IQNA

ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আইকিউএনএ-কে সাক্ষাৎকারে বললেন:

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের জন্য শোক—ভালোবাসার শেকড়ে প্রোথিত

9:11 - August 12, 2025
সংবাদ: 3477867
ইকনা- ভার্নন জেমস শুবেল বলেন: “যদি আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-কে ভালোবাসি, তবে প্রিয় রাসূলের পরিবারের কষ্ট সম্পর্কে শুনে আমরা কিভাবে দুঃখ অনুভব না করি? এই দুঃখই হলো ভালোবাসার প্রতীক; যদি আমরা সত্যিই তাঁদের ভালোবাসি, তবে কি আমাদের তাঁদের মতো হওয়ার চেষ্টা করা উচিত নয়? ইমাম হুসাইন (আ.) মানবিক গুণাবলীর এমন এক দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন, যা সবার অনুসরণ করা উচিত, এবং তাঁর গুণাবলী কোথাও কারবালার মতো এত স্পষ্ট নয়।”

ভার্নন জেমস শুবেল (Vernon James Schubel) ১৯৮৮ সালে ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধর্মতত্ত্বে পিএইচডি অর্জন করেন। তিনি ইসলাম বিষয়ে বিভিন্ন কোর্স, যেমন শাস্ত্রীয় ইসলাম, মধ্য এশিয়ায় ইসলাম, সুফিবাদ এবং দক্ষিণ এশিয়ার ধর্মসমূহ পড়ান। তাঁর প্রধান গবেষণার আগ্রহ মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার ইসলাম। ১৯৮৯ সালে তিনি পাকিস্তানের মুলতানে একজন গবেষক হিসেবে কিছু সময় কাটান এবং সেখানে সুফি পীরদের দরগাহ কেন্দ্র নিয়ে গবেষণা করেন। এছাড়া ১৯৯৬ সালে তিনি উজবেকিস্তানে সাত মাস গবেষণা করেন। তাঁর “Religious Performances in Contemporary Islam” শিরোনামের বইটি ১৯৯৩ সালে সাউথ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়।

এই ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক, যিনি অক্সফোর্ড রিসার্চ এনসাইক্লোপিডিয়া অফ রিলিজিয়নে আশুরা ও শোকশিরোনামের প্রবন্ধের লেখক, আইকিউএনএ-র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শিক্ষা ও কারবালার ঘটনার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেন। বহু বছরের একাডেমিক গবেষণা ও মাঠপর্যায়ের কাজের ভিত্তিতে তিনি শোকানুষ্ঠানের কার্যকারিতা নিয়ে বলেন, এটি কেবল কারবালার স্মরণার্থে কিছু আচার নয়, বরং এর চেয়েও বেশি কিছু।

 

ইকনা: আপনি উল্লেখ করেন যে শোকানুষ্ঠান হলো নৈতিক শিক্ষা হস্তান্তরেরএকটি মাধ্যম। কিভাবে আপনি মনে করেন যে কারবালার ঘটনাবলী শিয়া সমাজে প্রজন্মের পর প্রজন্ম নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রেখেছে?

কারবালার ঘটনা মুসলিম প্রজন্মের জন্য নৈতিকতা ও গুণাবলীর শিক্ষা দেওয়ার একটি কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে। যেমন প্রথম অবতীর্ণ সূরাসূরা আল-আলাকবলছে, ওহির উদ্দেশ্য হলো মানবজাতিকে শিক্ষা দেওয়া। ইসলাম ধর্ম হিসেবে মানবতার পূর্ণতার উদ্দেশ্যে এসেছে। কারবালার কাহিনি প্রতিবছর বর্ণনা করার ফলে ধারাবাহিক প্রজন্মের মুসলিমরা মানবিক আচরণের উদাহরণের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছে, যা আবেগগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক উভয় দিকেই প্রভাব ফেলে।

ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সাথীদের আচরণ, যা শোকানুষ্ঠানে দেখা ও প্রতিফলিত হয়, মানবতার উৎকৃষ্ট আদর্শ উপস্থাপন করে এবং শোকানুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের চ্যালেঞ্জ জানায় যে তারা যেন সাহস, দয়া, ধৈর্য ও দৃঢ়তার মতো গুণাবলী নিজেদের জীবনে প্রকাশের উপায় খুঁজে নেয়।

সবচেয়ে বড় কথা, কারবালার সঙ্গে মুখোমুখি হওয়াযা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শোকানুষ্ঠানে ঘটেএর শেকড় রয়েছে ভালোবাসায়। যেমন কেউ একবার আমাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, যদি আমরা আল্লাহকে ভালোবাসি, তবে আমাদের তাঁদেরকেও ভালোবাসতে হবে যাঁদের আল্লাহ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। মুহাম্মদ (সা.) হচ্ছেন হাবিবুল্লাহ। তাঁর নূরই ছিল আল্লাহর সৃষ্ট প্রথম জিনিস; নিশ্চিতভাবে, যদি আমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাই, তবে আমাদের মুহাম্মদ (সা.)-কে ভালোবাসতে হবে। একইভাবে, যদি আমরা রাসূলকে ভালোবাসি, তবে তাঁদেরকেও ভালোবাসতে হবে যাঁদের তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন: তাঁর কন্যা ফাতিমা (সা.), তাঁর জামাতা ও চাচাতো ভাই ইমাম আলী (আ.) এবং তাঁর নাতি হাসান (আ.) ও হুসাইন (আ.), যারা ছোটবেলায় রাসূল (সা.) নামাজ পড়ার সময় খেলার ছলে তাঁর পিঠে চড়ে বসতো।

যদি আমরা আল্লাহ ও রাসূলকে ভালোবাসি, তবে প্রিয় রাসূলের পরিবারের কষ্টের কথা শুনে কিভাবে আমরা দুঃখিত না হই? এই দুঃখ ভালোবাসার নিদর্শন। যদি আমরা সত্যিই তাঁদের ভালোবাসি, তবে কি আমাদের তাঁদের মতো হওয়ার চেষ্টা করা উচিত নয়? ইমাম হুসাইন (আ.), ইমাম আলী (আ.)-এর পুত্র এবং রাসূল (সা.)-এর নাতি, মানবিক গুণাবলীর এমন এক দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন যা আমাদের সবার অনুসরণ করা উচিত, এবং তাঁর গুণাবলী কারবালার মতো আর কোথাও এত স্পষ্ট নয়।

 

ইকনা: আপনার প্রবন্ধ উত্তর আমেরিকায় শোকানুষ্ঠানের তুলনামূলক বিশ্লেষণ নিয়ে। আপনি কীভাবে দেখেছেন, এই শোকানুষ্ঠানগুলো অমুসলিম পরিবেশে শিয়া মুসলিম অভিবাসীদের ধর্মীয় পরিচয় ও সামষ্টিক ঐক্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে?

শোকানুষ্ঠান অংশগ্রহণকারীদের ইসলাম ধর্মের ইতিহাসের সাথে যেমন যুক্ত করে, তেমনি অভিবাসীরা যে যে অঞ্চল থেকে এসেছে, সেসব অঞ্চলের ঐতিহ্যের সাথেও যুক্ত করে। দক্ষিণ এশিয়া, ইরান এবং আরবদের নিজস্ব অনন্য ঐতিহ্য আছে, যা দিয়ে তারা আহলে বাইতের (আ.) বিপদের প্রতি নিজেদের শোক প্রকাশ করে। কারবালার স্মরণে একত্রিত হওয়া অংশগ্রহণকারীদের এই সুযোগ দেয় যে, তারা কেবল বৃহত্তর মুসলিম সমাজের সাথেবিশেষ করে প্রাথমিক ইসলামের মুসলিমদের সাথেসম্পর্ক স্থাপন করবে না, বরং তাদের নিজ নিজ পৈতৃক ভূখণ্ডের বহুমুখী ও সুন্দর ঐতিহ্যের সাথেও সম্পর্ক বজায় রাখবে।

 

ইকনা: আপনি অভিবাসী সমাজে শোকানুষ্ঠানে স্থানীয় ভাষার ভূমিকার ওপর জোর দেন। এই ভাষাগত বৈচিত্র্য কীভাবে এই আচারগুলোর সহজপ্রাপ্যতা ও আবেগীয় সংযোগ বাড়ায়?

যেমন নামাজের মতো যৌথ ইবাদত মূলত আরবি ভাষায় হয়। এতে জাতি বা ভাষা নির্বিশেষে ঐক্যের অনুভূতি তৈরি হয়। কিন্তু একজন মুসলিম হিসেবে পরিচয় কেবল ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলমানরা তাঁদের ধর্মীয় মূল্যবোধ শিখে থাকেন কাহিনি, সঙ্গীত ও কবিতার মাধ্যমে, যা তাঁদের নিজস্ব ভাষায় পরিবেশিত হয়। নবী, আহলে বাইত বা ওলিয়াদের কাহিনি নিজস্ব ভাষায় বলা ও শোনা স্থানীয় ঐতিহ্যের সাথে ব্যক্তিগত ও গভীর সংযোগ তৈরি করে।

ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শোকানুষ্ঠানের ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় কারবালার কাহিনি বলা [রোজা-খানি] গভীর ও আন্তরিক আবেগীয় সংযোগের সুযোগ দেয়। উর্দুভাষীরা উর্দুতে, ফারসিভাষীরা ফারসিতে কাহিনি বর্ণনা করেন। মুসলমানদের বিভিন্ন মাতৃভাষার কাব্যিক সম্ভাবনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কারবালার কাহিনি বলার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে। তাই উত্তর আমেরিকায় সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ইংরেজি ভাষায় শোকানুষ্ঠান আয়োজনের দিকে একটি ধারা তৈরি হয়েছে, যা যেমন একজন জাকির কয়েক বছর আগে আমাকে বলেছিলেন, ইংরেজিকে একটি ইসলামি ভাষায় রূপান্তর করার সুযোগ দিচ্ছে, যেমন অতীতে উর্দু ও ফারসি করেছিল।

 

ইকনা: আপনার গবেষণায় আপনি কী দেখেছেন, শিয়া সমাজের বাইরেযেমন অমুসলিম বা উত্তর আমেরিকার সুন্নি মুসলিমদের মধ্যেইমাম হুসাইন (আ.)-এর ব্যক্তিত্ব কীভাবে গৃহীত হয়? তাঁর কربালার অবস্থান কি আন্তঃধর্মীয় বা অন্তর্ধর্মীয় বোঝাপড়ার জন্য একটি সেতু হিসাবে কাজ করে?

ইমাম হুসাইন (আ.) কেবল শিয়া মুসলমানদের প্রিয় নন; বরং আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা অধিকাংশ মুসলমানেরবিশেষ করে যারা কোনো না কোনোভাবে সুফি ঐতিহ্যের প্রভাব পেয়েছেএকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। অধিকাংশ মুসলমানের কাছে ইমাম হুসাইন (আ.) পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গণ্য হন এবং বিভিন্ন সুফি তরিকার মধ্যে তিনি বিশেষ মর্যাদা পান। সুন্নি ও শিয়া কবিদের কবিতায় সমানভাবে তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছে।

এছাড়াও, তাঁর প্রদর্শিত গুণাবলী অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিশ্বাসীদের কাছেও গ্রহণযোগ্য। তাই তিনি শুধু ইসলামের জন্য শহীদ নন, বরং মানবতার জন্যও শহীদ। ভারতে কিছু ব্রাহ্মণ আছেন যারা মুহররম অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। ইমাম হুসাইন (আ.) মানবতার সার্বজনীন মূল্যবোধ প্রদর্শন করেন। তিনি তাঁদের জন্য আদর্শ, যারা সহানুভূতি, সাহস, আত্মত্যাগ ও দয়ার মতো গুণাবলীতে বিশ্বাস করেন।

 

ইকনা: ন্যায়বিচার, আত্মত্যাগ ও প্রতিরোধের মূল্যবোধ বিবেচনা করে, আপনার মতে এই বিষয়গুলো আজকের পশ্চিমা সমাজের বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলন বা নাগরিক অধিকার বিতর্কের সাথে কীভাবে সম্পর্কিত?

কারবালায় পাওয়া মূল্যবোধ কেবল ইসলামি নয়, বরং সার্বজনীন মানবিক মূল্যবোধ। প্রতি বছর ইসলামের পরিচিতিমূলক ক্লাসে আমি কারবালার কাহিনির জন্য সময় রাখি; ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সাহস, আব্বাসের বীরত্ব, ইয়াজিদের মুখোমুখি হওয়া জয়নাবের দৃঢ়তা এবং হুরের মহত্ত্বের কথা বলি। আমার ছাত্ররাযাদের বেশিরভাগই অমুসলিম এবং আগে কখনো কারবালার কাহিনি শোনেনিসবসময় তাঁদের অত্যাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধে অনুপ্রাণিত হয়।

হুসাইন (আ.) ন্যায়বিচারের রক্ষক। তিনি মজলুম ও নিপীড়িতদের কণ্ঠস্বর। আমেরিকান ও পশ্চিমা বিশ্বের অন্যদের জন্য, যারা জাতিগত বৈষম্য, স্বৈরাচার, অত্যাচার ও অন্যায় নিয়ে উদ্বিগ্ন, কেবল কারবালায় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আত্মত্যাগ নয়, তাঁর জীবনধারাও একটি উদাহরণ যা যেকোনো ব্যক্তি, যে একটি উন্নততর বিশ্ব ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ খুঁজছে, অনুসরণ করতে পারে।

 

ইকনা: শেষ প্রশ্ন হিসেবে, আপনি যেহেতু শিয়া ধর্মীয় আচার সম্পর্কে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত, আপনার মতে আশুরা দিবসের সার্বজনীন গুরুত্ব কীশুধু শিয়া মুসলমানদের জন্য নয়, বরং মানবিক বিবেকের জন্যও?

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন: প্রতিদিনই আশুরা এবং প্রতিটি স্থানই কারবালা। আমরা মানুষ, যখন মানবতার পূর্ণতা অর্জনের চেষ্টা করি, তখন আমাদের নফসের দ্বারা ক্রমাগত প্রলুব্ধ হই। আমরা ক্ষমতা ও সম্পদ কামনা করি। আমরা প্রলুব্ধ হই অন্যের অধিকার উপেক্ষা করে ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজ করতে। আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে ইয়াজিদ ও ইবনে জিয়াদ রয়েছে। ধনী ও ক্ষমতাশালীরা আমাদের বলে, বিজয়ই চূড়ান্ত লক্ষ্য। বস্তুগত দৃষ্টিকোণ থেকে, ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সাথীরা কারবালায় বিজয়ী হননি। কিন্তু মানবিক ও আধ্যাত্মিক গুণের দৃষ্টিকোণ থেকে, তাঁরা ছিলেন প্রকৃত বিজয়ী। তাঁরা কঠিন পরীক্ষার মুখে তাঁদের মানবতা রক্ষা করেছিলেন। তাঁরা আমাদের দেখিয়েছেন, এমন এক পৃথিবীতে, যেখানে অনেকেই ক্ষমতা বা বস্তুগত স্বাচ্ছন্দ্যের লোভে মানবতা হারিয়েছে, কিভাবে একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে বাঁচতে হয়।

কারবালাকে স্মরণ করার মাধ্যমে, প্রথমে আমাদের উচিত হুসাইন (আ.) ও তাঁর সাথীদের কষ্ট অনুভব ও স্বীকার করা, এবং সেই দুঃখ অনুভব করা যা এই স্মরণের একটি অবশ্যম্ভাবী ফল। এরপর আমাদের জীবনে চেষ্টা করতে হবে তাঁদের সাহস ও দৃঢ়তা অনুসরণ করতে। কারবালা এক অন্যায়পূর্ণ পৃথিবীতে আমাদের হৃদয়ের সাথে কথা বলে। এই কারণেই কারবালা স্মৃতি ১৪০০ বছর ধরে অটুট রয়েছে এবং নিঃসন্দেহে যতদিন মানবজাতি থাকবে, ততদিন অটুট থাকবে। 4296704#

 

captcha