IQNA

হাঙ্গেরিতে মুসলিম শাসনের স্মৃতিচিহ্ন

17:34 - September 11, 2022
সংবাদ: 3472439
তেহরান (ইকনা): প্রতাবশালী উসমানীয় শাসক সুলতান সুলাইমান হাঙ্গেরি জয় করেন। ১০ সেপ্টেম্বর ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দে হাঙ্গেরির শাসকদের পরাজিত করে উসমানীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। আধুনিক হাঙ্গেরির দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের বেশির ভাগ ভূমি উসমানীয়দের শাসনাধীন হয়। মুসলিমরা মোট ১৫০ বছর হাঙ্গেরি শাসন করে।
উসমানীয়-হাবসবার্গ যুদ্ধে উসমানীয়দের পতনের মাধ্যমে এই শাসনের অবসান ঘটে। এই যুদ্ধে উসমানীয়দের বিরুদ্ধে ইউরোপের খ্রিস্টান শাসকরা ‘হলি লীগের’ অধীনে একতাবদ্ধ হয়। ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দের কার্লোভিৎস চুক্তির মাধ্যমে হাঙ্গেরিকে তাদের ভূমি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সংক্ষিপ্ত এই শাসনামলে উসমানীয়রা হাঙ্গেরির জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রাখে। তারা প্রশাসনকে ঢেলে সাজায়, অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করে এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
প্রশাসন : উসমানীয়রা হাঙ্গেরির নাম দেয় মাদজারিস্তান। তারা হাঙ্গেরিকে বুদা ও তিমিসবার নামে দুটি প্রদেশে বিভক্ত করে। প্রতিটি প্রদেশে ছিল ১২টি করে জেলা। সপ্তদশ শতাব্দীতে আরো কিছু অঞ্চল বিজয় করলে ইগার ও কানিজসা নামে আরো দুটি প্রদেশ সৃষ্টি করে। সুলতানের নিয়োগপ্রাপ্ত একজন পাশা প্রদেশের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। প্রশাসনিক ও সামরিক কাঠামোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে তুর্কি হাঙ্গেরিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করে। স্থানীয় প্রশাসকরা প্রায় স্বাধীনভাবেই রাজ্য পরিচালনা করতেন।
 
ভূমি জরিপ ও নববিন্যাস : উসমানীয় বাহিনী হাঙ্গেরি জয় করার পরপরই সেখানে বিজ্ঞানভিত্তিক ও বিস্তারিত ভূমি পরিচালনা করে। এর ভিত্তিতে ভূমির নববিন্যাস করে। এর ভেতর ২০ শতাংশ ভূমি খাস হিসেবে সুলতান ও স্থানীয় প্রদেশের অধীনে রাখা হয়। ১০ শতাংশ ভূমি প্রদেশের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনিক অবকাঠামো নির্মাণের জন্য রাখা হয়। অবশিষ্ট ভূমি স্থানীয়, সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে কর্মরতদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। এ ছাড়া  জনকল্যাণে কিছু ভূমি ওয়াকফ করা হয়েছিল।
 
স্থানীয়দের সংযুক্তি : উসমানীয়রা স্থানীয় প্রশাসন, কর ও কৃষি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে হাঙ্গেরিয়ানদের যুক্ত করে। একইভাবে উসমানীয় সৈনিকদের হাঙ্গেরীয় ভাষা শেখার নির্দেশ দেয়। এর সবই করা হয়েছিল স্থানীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন, তাদের জীবনযাত্রার মান ও দেশের আর্থিক অবস্থা স্থিতিশীল রাখার জন্য।
 
বিচারকাজে আলেমদের অংশগ্রহণ : পাশাদের পাশাপাশি প্রত্যেক প্রদেশে একজন মুফতি ও কাজি নিযুক্ত করা হতো। তাঁরাই মূলত সুলতানের ধর্মীয় ও বিচার বিভাগীয় প্রতিনিধি ছিলেন। তাঁরাই বিচারকের দায়িত্ব পালন করতেন। চূড়ান্ত ফায়সালা দিতেন প্রধান মুফতি। তিনি শুধু মুসলিমদের বিষয়ে ফায়সালা দিতেন না, বরং সবার ব্যাপারেই ফায়সালা দিতেন। এ জন্য হাঙ্গেরিতে কারো মুফতি পদে নিয়োগের পূর্বশর্ত ছিল ইসলামী আইনের পাশাপাশি খ্রিস্ট আইন সম্পর্কেও প্রাজ্ঞ হওয়া। সামরিক ও প্রশাসনিক প্রধানদের বাইরে প্রত্যেক প্রধান শহরে কাজি ও মুফতি নিয়োগের উদ্দেশ্য ছিল ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
 
অভিনব রাজস্বব্যবস্থা : প্রদেশের আদায়কৃত রাজস্ব ও ভূমিকরের একাংশ স্থানীয় দরিদ্রদের জীবনমান বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হতো। দরিদ্র কৃষকদের থেকে কর আদায়ে বিশেষ ছাড় দেওয়া হতো। ইসলামী রাজস্ব আইন অনুসারে কৃষি ফসলের ১০ ভাগের এক ভাগ কর আদায়ের নিয়ম থাকলেও দরিদ্রদের কাছ থেকে নেওয়া হতো ৩০ ভাগের এক ভাগ। ব্যবসায়ী কাফেলা থেকে আদায়কৃত কর ছিল হাঙ্গেরিতে উসমানীয়দের আয়ের বড় একটি উৎস। এই কর যেমন তারা আদায় করত, তেমন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কিছু বাণিজ্যিক পথও সৃষ্টি করে উসমানীয়রা। এসব পথের ধারে ছোট-বড় বেশ কিছু বাজার সৃষ্টি করা হয়, যা স্থানীয় অর্থনীতিতেও অবদান রাখে। এ ছাড়া উসমানীয়রা হাঙ্গেরির কৃষি ও সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নে ভূমিকা রাখে এবং গবাদি পশু পালন ও পোশাক উৎপাদন বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
 
হাঙ্গেরিতে মুসলিম শাসনের স্মৃতি : আধুনিক হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট শহর, যার পূর্ব নাম বুদা ছিল সেটিই ছিল উসমানীয় শাসনের প্রাণকেন্দ্র। শহরটিকে উসমানীয়রা নিজেদের মতো করে ঢেলে সাজায়। যদিও বুদা শহরে উসমানীয় আমলেও হাঙ্গেরিয়ানরা ছিল। তবু এই শহরের বেশির ভাগ অধিবাসী ছিল তুর্কি। তাদের মধ্যে ছিল তুর্কি সৈনিক, কারিগর, ব্যবসায়ী, ধর্মীয় নেতা, দোকানদার, কর্মচারী ও দাস। দীর্ঘ দেড় শ বছরের এসব লোকেরা বহু কীর্তি ও স্মৃতি রেখে গেছেন হাঙ্গেরিতে। এখন পর্যন্ত হাঙ্গেরিতে মুসলমানের যেসব স্মৃতিচিহ্ন টিকে আছে তার মধ্যে মসজিদ, সমাধিসৌধ, কবরস্থান ও হাম্মাম (গোসলখানা) উল্লেখযোগ্য।
 
উসমানীয় আমলে হাঙ্গেরিতে শত শত ইসলামী স্থাপত্য গড়ে উঠেছিল। কিন্তু পারস্পরিক যুদ্ধ, ধর্মীয় বিদ্বেষ, নির্মাণসামগ্রী ও সংস্কারের অভাব ইত্যাদি কারণে ইসলামী স্থাপত্যগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে আর কিছু মসজিদ গির্জায় পরিণত করা হয়েছে। এখন ১০টিরও কম তুর্কি স্থাপত্য সেখানে টিকে আছে। টিকে থাকা স্থাপত্যগুলোর মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম হাঙ্গেরির শহর পেকসেতে অবস্থিত পাশা কাসিম মসজিদ সর্ববৃহৎ। মসজিদটি খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত।
 
হাম্মাম ছিল তুর্কিদের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংযোজন। হাম্মাম বা গোসলখানাগুলো ছিল অত্যন্ত স্বাস্থ্যসম্মত। বুদার উসমানীয় গভর্নর সুকুল্লু মোস্তফা পাশা শহরে ১৬টি আধুনিক গোসলখানা নির্মাণ করেন, যার মধ্যে তিনটি এখনো টিকে আছে। সম্প্রতি তুর্কি সরকার হাঙ্গেরিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম স্থাপনাগুলো সংস্কারে অর্থায়ন করছে। বিশেষত হাঙ্গেরির সিগেটবার শহরের একাধিক খননকাজে অর্থায়ন করেছে তারা। এই শহরে ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সুলাইমান ইন্তেকাল করেন।
 
জনজীবনে মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাব : যদিও তুর্কিরা হাঙ্গেরিতে মাত্র দেড় শ বছর শাসন করেছিল এবং এরপর প্রায় সাড়ে তিন শ বছর অতিবাহিত হয়েছে, তার পরও হাঙ্গেরির জনজীবনে মুসলিম শাসনের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে খাদ্যাভ্যাসে। তুর্কিদের খাদ্যাভ্যাস ছিল অধিক স্বাস্থ্যসম্মত। যেমন—হাঙ্গেরির একটি জনপ্রিয় খাবার বাঁধাকপিতে প্যাঁচানো কিমা। এটি তুর্কিদের উদ্ভাবিত। একইভাবে উসমানীয়রা হাঙ্গেরিয়ানদের খাদ্যতালিকায় কফি, কাদারকা আঙুরের প্রজাতি, মরিচ, ভুট্টাসহ বিভিন্ন খাদ্য ও মসলা যুক্ত করেছিল।
 
তথ্যঋণ : প্রবন্ধ : দ্য মাদজারিস্তান : অটোমানস
 
ইন হাঙ্গেরি; দ্য অটোমান লিগ্যাসি ইন হাঙ্গেরি : বাথ অ্যান্ড ফুড মোস্টলি
captcha