IQNA

আসগর ফুরুঘি-আবরির সাথে ইকনা-র সাক্ষাৎকার:

" আশুরার শোকানুষ্ঠান ছাড়া শিয়া মাজহাব কল্পনা করা যায় না"

8:35 - July 16, 2025
সংবাদ: 3477711
ইকনা “ইরানিয়ান ও আশুরার শোকানুষ্ঠান” বইটির লেখক উল্লেখ করেছেন যে, আশুরার শোকানুষ্ঠান ছাড়া চিন্তাশীল ও বিশ্বাসভিত্তিক শিয়া মতবাদ কল্পনা করা যায় না। তিনি বলেন, আশুরার শোকানুষ্ঠান কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি একটি বিদ্যালয় — যা মানুষকে মানবতা, ত্যাগের মানসিকতা, ধৈর্য, সামাজিক সংহতি এবং আত্মিক আনন্দের শিক্ষা দেয়। আর যদি এই অনুষ্ঠান সেইসব দিকসহ, যেভাবে তা আহলে বাইতের (আ.) পক্ষ থেকে পরিকল্পিত ও শেখানো হয়েছে, সঠিকভাবে পালন করা হয়, তাহলে তা এই দেশটির সংরক্ষণ ও টিকে থাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠবে।

আশুরার শোকানুষ্ঠান ও মুহাররম মাসে পালিত শোকানুষ্ঠানসমূহ এবং কারবালার ঘটনার স্মরণে আয়োজিত কার্যক্রমগুলো ইরানিয়ান সংস্কৃতি ও পরিচয়ের মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই অনুষ্ঠানগুলো ইরানের সর্বত্র ব্যাপকভাবে পালিত হয়ে আসছে এবং এগুলোর ধর্মীয় ও আত্মিক দিক ছাড়াও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও এমনকি রাজনৈতিক দিক থেকেও তা বিশ্লেষণযোগ্য।

সময়ের পরিবর্তনে সমাজ ও সংস্কৃতির চলমান পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এই অনুষ্ঠানের মূল তাৎপর্য ও বিশুদ্ধতা সংরক্ষণ করাটাও একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বহু গবেষণা ও অধ্যয়ন এই অনুষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণের জন্য পরিচালিত হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি গ্রন্থ হলো ইরানিয়ান ও আশুরার শোকানুষ্ঠান

এই গ্রন্থটির লেখক আসগর ফোরুঘি আবরি, যিনি ইরানে ধর্মীয় সংস্কৃতি ও ধর্মীয় আচারানুষ্ঠানের একজন বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক। তিনি বহু বছর ধরে এই শোকানুষ্ঠানগুলোর আচারিক ও ঐতিহাসিক দিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এবং আধুনিক যুগে এর চ্যালেঞ্জ নিয়ে তাত্ত্বিক ও মাঠপর্যায়ের গবেষণা চালিয়ে আসছেন।

এই গবেষণার ফলাফল হিসেবে লেখা এই বইটিতে, একটি বিশ্লেষণাত্মক ও সমস্যাভিত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইরানে শোকানুষ্ঠানের উৎস ও ইতিহাস ব্যাখ্যা করা হয়েছে, শহর ও গ্রামের বর্তমান বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে এবং এতে থাকা সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো আলোকপাত করা হয়েছে। বইটিতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, আশুরার অনুষ্ঠান কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো যা নৈতিক গুণাবলীসম্পন্ন, ত্যাগী ও ন্যায়প্রিয় মানুষ গড়ে তোলে। তাই এই বিশাল সম্ভাবনাকে ব্যক্তি ও সমাজের উৎকর্ষ সাধনের কাজে ব্যবহার করা উচিত।

 

ইকনা: আপনি কেন ইরানিয়ান ও আশুরার শোকানুষ্ঠানবই লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন?

রুঘি-আবরি: আশুরার শোকানুষ্ঠান ইরানি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। শত শত বছর ধরে তা মানুষের মনে গেঁথে গেছে, ধর্মীয়, জাতিগত বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে। অনেক চেষ্টা হয়েছে এ ঐতিহ্যকে দুর্বল করতে, কিন্তু সফলতা আসেনি। এর মূল কারণ হলো আশুরার শোকানুষ্ঠান ইরানি জাতিসত্তা ও বৈশিষ্ট্য রক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

এই সংস্কৃতি ছিলই ইরানিদের প্রতিবাদ ও ন্যায়ের জন্য লড়াইয়ের মূল প্রেরণা। এটি কেবল ইসলামিক যুগের নয়, ইসলামপূর্ব যুগেও ইরানিরা আধ্যাত্মিকতার প্রতি অনুরাগী ছিল। ইসলাম গ্রহণ করার পর ইরানিরা সেই ঐশী বিশ্বাসকে নিঃস্বার্থভাবে গ্রহণ করে পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতায় এক অনন্য রূপ দেয়।

কনা: আশুরার শোকানুষ্ঠানের এমন কী বৈশিষ্ট্য আছে যা এটিকে ইরানে বিশেষ করে তোলে?

রুঘি-আবরি: ইরানে আশুরার শোকানুষ্ঠান কেবল আবেগনির্ভর অনুষ্ঠান নয়, বরং একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটি মানুষের আত্মশুদ্ধি, মানবতা, ত্যাগ, সামাজিক সংহতি ও আধ্যাত্মিক প্রেরণার উৎস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শোকানুষ্ঠান হয়, তবে তা অনেক সময় স্থানীয় সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মূল শিক্ষার বার্তা থেকে দূরে চলে যায়। অনেক দেশে এসব অনুষ্ঠান কেবল আবেগে ভরপুর ও কখনও সহিংসতায় রূপ নেয়, যা ইমামদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল না।

ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর আশুরার বার্তা আরও পরিশীলিত ও সচেতনভাবে উপস্থাপন শুরু হয় এবং এখন তা বিশ্বের অনেক শিয়া সমাজের জন্যও মডেল হয়ে উঠেছে।

কনা: আশুরার শোকানুষ্ঠানের ঐতিহাসিক পরিবর্তনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কী ছিল?

রুঘি-আবরি: সবচেয়ে বড় মোড় এসেছে সাফাভি শাসনামলে, যখন শিয়া মাযহাবকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর ফলে, আশুরার অনুষ্ঠান দেশব্যাপী বিস্তৃত হয়। শোকানুষ্ঠানগুলো কেবল শোকপ্রকাশ নয়, বরং সাধারণ মানুষের মাঝে শিক্ষার মাধ্যম হয়ে উঠেছেবিশেষ করে সেই সময়, যখন অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর ছিল। ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর পরিবারের শাহাদাত মানুষকে আত্মত্যাগ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শিক্ষা দিয়েছে।

কনা: এই অনুষ্ঠানের সামাজিক ও মানসিক প্রভাব কীভাবে বিশ্লেষণ করেছেন?

রুঘি-আবরি: এটি এক ধরনের মানসিক বিশ্রাম এবং আত্মার পরিশুদ্ধি। শোক, কান্না, ও বুক চাপড়ানো দেখে মনে হতে পারে এটি বিষণ্নতা বাড়ায়, কিন্তু বাস্তবে এটি গভীর প্রশান্তি দেয়। মানুষ জীবনের দুঃখ-কষ্টগুলো এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশ করে এবং পরে মানসিক ভারমুক্ত হয়।

এছাড়া এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠান। সমাজের মানুষ একত্রিত হয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা, ভালোবাসা ও একাত্মতার বার্তা ভাগ করে নেয়। নারীদের অংশগ্রহণও এখানে বিশাল গুরুত্ব বহন করেতাঁরাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে এই সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেন।

কনা: বর্তমান সময়ে আশুরার শোকানুষ্ঠান কী কী চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে?

ফোরুঘি-আবরি: প্রধান সমস্যা হলো অনুষ্ঠানকে কেবল আবেগ দিয়ে সীমাবদ্ধ করে ফেলা। অনেক সময় মাওলানা, বক্তা বা মদ্দাহগণ সমাজের বাস্তব সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন বক্তব্য দেন। ফলে অনুষ্ঠান মানুষকে কেবল সাময়িক আবেগ দেয়, স্থায়ী পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়।

আরেকটি বড় সমস্যা পরিকল্পনার অভাবএই অনুষ্ঠান শুধু মোহররমে নয়, সারা বছর একটি শিক্ষামূলক প্রক্রিয়া হওয়া উচিত। শোকের পাশাপাশি চিন্তা ও আত্ম-উন্নয়নমূলক বার্তাও প্রচার করতে হবে।

সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, অনুষ্ঠানকে শুধু শোকানুষ্ঠাননা বানিয়ে এটিকে একটি চিন্তাশীল আন্দোলনে রূপান্তরিত করা, যার মাধ্যমে সমাজের সমস্যাগুলোর সমাধান খোঁজা সম্ভব হয়।

কনা: সরকার বা শাসকদের ভূমিকা কীভাবে দেখেন?

রুঘি-আবরি: ইতিহাসে দেখা যায়, বেশিরভাগ শাসকই আশুরার অনুষ্ঠানের প্রতি সম্মান রেখেছেন বা সরাসরি সমর্থন দিয়েছেন। সাফাভিরা এটিকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আনেন, কাজার আমলে "তাকিয়া দৌলত" প্রতিষ্ঠিত হয়। কেবলমাত্র পাহলভি আমলে কিছুটা বাধা আসে, কিন্তু সাধারণ মানুষের সংস্কৃতিমনা দৃঢ়তা সে বাধাকে প্রতিহত করে।

কনা: শেষ কথা?

রুঘি-আবরি: শোকানুষ্ঠান ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শিক্ষাকে বিশ্বব্যাপী পৌঁছানোর একটি মাধ্যম। খ্রিস্টান লেখক আন্তোন বারা বলেছেন, "ইমাম হুসাইন (আ.) কেবল শিয়াদের নয়, পুরো মানবজাতির নেতা।" আমরা যদি এই অনুষ্ঠানকে প্রকৃত শিক্ষা ও সামাজিক রূপান্তরের হাতিয়ার বানাতে পারি, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান নিজেরাই করতে পারবো। 4294193#

 

সাক্ষাৎকারগ্রহীতা: মুজতবা আফশার
মূল লেখক ও গবেষক: আসগার ফরুঘি-আবরি
বই: ইরানিয়ান এবং আজাদারী আশুরা

 

captcha