
দক্ষিণ ইতালির আপুলিয়া অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহর বারি ছিল এই আমিরাতের কেন্দ্রবিন্দু। তিনজন মুসলিম গভর্নরের অধীনে পরিচালিত এই আমিরাতের মূল উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টান বিশ্বের কেন্দ্রস্থল রোমে ইসলামী প্রভাব প্রতিষ্ঠা করা। মুসলিমরা একসময় পোপের রাজ্যের খুব কাছাকাছিও পৌঁছে গিয়েছিল।
তবে দুঃখজনকভাবে এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়টি ইতিহাসের মূলধারার উৎস গ্রন্থগুলোতে উল্লেখ নেই বা থাকলেও খুবই সীমিত। অথচ এটি ছিল সাহস, দূরদর্শিতা ও ইসলামী ইতিহাসের এক সোনালি অধ্যায়।
বারি জয়ের প্রাথমিক প্রচেষ্টা শুরু হয় ৮৪০ খ্রিস্টাব্দে। ইতিহাসবিদ বালাধুরি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ফুতুহ আল-বুলদান’-এ এই প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেছেন।
তবে আক্রমণটি সফল হয়নি। এর ঠিক সাত বছর পর ৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে, মুসলিম সেনাপতি প্রিন্স খালফুন দৃঢ়সংকল্প নিয়ে বারির দিকে অগ্রসর হন এবং শহরের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
এই ঐতিহাসিক বিজয়ের পর প্রিন্স খালফুন নিজেকে বারি আমিরাতের প্রথম গভর্নর হিসেবে ঘোষণা করেন এবং প্রতিষ্ঠা করেন দক্ষিণ ইতালির মুসলিম শাসনের এক নতুন অধ্যায়।
ইতালির বুকে ইসলামের হারানো গৌরববারি বিজয়ের পর আমির খালাফুন শাসনভার গ্রহণ করেন এবং একটি সুসংগঠিত ইসলামী প্রশাসন গড়ে তোলার জন্য কাজ শুরু করেন।
তিনি শহরের খ্রিস্টানদের সম্পত্তি ও গির্জাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। মুসলিম নৌবহরকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগী হন এবং দক্ষিণ ইতালির বৃহৎ একটি অংশকে বারি আমিরাতের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। পাশাপাশি শহরে মুসলমানদের জনসংখ্যা বাড়াতে সচেষ্ট হন, যাতে ইসলামী আমিরাতের রূপ আরো দৃঢ় হয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরের ভেতরে তিনটি গোষ্ঠী—আরব, বারবার ও ইহুদিদের মধ্যে মতবিরোধ ও অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এক পর্যায়ে ৮৫২ খ্রিস্টাব্দে আমির খালাফুন নিহত হন।
তাঁর মৃত্যুর পর শাসনভার গ্রহণ করেন আমির মুফরাক ইবনে সালাম।
প্রিন্স খালাফুনের শাসনকাল মাত্র পাঁচ বছর স্থায়ী হলেও, তিনি বারি আমিরাতের ভিত্তি স্থাপন করে এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। তিনি বারি আমিরাতের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির লক্ষ্যে আব্বাসীয় খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিলের কাছে একটি চিঠি পাঠান। তবে তাঁর শাসনকালজুড়ে খলিফার তরফ থেকে প্রত্যুত্তর বিলম্বিতই রয়ে যায়।
বারি আমিরাতের স্থায়িত্বের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় আরব ও বারবার গোষ্ঠীর মধ্যকার অভ্যন্তরীণ বিরোধ। এই মতবিরোধ চরমে পৌঁছে এবং ৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে যুবরাজ মুফরাক ইবনে সালামের রহস্যজনক মৃত্যুর মাধ্যমে তাঁর চার বছরের শাসনের অবসান ঘটে।
মুফরাকের মৃত্যুর পর যুবরাজ সুদান আল-মাউরি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি তাঁর দুই পূর্বসূরির ভাগ্য থেকে শিক্ষা নিয়ে আরব ও বারবারদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সচেষ্ট হন। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদ, সম্পদ, লুণ্ঠিত ধনসম্পদ এবং ভূমি সমানভাবে উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টন করেন, যাতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পায় এবং গৃহযুুদ্ধ এড়ানো যায়। শুধু অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নয়, সুদান তাঁর শাসনামলে বারি আমিরাতকে আরো সম্প্রসারিত করতেও উদ্যোগী হন। ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি কাপুয়া, কনজা ও লিবোরিয়া—এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে আমিরাতের সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন।
আমির সুদান আল-মাউরি শাসনকালকে আরো শক্তিশালী করতে নেপলস জয়ের উদ্দেশ্যে এক সাহসী অভিযান পরিচালনা করেন। তবে এই অভিযান পরিকল্পনামাফিক এগোতে পারেনি, কারণ হঠাৎ কলেরা মহামারি ছড়িয়ে পড়ে, যা তাঁর বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। তিনি যখন বারিতে ফিরে আসেন, তখন ডিউক লম্বার্ডো প্রথম-এর নেতৃত্বে কয়েকটি খ্রিস্টানগোষ্ঠী জোট বেঁধে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এই অভ্যুত্থানের চেষ্টা শহরের ভেতর থেকেই পরিচালিত হয়েছিল, যা সুদানকে হতচকিত করে তোলে, কিন্তু সুদান আত্মসমর্পণ করেননি; বরং তিনি ও তাঁর অনুগত বাহিনীকে নিয়ে ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে সেই জোটের সৈন্যদের পরাজিত করেন এবং পুনরায় শহরে প্রবেশ ও পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। অবশেষে ৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে, বহু প্রত্যাশিত এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত আসে। তিনি আব্বাসীয় খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিলের কাছ থেকে একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি লাভ করেন, যে চিঠির জন্য সাবেক আমির মুফরাক ইবনে সালাম দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করেছিলেন। এই পত্রে সুদানের শাসন আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায় এবং বারিকে আব্বাসীয় খিলাফতের একটি প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এরপর বারি শহর বিভিন্ন স্মৃতিস্তম্ভ, প্রাসাদ এবং ইসলামী স্থাপত্যে সমৃদ্ধ হতে থাকে। এর মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেই বৃহৎ জামে মসজিদ, যার নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন আমির মুফরাক। এই মসজিদ শুধু নামাজের স্থানই ছিল না, বরং তা হয়ে উঠেছিল ইসলামী জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষা বিস্তারের কেন্দ্র। শহরের মানুষ ধীরে ধীরে আরবি ভাষা শেখা শুরু করে, এবং বারি এক সত্যিকারের ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রতে রূপ নেয়। বারি আমিরাতের উত্থান বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ফ্রাংকিশ সম্রাট দ্বিতীয় লুই এবং বেনেভেন্তোর ডিউক আদেলচি শিগগির এই নবগঠিত ইসলামী আমিরাতকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা স্পোলেটো এবং নেপলসের রাজপুত্রদের সঙ্গে একটি সামরিক জোট গঠন করে বারি আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। তবে এই প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়; কিন্তু সম্রাট লুই এত সহজে হাল ছাড়েননি। কিছু স্থানীয় বিশ্বাসঘাতকের সহযোগিতায় তিনি আবার আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। দীর্ঘ প্রস্তুতির পর, অবশেষে ২ ফেব্রুয়ারি ৮৭১ খ্রিস্টাব্দে, চার বছরের দীর্ঘ অবরোধের অবসান ঘটে। বারি শহর তখন চরম দুরবস্থার মধ্যে ছিল—রোগবালাই ছড়িয়ে পড়েছিল, খাদ্য ও অস্ত্রের সংকটে জনগণ দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এই সুযোগে সম্রাট লুই শহরের প্রাচীর ভেঙে প্রবেশ করতে সক্ষম হন এবং বারির ইসলামী আমিরাতের ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানেন।
ইতিহাসবিদ মোসকা উল্লেখ করেন, এই অভিযানে সম্রাট দ্বিতীয় লুই চরম নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছিলেন। তাঁর আদেশে শহরের সব বন্দি—পুরুষ, নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়। এই নৃশংস গণহত্যা থেকে শুধু আমিরাতের সুলতান রেহাই পান। তাঁকে জীবিত অবস্থায় মুসলিমদের হাতে ফেরত দেওয়া হয়। এভাবেই বারির ইসলামী আমিরাতের পতন ঘটে এবং ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায় রক্তে রঞ্জিত এক করুণ ইতিহাসে পরিণত হয়।
আলুকাহ ডটনেট অবলম্বনে