IQNA

পরিস্থিতি ভয়াবহ: গাজা ঘুরে বিবিসি সাংবাদিকের মর্মস্পর্শী বর্ণনা

15:48 - May 26, 2025
সংবাদ: 3477442
ইকনা- ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন শিশু। তাদের চোখে-কানেও যেন কোনো অনুভূতি নেই। ক্যামেরার দিকে তাকানোরও আগ্রহ নেই তাদের। কারণ, এদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ায় মৃত্যু, ক্ষুধা আর অসহায়ত্ব।
এতসব দেখে-দেখে অবাক হওয়ার ক্ষমতাও যেন হারিয়ে ফেলেছে তারা।
গাজার শিশুদের নিয়ে এক মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন লিখেছেন সাংবাদিক ফারগাল কিয়ানি। তিনি লিখেছেন, বিবিসির হয়ে কাজ করা আমার সহকর্মী এবং তার ক্যামেরার উপস্থিতি তারা অনেক আগেই স্বাভাবিকভাবে নিতে শিখেছে। 
 
ক্ষুধায় কাতর এই শিশুরা জানে, লাইনে দাঁড়িয়েও হয়তো কিছুই পাবে না।
 
 
তবু ক্ষীণ আশায় দাঁড়িয়ে থাকে, সামান্য কিছু রেশন মিলবে এই আশায়। একজন স্থানীয় ক্যামেরাম্যান, যিনি বিবিসির জন্য ছবি তুলছেন, এই শিশুদের বারবার দেখে এসেছেন। তার ক্যামেরায় ধরা পড়ে শিশুর ক্ষুধা, কখনও তাদের মৃত্যু, কখনও কাফনে মোড়া নিথর দেহ। কখনও শরীরের কোনো অংশই অবশিষ্ট থাকে না।
 
নিরাপত্তার স্বার্থে তার নাম প্রকাশ করা হয়নি।
উনিশ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধের মধ্যে তিনি হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অসংখ্য কান্না শুনেছেন। কাছ থেকে না দেখলেও, সেই কান্না আজও তার কানে বাজে। কারণ তিনিও এদের মতোই গাজার সেই দমবন্ধ অবস্থার এক বন্দি।
 
আজ সকালে তিনি খোঁজ করছিলেন মাত্র পাঁচ মাস বয়সী সিওয়ার আশৌরের।
 
খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে সে একদিন খুব কেঁদেছিল — সেই কান্না এই ক্যামেরাম্যানের হৃদয় ছিঁড়ে দিয়েছিল। সিওয়ারের ওজন তখন ছিল মাত্র দুই কেজির একটু বেশি, অথচ এই বয়সে ওজন হওয়া উচিত ছয় কেজির মতো।
জানা গেছে, কিছুদিন আগে সিওয়ারকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সেই তথ্য পেয়ে ক্যামেরাম্যান যান আল-মাওয়াইসি শরণার্থী শিবিরে। বিশৃঙ্খলার মধ্যে, কোনো এক খুপরি ঘরে খুঁজে পান সিওয়ারকে — মায়ের কোলে, নানির পাশে।
 
সিওয়ার শান্ত ছিল। কিন্তু দুধ হজম করতে পারে না সে, অ্যালার্জির কারণে। প্রয়োজনীয় শিশু ফর্মুলাও নেই আশেপাশে, যুদ্ধ ও অবরোধের কারণে। তার মা, ২৩ বছর বয়সী নাজওয়া জানান, নাসের হাসপাতালে কিছুটা উন্নতি হয়েছিল সিওয়ারের। সেখান থেকে এক ক্যান দুধ দিয়ে ছেড়ে দেয় চিকিৎসকেরা। সেটিও এখন প্রায় শেষ।
 
নাজওয়া বলেন, ‘সিওয়ার আগের চেয়ে ভালো আছে বলেছে ডাক্তার, কিন্তু আমি বুঝি — ওর অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। মাছি ওর মুখে বসে, আমি স্কার্ফ দিয়ে ঢেকে রাখি।’
 
নভেম্বরে জন্ম নেওয়া এই শিশু যুদ্ধই দেখেছে জন্মের পর থেকে। গুলির শব্দ, বোমা, ড্রোন — এসবের মধ্যেই বেড়ে উঠছে সে। মায়ের ভাষায়, ‘ও বোঝে — ট্যাংক, রকেটের শব্দ ওকে ভয় পাইয়ে দেয়। ও কাঁদতে শুরু করে, ঘুম ভেঙে চমকে ওঠে।’
 
চিকিৎসকরা বলছেন, অপুষ্টিতে ভোগা মায়েরা অনেক সময় শিশুদের বুকের দুধও দিতে পারছেন না। খাবার ও পানিই এখন সবচেয়ে বড় সংকট। নাজওয়ার কথায় উঠে আসে সেই বাস্তবতা — ‘আমার ও আমার মায়ের জন্য খাবার জোগাড় করাও কঠিন। সীমান্ত বন্ধ, সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। দুধ আর ডায়াপার কেনারও সামর্থ্য নেই।’
 
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, গাজায় কোনো খাদ্য সংকট নেই। কোগাট নামের তাদের সামরিক দপ্তর জানায়, প্রচুর পরিমাণ শিশু খাদ্য ও ময়দা সম্প্রতি গাজায় পৌঁছেছে। তারা আবার অভিযোগ করছে, হামাস এসব ত্রাণ চুরি করছে। অন্যদিকে, ইসরায়েল বলছে, হামাস ধ্বংস ও সব জিম্মি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে।
 
ইসরায়েলের দাবি, অন্তত ২০ জন জিম্মি এখনো জীবিত, আর ৩০ জনের বেশি মারা গেছেন। তবে জাতিসংঘ, ব্রিটেনসহ অনেক দেশই ইসরায়েলের এসব দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্পও গাজার ক্ষুধার্ত মানুষদের অবস্থা তুলে ধরেছেন।
 
জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন, ইসরায়েল যে সহায়তা ঢুকতে দিচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় ‘চা চামচের’ মতো। খাবার, পানি, জ্বালানি, আশ্রয় — কিছুই নেই পর্যাপ্ত। গাজাবাসীরা এখন এক নিষ্ঠুর যুদ্ধের নিষ্ঠুরতম পর্যায়ে।
 
জাতিসংঘের তথ্যে, গাজার ৮০ শতাংশ অঞ্চল এখন হয় সামরিক জোন, নয়তো খালি করার নির্দেশ দেওয়া এলাকা। যুদ্ধের গতিপথ বারবার মোড় নিচ্ছে, আসছে নতুন বাঁক, নতুন ঘোষণা, নতুন আলোচনা। কিন্তু অপরিবর্তিত রয়ে গেছে নাজওয়া আর তার মেয়ে সিওয়ারের মতো মানুষদের দুর্ভোগ। 
 
নাজওয়া বলেন, ‘কেউ এখন ভবিষ্যৎ বা অতীত নিয়ে ভাবে না। সবার দৃষ্টি শুধু এখনকার দিকেই — কীভাবে আজ আরেকটা দিন বাঁচব।’
 
সূত্র : বিবিসি
captcha