
ড. সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার প্রথম কীর্তিমান শিক্ষাবিদ, যিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. ফিল ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁকে আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে প্রফেসর ইমেরিটাস হিসেবে নিয়োগ দেয়।
ড. মোয়াজ্জেম হোসেন ১ আগস্ট ১৯০১ সালে টাঙ্গাইলের বানিয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর বাবা সৈয়দ কেরামত আলী সুফি সাধক ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম সৈয়দা সাবেরুন্নেসা। ড. মোয়াজ্জেম হোসেন নিজ গ্রাম বানিয়ারাতে প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। জামরকীতে অবস্থিত ‘স্যার আবদুল গনী ইংরেজি বিদ্যালয়’ থেকে ১৯১৮ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ এবং ১৯২০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে তিনি ভর্তি হন। ১৯২৩ সালে তিনি বিএ অনার্স পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ১৯২৪ সালে তিনি এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থানসহ সরকারি বৃত্তি লাভের গৌরব অর্জন করেন। তৎকালীন আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজের হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট প্রফেসর ড. আব্দুস সাত্তার সিদ্দিকীর তত্ত্বাবধানে ‘গরাইবুল কোরআন’ বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা শুরু করেন।
তিনি শামসুল উলামা মাওলানা নাজির হাসানের কাছে হাদিস ও তাফসিরের উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করেন। ১৯২৬ সালে তিনি বেঙ্গল গভর্নমেন্টের স্টেট স্কলারশিপ নিয়ে তিন বছরের পিএইচডি কোর্সে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় গমন করেন। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে প্রফেসর ডি এস মারগোলিউথ (D.S Margoliouth)-এর তত্ত্বাবধানে ‘Ancient Arabic Poetry : Kitabal-Ikhtiyarain’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য ডি. ফিল ডিগ্রি অর্জন করেন।
ড. এস এম হোসেন ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ উপাচার্য নিযুক্ত হন এবং ৮ নভেম্বর ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিরত অনেক বিদেশি শিক্ষক নিজ দেশে চলে যান।
ফলে তীব্র শিক্ষক সংকটে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব হয়। আবার ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সময় তাঁর নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার বাঙালি জাতির পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। ১৯৫৩-৫৬ সাল পর্যন্ত ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান। এ ছাড়া ১৯৬৪-১৯৭১ পূর্ব পাকিস্তান মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ড. মোয়াজ্জেম হোসেনের অসামান্য কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তাঁকে ‘সেতারা-ই-কায়েদে আজম’ উপাধিতে ভূষিত করে।
একজন খ্যাতিমান গবেষক ও শিক্ষাবিদ অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। যেমন—
১. ১৯৩০ সালে তিনি পাটনায় অনুষ্ঠিত All India Oriental Conference-এ যোগদান করেন এবং An Unknown Ancient Arabic Ode by an Nazzar শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন।
২. ১৯৩৭ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে গ্রেট ব্রিটেনের ব্রিটিশ একাডেমির প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন
৩. ১৯৪৯ সালে কানাডায় হেলিফ্যাক্সে অনুষ্ঠিত ‘Conference of the Executive Committee of the Heads of the Universities in the British Commonwealth’-এ তিনি পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন।
ড. সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচনায়ও দক্ষতার পরিচয় দেন। তাঁর রচিত কয়েকটি গ্রন্থ হলো—
১. মারিফাতু উলুমিল হাদিস, হাদিসশাস্ত্রের নীতিমালার ওপর রচিত ইমাম হাকিম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ হাফিজ নিশাপুরী (রহ.)-এর সংকলিত একটি গ্রন্থ। তিনি তাতে টীকা-টিপ্পনী, নোট, সংকলকের পরিচিতি, সংশোধন, হাদিস সংকলনের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত সংযোজন করেন।
২. কিতাব আল রুমুজ
৩. Early Arabic Odes, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩৮
খ. প্রবন্ধ
1. An unknown Ancient Arabic Odes by An-nazzar bin Hashim al-asadi
2. Islamic Education in Bengal
3. Published in the Procedings of the All-India Oriental Conference held at Trivendrum. ১৯৩৮
মহান এই শিক্ষাবিদ ১৯৯১ সালের ১৪ আগস্ট দুপুর ১টা ১০ মিনিটে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। টাঙ্গাইলে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
লেখক : ড. মুহাম্মদ খাইরুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা