
ইতিহাসের এক দীর্ঘ অধ্যায়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তার উপনিবেশগুলোকে সামরিক কৌশলে ব্যবহার করেছে নিখুঁত দক্ষতায়। সেই সামরিক কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল নৌবাহিনী—যা উপনিবেশ দখল, দমন এবং শাসনে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই নৌবাহিনীতে ভারতীয় মুসলমানদের অংশগ্রহণ যেমন বিস্ময়কর, তেমনি ছিল একপ্রকার নিঃশর্ত আনুগত্যে পূর্ণ। প্রবন্ধে আলোচিত হবে ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে মুসলিম সেনাদের সংখ্যা, তাদের ভূমিকা, আনুগত্য এবং তার অন্তর্নিহিত সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য।
মুসলিম নাবিকদের যোগদানের প্রেক্ষাপট
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি উপমহাদেশে নিজেদের সামরিক ও প্রশাসনিক ভিত মজবুত করতে শুরু করে। তখনই গঠিত হয় Bombay Marine, যা পরবর্তী সময়ে Indian Navy নামে পরিচিত হয়। এই নৌবাহিনীতে মুসলিমদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে নিয়োগ দেওয়া হতো। কারণ ছিল বহুস্তরীয়— আরব ও বাঙালি মুসলমানদের ঐতিহ্যগত সমুদ্রবাণিজ্য ও নৌচালনায় দক্ষতা, ইসলামী অনুশাসনে কর্তব্যপরায়ণতা এবং সামন্তবাদী সমাজে ‘বাদশাহর প্রতি আনুগত্য’ ধারণার প্রভাব।
(Charles Rathbone Low, History of the Indian Navy (1613–1863), London, 1877)
সংখ্যাগত চিত্র ও নিয়োগের ধরন
নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া দুষ্কর হলেও ব্রিটিশ সামরিক রেকর্ড অনুযায়ী ১৮৫০-এর দশকে Bombay Marine-এ ভারতীয়দের মধ্যে প্রায় ৪০% ছিলেন মুসলমান। (British Library, India Office Records, IOR/MIL/17)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে Royal Indian Navy-তে মুসলমানদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ে। ১৯৩৯ সালে মোট ১,৭০০ নাবিকের মধ্যে ৩০-৪০% মুসলিম ছিলেন এবং ১৯৪৫ সালে সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৮,০০০–৯,০০০।(David Omissi, The Sepoy and the Raj: The Indian Army, 1860–1940, Macmillan, 1994)
মুসলমানরা মূলত দায়িত্ব পালন করতেন stoker, engine fitter, signalman এবং technical ratings হিসেবে।
করাচি, বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই), হুগলি, চট্টগ্রাম—এই অঞ্চলগুলো মুসলিম নাবিক নিয়োগে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছিল।( Ibid)
ব্রিটিশদের তথাকথিত ‘Martial Race Theory’ অনুসারে মুসলিমদের সাহসী, বিশ্বস্ত এবং সামরিক অনুগত হিসেবে বিবেচনা করা হতো।(Tan Tai Yong, The Garrison State: Military, Government and Society in Colonial Punjab, Sage, 2005)
বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের প্রেক্ষাপট
ব্রিটিশদের কাছে মুসলিম সেনারা দীর্ঘকাল ধরে “loyal and obedient” বলে গণ্য হতো। এর পেছনে কয়েকটি ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ ছিল—
এক. ইসলামী শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধ
মুসলিমদের নৈতিকতা শিক্ষায় কোরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন—
وَلَا تَبْخَسُوا النَّاسَ أَشْيَاءَهُمْ
‘মানুষের প্রাপ্য হক কম দিয়ে দিয়ো না।’ (সুরা : হুদ, আয়াত : ৮৫)
আর রাসুল (সা.) বলেন :
كُلُّكُمْ رَاعٍ وَكُلُّكُمْ مَسْؤُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ
‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল; এবং দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
’ (বুখারি, হাদিস : ৮৯৩)
এই চেতনা মুসলমানদের কর্তব্যপরায়ণতা বাড়াত।
দুই. ধর্মীয় স্বাধীনতা
নৌঘাঁটিতে মুসলিমদের হালাল খাদ্য, রমজানে রোজা রাখা এবং জুমার নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা ছিল। (British Library Archives – Royal Indian Navy Regulations)
তিন. অর্থনৈতিক উত্তরণ ও সামাজিক সম্মান
ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে চাকরি মানেই ছিল সম্মানজনক পেশা, যা মুসলমানদের জন্য ঔপনিবেশিক দারিদ্র্যের প্রেক্ষাপটে আকর্ষণীয় ছিল। (Omissi, The Sepoy and the Raj, Chapter 3)
ব্যতিক্রম : ১৯৪৬ সালের নৌবিদ্রোহ
দীর্ঘকাল ধরে মুসলিম সেনারা আনুগত্য পালন করলেও ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে এই চিত্র বদলে যায়। ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় Royal Indian Navy Mutiny—যা করাচি, মুম্বাই, চট্টগ্রামসহ ৭৮টি জাহাজ এবং স্থলঘাঁটিতে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিদ্রোহে প্রায় ২০,০০০ নাবিক অংশগ্রহণ করেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিলেন মুসলিম। তবে হিন্দু সৈন্যরাও এতে যোগ দেওয়ার কথা অনেকেই বর্ণনা করেছেন। (Ravi Ahuja, The Royal Indian Navy Mutiny, 1946 : Nationalism and Revolt Across the Empire, Modern Asian Studies, Vol. 37)
বিদ্রোহের মূল কারণ
• নিম্নমানের খাদ্য ও বেতন
• জাতিগত বৈষম্য
• ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাবে রাজনৈতিক সচেতনতা
এই বিদ্রোহে মুসলিম ও হিন্দু উভয়ের অংশগ্রহণ ছিল সমানভাবে, যা দেখায় যে রাজনৈতিক সচেতনতা ধর্মীয় আনুগত্যকে ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেছিল। এই বিদ্রোহ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের কাছে ছিল এক বড় ধাক্কা।
ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে মুসলিম সেনারা একদিকে ছিলেন কর্তব্যপরায়ণ, আনুগত্যশীল এবং পরিশ্রমী; অন্যদিকে ইতিহাসের শেষ পর্যায়ে এসে তাদের মধ্যেও স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল। তারা ছিল ব্রিটিশ সামরিক পরিকাঠামোর মেরুদণ্ডের অন্যতম স্তম্ভ। কিন্তু এই আনুগত্য কখনোই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি স্থায়ী ভালোবাসা ছিল না; বরং তা ছিল একটি সময়, বাস্তবতা এবং বিকল্পহীনতার ফল।
আজ ইতিহাসের এই অধ্যায় আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শাসক যে-ই হোক, মুসলিম জাতি যদি ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন হয়, তবে তার ভূমিকাও হয় উল্লেখযোগ্য এবং বিদ্রোহও হয়ে ওঠে তাৎপর্যপূর্ণ।