
ইসলামে জমজমের পানি শুধু এক সাধারণ পানীয় নয়; বরং এটি এমন একটি বরকতপূর্ণ ও পবিত্র উৎস, যার মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বহু হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র হজ-ওমরাহ পালনের সময় এই পানি পান করা সুন্নাহ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আর মুসলিম উম্মাহর আধ্যাত্মিক ও শারীরিক উপকারের ক্ষেত্রে এই পানি একটি অমূল্য উৎস।
হাদিসে জমজমের পানি প্রসঙ্গ
১. সর্বোত্তম পানি হিসেবে জমজম
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন:
مَاءُ زَمْزَمَ أَفْضَلُ مَاءٍ عَلَى وَجْهِ الأَرْضِ
‘জমিনের বুকে জমজমের পানি সর্বোত্তম পানি।
’ (তাবরানি, ফিল কাবির, হাদিস : ১১১৬৭; সহিহুত তারগিব ও তারহিব, হাদিস : ১১৬১)
এই বাণী থেকে বোঝা যায় যে, পৃথিবীর সব প্রাকৃতিক পানির উৎসের মধ্যে জমজমের পানি সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও বরকতপূর্ণ। এর বিশুদ্ধতা, স্বাদ ও শারীরিক উপকারিতার কারণে এটি আলাদাভাবে এই অনন্য মর্যাদা পেয়েছে।
২. জমজমের পানি যে উদ্দেশ্যে পান করা হয় তা পূরণ হয়
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন :
مَاءُ زَمْزَمَ لِمَا شُرِبَ لَهُ
‘জমজমের পানি যে উদ্দেশ্যেই পান করা হয়, তা সাধিত হবে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩০৬২)।
এ ছাড়া একই রকম বর্ণনার আরেকটি হাদিস দেখুন-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
«مَاءُ زَمْزَمَ لِمَا شُرِبَ لَهُ فَإِنْ شَرِبْتَهُ تَسْتَشْفِي بِهِ شَفَاكَ اللَّهُ، وَإِنْ شَرِبْتَهُ مُسْتَعِيذًا عَاذَكَ اللَّهُ، وَإِنْ شَرِبْتَهُ لِيَقْطَعَ ظَمَأَكَ قَطَعَهُ»
‘জমজমের পানি সেই উদ্দেশ্যের জন্যই বরকতপ্রাপ্ত হয়, যার জন্য তা পান করা হয়। তুমি যদি তা আরোগ্য লাভের উদ্দেশ্যে পান করো, আল্লাহ তোমাকে সুস্থতা দান করবেন। যদি শরণাপন্ন হওয়ার জন্য পান করো, আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করবেন। আর যদি তৃষ্ণা মেটানোর জন্য পান করো, তা পূরণ হবে।
’
হাদিসটি আরো যেসব সংকলনে এসেছে সেগুলো হচ্ছে- ‘হাদিসটির বিভিন্ন বর্ণনা : মুস্তাদরাক হাকীম (৩৯৩২)-এ বর্ণিত, হাকীম এই হাদিসটিকে বুখারি ও মুসলিমের মানদণ্ডে সহিহ বলেছেন। ইবনে মাজাহ সংকলনে ৩০৬৯ হাদিসে জমজম পানির বরকত উল্লেখ রয়েছে। আহমদ ইবনে হাম্বলের মুসনাদে (মুসনাদ আহমদ, ৩/২২০) জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত এই হাদিসটি পাওয়া যায়।’
এসব হাদিস প্রমাণ করে যে এই পানি আত্মিক ও শারীরিক দুই ক্ষেত্রেই আল্লাহর বরকতের প্রতীক। যেকোনো উদ্দেশ্যে যদি বিশ্বাস ও নিষ্ঠার সঙ্গে এই পানি পান করা হয়, আল্লাহ তা পূরণ করেন।
৩. বরকতময় ও খাবারের উপাদানসমৃদ্ধ পানি
আবু জর গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন :
إِنَّهُ بَرَكَةٌ وَمَاءٌ طَعَامٌ
‘নিশ্চয়ই তা বরকতময় এবং খাবারের উপাদানসমৃদ্ধ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৪৭৩)
এখানে স্পষ্ট যে জমজম পানি শুধু পানীয় নয়, এতে এমন পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা শরীরের পুষ্টি জোগাতে সক্ষম। আল্লাহ তায়ালা এই পানি বরকতপূর্ণ করেছেন, যা শরীর ও মন উভয়কেই শক্তি ও প্রশান্তি দেয়।
৪. রোগ নিরাময়ের শিফা
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন :
إِنَّهُ طَعَامٌ شِفَاءٌ
‘নিশ্চয়ই তা সুখাদ্য খাবার এবং রোগের শিফা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৪৭৩)
জমজমের পানিতে রয়েছে এমন গুণ, যা বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির নিরাময় সাধনে সাহায্য করে। মহানবী (সা.) নিজেও এই পানিকে নিরাময় হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছেন।
৫. জমজমের পানি বহন ও সংরক্ষণ
عَنْ عَائِشَةَ رضي الله عنها قَالَتْ: كَانَتْ تَحْمِلُ مَاءَ زَمْزَمَ، وَكَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَحْمِلُهُ
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি জমজমের পানি বহন করতেন এবং বলেন : ‘রাসুল (সা.)ও জমজমের পানি বহন করতেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৯৬৩)
এ থেকে বোঝা যায়, প্রাচীনকাল থেকে মুসলিমরা জমজমের পানিকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে তা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতেন।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জমজমের পানির উপকারিতা
বিগত কয়েক দশকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, জমজমের পানি অন্য পানির তুলনায় অনেক বেশি খনিজসমৃদ্ধ ও জীবাণুমুক্ত। এর পিএইচ মান ৭.৫ থেকে ৮.০, অর্থাৎ এটি ক্ষারীয়, যা দেহের অম্ল-ক্ষার ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে (Al-Jazairi et al., 2008)। এ ছাড়া এতে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম, পটাসিয়াম ইত্যাদি রয়েছে, যা শরীরের হাড়, পেশি ও স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা উন্নত করে (Al-Khalifa et al., 2009)। জমজমের পানির বিশুদ্ধতা এতটাই যে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করলেও তা নষ্ট হয় না (Al-Khalifa & Al-Howiriny, 2002)।
ফিক্বহি বিধান ও ব্যবহার
ফিকাহের আলোকে জমজম পানি অজু, গোসলসহ দৈনন্দিন পানির ব্যবহার হিসেবে গ্রহণযোগ্য ও প্রাধান্যপ্রাপ্ত। তবে নাজাসাত পরিষ্কারক হিসেবে ব্যবহার করতে বারণ রয়েছে, কারণ এতে পানির মর্যাদা কমে যেতে পারে। তবে যদি অন্য পানি না থাকে, তখন ব্যবহারে অসুবিধা নেই।
জমজমের পানি আল্লাহর এক বিশেষ বরকতপূর্ণ সৃষ্টি, যা শরীর ও আত্মার পক্ষে কল্যাণকর। মহানবী (সা.)-এর হাদিসসমূহে এর গুরুত্ব স্পষ্ট এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণাও এর গুণাবলি প্রমাণ করেছে। মুসলমানদের উচিত এই পানির মর্যাদা বুঝে শ্রদ্ধা ও ভক্তিসহকারে গ্রহণ করা এবং প্রয়োজনমতো ব্যবহার করা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক মুফতি সাইফুল ইসলাম