ওই বছর জানুয়ারিতে বড় লাট লর্ড কানিং The Acts of Incorporation পাস করে কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাভাষী মানুষের উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল প্রধানত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু হিন্দুদের তুলনায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মুসলমানদের উন্নতিতে ভূমিকা পালন করতে কার্যত ব্যর্থ হয়।

অন্যদিকে বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলায় অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির যে সূচনা হয়, তাও বেশি দিন টেকেনি। বর্ণ হিন্দুদের ‘বঙ্গভঙ্গ বিরোধী’ প্রচারণা এবং নিজেদের জমিদারি স্বার্থরক্ষার নিমিত্তে গঠিত আন্দোলন বেগবান হলে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর মাসে ‘বঙ্গভঙ্গরদ’ হয়ে পুনরায় যুক্তবাংলা ঘোষিত হয়। এ ঘোষণা মুসলমানদের মনে দাগ কাটে এবং বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তখন তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ পূর্ব বাংলার মুসলমানদের অসন্তুষ্টির ব্যাপার আঁচ করতে পেরে ঢাকায় চলে আসেন এবং মুসলমান নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় বসতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ সময় নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমুখ মুসলিম নেতৃবৃন্দের একটি প্রতিনিধিদল ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে দেখা করে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের শিক্ষা সাংস্কৃতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। মুসলিম নেতৃবৃন্দের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় মুসলমানের উন্নয়ন-চিন্তা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে মুসলমানদের প্রয়োজনেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিশন রিপোর্টে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, We do not forget that the creation of the University was largely due to the demand of the Muslim community of Eastern Bengal for greater facilities for higher education. And we have assigned to the representatives of that community an important place on all administrative bodies.

আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ কেন : আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ খোলার ব্যাপারে ১৯১৩ সালের ২ এপ্রিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ব্যবস্থাপক সভার বাজেট অধিবেশনে আপত্তি তোলা হলে নওয়াব আলী চৌধুরী মত প্রকাশ করেন, ‘মুসলমানদের অবশ্যই ইসলামের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ এবং এসংক্রান্ত অন্যান্য বিষয় জানতে হবে। এ বিভাগে আধুনিক পদ্ধতিতে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের জ্ঞানের সমন্বয় সাধিত হবে।’

ঢাবির অবিচ্ছেদ্য অংশ ইসলাম শিক্ষা : প্রতিষ্ঠাকালীন বিভাগ হিসেবে আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগকে বিশ্ববিদ্যালয়ের Integral part বা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে অভিহিত করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর পি. জে. হার্টগ-এর ১৭ আগস্ট ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কোর্ট সভায় প্রদত্ত বক্তব্যে এ বিভাগকে বিশ্ববিদ্যালয়ের Corner Stone বলে আখ্যায়িত করেন।

প্রতিষ্ঠাকালে ইসলাম শিক্ষা : প্রতিষ্ঠাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যসূচি প্রণয়নসহ অন্যান্য কার্যাদি সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে যে ২৫টি সাব কমিটি করা হয় তার দুটি ছিল আরবি ও ফারসি সাব-কমিটি, ইসলামিক স্টাডিজ সাব-কমিটি। নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী মূল নাথান কমিটিরও সদস্য থাকায় ‘অতিরিক্ত মন্তব্যে’ ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ের জন্য একটি অনুষদ গঠনের দাবি করেন। এ দাবি নবাব সিরাজুল ইসলাম, আবু নসর মুহাম্মদ ওহীদ এবং মাওলানা মুহাম্মদ আলী সমর্থন করেন। অনুষদ করার এ দাবিটি নাথান কমিশন কর্তৃক গৃহীতও হয়; কিন্তু কলকাতা কমিশন ইসলামিক স্টাডিজকে অনুষদ না করে বিভাগ করার সুপারিশ করে। একই সঙ্গে কলকাতা কমিশন সংশোধনী দিয়ে আরবিকে ইসলামিক স্টাডিজের সঙ্গে সংযুক্ত করে এবং ফারসির সঙ্গে উর্দুকে জুড়ে দিয়ে ভিন্ন একটি বিভাগ করার পরামর্শ দেয়।

১৯১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল’ ভারতীয় আইন সভায় উত্থাপিত হলে দেখা যায় যে সেখানে বলা হয়েছে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ অর্ডিন্যান্স বা রেগুলেশনের মাধ্যমে খোলা যেতে পারে। তবে এই বিলে যেহেতু সুস্পষ্টভাবে এ বিভাগ খোলার কথা বলা হয়নি, তাই নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী বিলের সংশোধনী দেন। তার এ সংশোধনী আইন সভা কর্তৃক গৃহীত হয় এবং ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ হিসেবে স্বতন্ত্রতা লাভ করে। পরবর্তী সময়ে এ বিলটিই ১৯২০ সালের ১৮ মার্চ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট’ এ পরিগণিত হয় ও ২৩ মার্চ গভর্নর জেনারেলের অনুমোদন স্বীকৃত হয়। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের উপযোগিতা, আবেদন ও চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৮০ সালে আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ দুটি আলাদা বিভাগ হিসেবে যাত্রা শুরু করে।

আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের উপহার : প্রতিষ্ঠার পর আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ জাতিকে বহু স্বর্ণসন্তান উপহার দিয়েছে, যাঁরা মুসলিম জাতির প্রথাগত জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁদের কয়েকজন হলেন ড. এস এম হুসাইন (সাবেক উপাচার্য, ঢাবি), বিচারপতি আব্দুল জাব্বার খান (সাবেক স্পিকার, জাতীয় সংসদ), আব্দুল হক ফরিদী (সাবেক মহাপরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন), ড. সিরাজুল হক (স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত সাবেক অধ্যাপক, ঢাবি), ড. এ কে এম আইউব আলী (সাবেক অধ্যক্ষ, মাদরাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা), ড. মুহাম্মদ আব্দুল বারী (সাবেক উপাচার্য, রাবি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন), ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান (সাবেক উপাচার্য, ইবি), ড. আ ন ম রইছ উদ্দিন (প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রমুখ।

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রেক্ষাপট মূল্যায়ন করেন না; বরং তাঁরা বহু ক্ষেত্রে দৃষ্টি সরিয়ে রাখেন, তা আড়াল করার চেষ্টা করেন এবং ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ ও আরবি বিভাগের প্রতি উন্নাষিকতা দেখান।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

captcha